জন্মদিনে ফিরে দেখুন ঋতুপর্ণার তিন দশকের যাত্রা
বাংলা সিনেমার ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যাদের উপস্থিতি শুধু পর্দাতেই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিশে গেছে দর্শকের অনুভূতিতে। তেমনই এক নাম ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। তার চোখের অভিব্যক্তি, সংলাপের উচ্চারণ কিংবা হাসি সবকিছু মিলেই যেন এক আলাদা ভাষা তৈরি করেছে, যে ভাষা অভিনয়ের থেকেও গভীর। ছবি: অভিনেত্রীর ফেসবুক থেকে
-
১৯৭১ সালের এই দিনে কলকাতায় জন্ম নেওয়া ঋতুপর্ণা ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শিল্পমনস্ক। নাচ, গান, নাটক সবকিছুর সঙ্গেই তার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। স্কুলে পড়ার সময়ই শিক্ষকরা বুঝে গিয়েছিলেন, এই মেয়েটি কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয় তার চোখে বড় ক্যানভাসের স্বপ্ন আছে। পরবর্তীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক শেষ করে অভিনয়ের দুনিয়ায় প্রবেশ করেন তিনি।
-
১৯৯২ সালে ‘শ্বেতপাথর’ ছবির মাধ্যমে টালিউডে পা রাখেন ঋতুপর্ণা। কিন্তু দর্শক তাকে চিনে ‘শুভ মহরৎ’, ‘দহন’, ‘উৎসব’ কিংবা প্রতাপ মুখোপাধ্যায়ের ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ এর মতো ছবির মাধ্যমে। প্রতিটি চরিত্রে তিনি এমনভাবে নিজেকে ভেঙে গড়ে নিয়েছেন, যেন চরিত্রের ভেতরেই তার নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে।
-
‘দহন’ ছবিতে ঋতুপর্ণা অভিনয় করেছিলেন এক ধর্ষণ-পরবর্তী সামাজিক লড়াইয়ের গল্পে, যেখানে তার সংবেদনশীল অভিনয় শুধু প্রশংসা নয়, পেয়েছিল জাতীয় পুরস্কারও। সেই ছবির পর থেকে ঋতুপর্ণা আর শুধু এক অভিনেত্রী নন, তিনি হয়ে ওঠেন সমাজ-সংলগ্ন এক শিল্পী, যিনি প্রতিটি চরিত্রে সময়ের প্রতিবাদকে জীবন্ত করে তোলেন। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি ঋতুপর্ণা বলিউডেও নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন।
-
ক্যামেরার সামনে যতটা শক্তিশালী, ঋতুপর্ণা ব্যক্তিজীবনে ততটাই নম্র ও পারিবারিক। স্বামী সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় এবং দুই সন্তান অনন্যা ও ইশানের সঙ্গে তার সম্পর্কের উষ্ণতা বহুবার এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ব্যস্ত শিডিউলের মাঝেও তিনি নিজের সন্তানদের সময় দেন, নাচের স্কুল ‘চাঁদনী’ এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন আর নানা সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেন।
-
ঋতুপর্ণা সেই বিরল অভিনেত্রীদের একজন, যিনি বাণিজ্যিক, আর্ট, আধুনিক সব ধরনের সিনেমায় নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন। সময় বদলেছে, দর্শক বদলেছে, সিনেমার ভাষা বদলেছে, কিন্তু তার অভিনয়ের তীব্রতা কমেনি এক বিন্দুও। তিনি জানেন, একজন অভিনেত্রীর জন্য সৌন্দর্য যতটা জরুরি, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি নিজের মনের গভীরতা।
-
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বেলাশুরু’, ‘ড. বৃষ্টি’, ‘গৌরাঙ্গের ভূবনভরা প্রেম’ কিংবা ‘মুক্তি’ সিরিজে তার কাজ প্রমাণ করে দিয়েছে তিনি এখন আরও পরিণত, আরও আত্মবিশ্বাসী। তিনি কেবল চরিত্রে অভিনয় করেন না, চরিত্রকে অনুভব করেন। বাংলা সিনেমা আজ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে ঋতুপর্ণা এক প্রেরণার নাম, এক অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়।
-
দীর্ঘ তিন দশকের ক্যারিয়ারে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার (ইস্ট), আন্তর্জাতিক নারী সম্মাননা, আরও অনেক কিছু। কিন্তু তার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো দর্শকের ভালোবাসা-যা তাকে প্রতিটি নতুন চরিত্রে নতুন করে জন্ম নিতে অনুপ্রাণিত করে।