টেস্ট থেকে কোচিং, সিম্পসনের চার দশকের ক্রিকেট রাজত্ব
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের এক সোনালি অধ্যায়ের নাম বব সিম্পসন। ক্রিকেট মাঠে তার ব্যাটের কারিশমা, স্লিপে চৌকস ফিল্ডিং কিংবা ড্রেসিংরুমে প্রেরণাদায়ী নেতৃত্ব সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন আলাদা মাত্রার একজন কিংবদন্তি। খেলোয়াড়, অধিনায়ক, কোচ এই তিন ভূমিকায় সমান দক্ষতায় নিজেকে মেলে ধরে তিনি ক্রিকেটের সঙ্গে কাটিয়েছেন চার দশকেরও বেশি সময়। ঠিক সেই কারণেই ক্রিকেট ইতিহাস তাকে মনে রাখবে রাজত্বকারী এক মহারথী হিসেবেই। আজ এই কিংবদন্তির প্রয়াণ ক্রিকেটবিশ্বকে শোকাহত করেছে। তবে তার রেখে যাওয়া শিক্ষা, সাফল্য আর স্মৃতি আগামী প্রজন্মকে বারবার অনুপ্রাণিত করবে। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
-
১৯৩৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি তার ঝোঁক ছিল প্রবল। তবে ক্রিকেটেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজের আত্মপরিচয়। হাতে ব্যাট তুলে নেওয়ার পর খুব দ্রুতই বয়সভিত্তিক দলে নজর কাড়েন তিনি। নিখুঁত টেকনিক আর ধৈর্যের সঙ্গে ইনিংস গড়ে তোলার ক্ষমতা তাকে আলাদা করে তুলেছিল।
-
১৯৫৭ সালে সিম্পসনের টেস্ট অভিষেক হয় ভারতের বিপক্ষে। শুরুতে ইনিংসে বড় কোনো সাফল্য না পেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি দলে হয়ে উঠলেন ভরসার প্রতীক। বিশেষত ওপেনার হিসেবে তিনি ব্যাট হাতে গড়ে তোলেন অনন্য দৃঢ়তা।
-
১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত ইনিংস আসে অবিচল ৩১১ রান। ১৩ ঘণ্টা ব্যাট করে এই ম্যারাথন ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। তখনকার অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং সংকটে তার এই ইনিংস শুধু দলকে বাঁচায়নি, বরং তাকে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায় অমর করে দেয়।
-
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অশান্তির মধ্যে ছিল। সেই সময়ে সিম্পসন দলের অধিনায়কত্ব পান। তার নেতৃত্বে দল নতুন করে নিজেদের গুছিয়ে নেয়। তিনি শুধু ব্যাট হাতে দলকে পথ দেখাননি, বরং মাঠে কৌশলী সিদ্ধান্ত আর ফিল্ডিংয়ে উৎকর্ষ দিয়ে দলকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন।
-
১৯৬৮ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে সিম্পসন ক্রিকেট থেকে বিদায় নেন। ব্যবসা আর পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য তিনি মাঠ থেকে সরে যান। কিন্তু ক্রিকেট তাকে ছাড়েনি।
-
১৯৭৭ সালে বিশ্ব ক্রিকেটে শুরু হয় অস্থিরতা ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’ এর কারণে অস্ট্রেলিয়ার মূল দল ভেঙে যায়। তখন জাতীয় দলকে টেনে তোলার জন্য জরুরি ভিত্তিতে ফিরে আসেন সিম্পসন। দীর্ঘ বিরতির পরও তিনি দলের জন্য খেলেন এবং নেতৃত্ব দেন। এই প্রত্যাবর্তনই তার দৃঢ়তা ও ক্রিকেটপ্রেমের অনন্য উদাহরণ।
-
খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানার পরও সিম্পসন ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যাননি। বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকায় আবির্ভূত হন তিনি অস্ট্রেলিয়ান দলের কোচ হিসেবে। ১৯৮৬ সালে দায়িত্ব নিয়ে তিনি দলকে নতুন করে দাঁড় করান।
-
তার হাতে গড়ে ওঠে ভবিষ্যতের সোনালি প্রজন্ম অ্যালান বর্ডার, স্টিভ ও, মার্ক টেলর, শেন ওয়ার্ন, গ্লেন ম্যাকগ্রাথদের মতো তারকারা।
-
সিম্পসনের কঠোর শৃঙ্খলা, অনুশীলনে কঠোরতা আর মানসিক দৃঢ়তার শিক্ষা অস্ট্রেলিয়াকে নব্বইয়ের দশকের শেষ থেকে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে রূপ দেয়। ক্রিকেটের ইতিহাসে যে আধিপত্য অস্ট্রেলিয়া গড়ে তোলে, তার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন মূলত সিম্পসন।
-
সিম্পসন শুধু ব্যাটিং বা কোচিংয়েই নয়, ফিল্ডিংয়েও ছিলেন পথিকৃৎ। বিশেষত স্লিপ ফিল্ডিংয়ে তার সুনাম ছিল কিংবদন্তির মতো। বলা হয়, আধুনিক ক্রিকেটে ফিল্ডিংয়ের গুরুত্ব যেভাবে বেড়েছে, তার সূচনা হয়েছিল অনেকটা সিম্পসনের হাত ধরেই।
-
চার দশকের ক্রিকেট জীবন শেষে বব সিম্পসন রেখে গেছেন এক অমূল্য উত্তরাধিকার। একজন খেলোয়াড় হিসেবে তিনি দৃঢ়তা শিখিয়েছেন, অধিনায়ক হিসেবে নেতৃত্বের মানে শিখিয়েছেন আর কোচ হিসেবে শিখিয়েছেন কিভাবে দলকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছানো যায়।