মানবতার অনন্ত প্রতীক মাদার তেরেসা
কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় হয়তো এখনো তার পদচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবু অনুভব করা যায় তার স্পর্শ, তার নিঃশব্দ সেবার শক্তি। তিনি কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন না কোনো প্রভাবশালী ধনকুবের। অথচ মানবতার ইতিহাসে তার নাম লেখা আছে সোনার অক্ষরে। তিনি মাদার তেরেসা-একজন নারী, যার কাছে মানবতার সংজ্ঞা নতুন অর্থ পেয়েছিল। ছবি: এফপি ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
-
১৯১০ সালের এই দিনে বর্তমান উত্তর মেসিডোনিয়ার স্কপজেতে জন্মগ্রহণ করেন আঞ্জেস গনজা বোজাঝিউ নামে এক মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই তার মনে এক অদ্ভুত তৃষ্ণা ছিল-কেন পৃথিবীতে এত কষ্ট? এত দারিদ্র্য? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই তিনি আবিষ্কার করেন নিজের জীবনের লক্ষ্য, অন্যের কষ্ট লাঘব করা।
-
মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি সন্ন্যাসিনী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নাম পরিবর্তন করে রাখেন তেরেসা, প্রিয় সাধ্বী সেন্ট তেরেসা অব লিসিওর নামে। এরপরই তার যাত্রা শুরু হয় সেই পথে, যেখানে নিজেকে ভুলে অন্যের জন্য বাঁচাই একমাত্র লক্ষ্য।
-
১৯২৯ সালে তিনি ভারতে আসেন। শুরুতে স্কুলে শিক্ষকতা করলেও খুব শিগগির বুঝতে পারলেন, দারিদ্র্যের যে ভয়াবহতা কলকাতার রাস্তায় ছড়িয়ে আছে, তা ক্লাসরুমের দেয়াল পেরিয়ে গেছে। তিনি দেখলেন ফুটপাথে শুয়ে আছে অসহায় মানুষ, মৃত্যুর অপেক্ষায়; কেউ তাদের স্পর্শ করে না, কেউ তাদের চোখের পানি মুছে না।
-
সেই মুহূর্তে মাদার তেরেসা উপলব্ধি করলেন, এই মানুষগুলোর জন্যই তিনি বেঁচে আছেন। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন মিশনারিজ অব চ্যারিটি, যার মূল লক্ষ্য ছিল মৃত্যু পথযাত্রী, অসুস্থ, অনাথ, অসহায় মানুষকে আশ্রয় দেওয়া।
-
সমালোচনা? হ্যাঁ, তার কাজকে ঘিরে ছিল নানা প্রশ্ন, বিতর্ক। কেউ বলেছে তিনি দারিদ্র্যকে মহিমান্বিত করছেন, কেউ বলেছে তার চিকিৎসার মানদণ্ড খুবই নিম্নমানের। কিন্তু এসবের চেয়ে বড় ছিল তার অবিচল হৃদয়। তিনি জানতেন, কষ্টের সময়ে উষ্ণ স্পর্শ আর এক ফোঁটা ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় ওষুধ।
-
তিনি নিজে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই বড় কিছু করতে পারি না, কিন্তু ছোট ছোট কাজ অসীম ভালোবাসা দিয়ে করতে পারি।’- এটাই ছিল তার দর্শন।
-
১৯৭৯ সালে মাদার তেরেসা নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। সেদিনের আলো ঝলমলে মঞ্চে তিনি বিলাসবহুল ভোজ প্রত্যাখ্যান করে সেই অর্থ গরিবদের দান করেন। তার কাছে ক্ষমতার মানে ছিল না করতালির ঝড়, বরং সেই অসহায় বৃদ্ধার হাসি, যে রাস্তার পাশে শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার আগে বলেছিল ‘মা, তুমি আছো।’
-
১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন মাদার তেরেসা। কিন্তু তার সেবা থেমে যায়নি। আজও মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র ছায়ায় হাজারো অসহায় মানুষ আশ্রয় পায়।
-
তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ধর্ম, বর্ণ, জাতি-সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় পরিচয় মানবতা। যখন দুনিয়া বিভাজনের দেয়ালে আটকে যায়, তখন মাদার তেরেসার জীবন আমাদের শেখায় একজন মানুষের ভালোবাসাই পারে অন্ধকার গলিতে আলো জ্বালাতে।
-
আজ আমরা গর্বের সঙ্গে প্রযুক্তির যুগে বাস করছি, অথচ কোথাও না কোথাও একাকী মানুষ কষ্টে ডুবে আছে। সেসব মানুষকে যদি কেউ এগিয়ে এসে শুধু হাত ধরে বলে ‘তুমি একা নও’, তাহলে সেটাই হবে সত্যিকারের শ্রদ্ধা মাদার তেরেসার প্রতি। কারণ তিনি শিখিয়ে গেছেন, ‘ভালোবাসা তখনই সত্যি হয়, যখন তা আত্মত্যাগে পরিণত হয়।’