অভিযানের ঝড় মালদ্বীপে: অবৈধ বাণিজ্যের শেকড় গভীরে
মালদ্বীপ সরকার সম্প্রতি অবৈধ বাণিজ্য ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে। রাজধানী মালে থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।
ইমিগ্রেশন কন্ট্রোলার জেনারেল আহমেদ ফাসিহের ঘোষণা অনুযায়ী, বিদেশিদের মাধ্যমে পরিচালিত বাণিজ্য চক্র ভাঙাই এই অভিযানের মূল লক্ষ্য।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর নয়টি এলাকায় হঠাৎ চালানো তল্লাশিতে প্রশাসনের ‘উল্লেখযোগ্য সাফল্য’ এসেছে বলে দাবি করা হলেও সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এখনো প্রকাশ করেনি সরকার।
তবে এরই মধ্যে স্থানীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে।
রাজধানী থেকে দ্বীপাঞ্চলে: ধাপে ধাপে পরিকল্পনা
মালদ্বীপের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ দাউদ জানিয়েছেন, এই অভিযান তিন ধাপে পরিচালিত হবে। প্রথম ধাপ: রাজধানী মালে ও তার আশপাশের এলাকায় অভিযান। দ্বিতীয় ধাপ: ঘনবসতিপূর্ণ বড় দ্বীপপুঞ্জে অভিযান। তৃতীয় ধাপ: ছোট ছোট জনবসতিপূর্ণ দ্বীপে ছড়িয়ে পড়া অবৈধ ব্যবসা দমন।
এই ধাপভিত্তিক কৌশলের উদ্দেশ্য হলো মূল কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করে শেকড় উপড়ে ফেলা, যেন ছোট দ্বীপগুলোতেও এর প্রভাব বন্ধ করা যায়।
সমান্তরালে চলছে ‘অপারেশন কুরাঙ্গি’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আলাদাভাবে ‘অপারেশন কুরাঙ্গি’ নামের অপারেশন চালাচ্ছে, যার লক্ষ্য প্রবাসী শ্রমিকদের নিবন্ধন ও সঠিক তথ্য সংগ্রহ। রাষ্ট্রপতি ড. মোহাম্মদ মুইজ্জুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী। এরই মধ্যে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৮২ জন বিদেশিকে শনাক্ত করা হয়েছে।
অবৈধভাবে অবস্থান ও বাণিজ্যে জড়িত থাকার কারণে আট হাজারের বেশি অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা
সরকার স্বীকার করেছে, অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে কেবল বিদেশি নয়, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক মহলও জড়িত। ইমিগ্রেশন কন্ট্রোলার জেনারেল আহমেদ ফাসিহ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বলেন, বিদেশিরা সামনের সারিতে থাকলেও, পেছনে নিয়ন্ত্রণ থাকে স্থানীয় শক্তিশালী ব্যবসায়ীদের হাতে। সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া এ চক্র ভাঙা সম্ভব নয়।
এই স্বীকারোক্তি থেকেই বোঝা যায়, সরকার প্রকৃত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। কারণ স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ধরতে গেলে বড় ধরনের চাপ ও প্রতিরোধ আসতে পারে।
শ্রমিকদের ভয় ও অনিশ্চয়তা
মালের একটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করা বাংলাদেশি শ্রমিক আবদুল করিম (ছদ্মনাম) বলেন, আমরা এখানে বৈধভাবে কাজ করি। কিন্তু অভিযান শুরু হওয়ার পর সবাই ভয়ে আছে। পুলিশ আসলে বৈধ কাগজ থাকলেও ঝামেলা পোহাতে হয়। এক মালিকের কিংবা এজেন্সির নামে কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ধরে নিয়ে যায়।
এমন ভয় শুধু বাংলাদেশি নয়, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের শ্রমিকদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অভিযোগ—নিবন্ধন ও ভিসা নবায়নের প্রক্রিয়া জটিল এবং খরচসাপেক্ষ। আবার মালিক সময় মতো বেতন দেয় না। বেতন বাড়ে না। ফলে অনেকেই অজান্তে অবৈধ হয়ে যান।
ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি
রাজধানী মালের একটি পাইকারি দোকানের মালিক রিজওয়ান শিহাব বলেন, বিদেশিরা যদি পুরোপুরি বাজার থেকে বাদ যায়, তবে শ্রম ও খুচরা ব্যবসার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। স্থানীয়রা যে মূল্যে কাজ করছে, বিদেশিরা তার অর্ধেক মূল্যে কাজ করে।
তিনি আশঙ্কা করেন, হঠাৎ কড়াকড়ি হলে বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে।
অর্থনীতি ও মানবাধিকার: দ্বৈত চাপ
মালদ্বীপের অর্থনীতি মূলত পর্যটন খাতকেন্দ্রিক হলেও, নির্মাণ, পরিবহন ও সেবা খাতের বড় অংশই বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। হঠাৎ অভিযান চালালে শ্রমিক সংকট দেখা দিতে পারে।
পর্যটন ও অবকাঠামো খাতে প্রকল্প বিলম্বিত হতে পারে। ক্ষুদ্র ব্যবসা ধসের মুখে পড়তে পারে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নির্বাসন কার্যক্রমে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া না মানলে আন্তর্জাতিক সমালোচনা আসবে। হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক অব মালদ্বীপের এক মুখপাত্র জানান, আমরা চাই অবৈধ ব্যবসা বন্ধ হোক। তবে এর নামে যেন শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক আচরণ না হয়।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
মালদ্বীপে বর্তমানে প্রায় ১ লাখের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ঢাকার কূটনৈতিক মহল জানাচ্ছে, যদি বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, তবে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে।
একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরাও অপেক্ষা করছেন। যদি সরকার দেখাতে পারে যে তারা দুর্নীতি ও অবৈধ বাণিজ্য সত্যিই বন্ধ করতে পারছে, তবে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু যদি অভিযান কেবল ক্ষুদ্র শ্রমিকদের সীমাবদ্ধ থাকে, তবে ব্যবসায়িক আস্থা হ্রাস পেতে পারে।
সম্ভাব্য ইতিবাচক ফলাফল
যদি অভিযান সফল হয়—বৈধ ব্যবসার পরিবেশ তৈরি হবে। কর রাজস্ব বাড়বে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে পারে। অভিবাসন প্রক্রিয়া হবে সুশৃঙ্খল।
মালদ্বীপ সরকারের অভিযান এরই মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে মূল প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই পদক্ষেপ কি সত্যিই প্রভাবশালী মহলের বিরুদ্ধে কঠোর হবে, নাকি বিদেশি শ্রমিকদের বলির পাঁঠা বানিয়েই থেমে যাবে?
সফল হতে হলে সরকারকে শুধু আইন প্রয়োগ নয় বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা ও মানবিকতা—এই তিনের সমন্বয় ঘটাতে হবে। তা না হলে অভিযানের ফলাফল হয়তো হবে তাৎক্ষণিক প্রদর্শনী, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে মালদ্বীপের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য তা হয়ে উঠতে পারে অচলাবস্থা।
এমআরএম/এমএস