‘বগ’ এক ভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের সন্ধানে

রাকিব হাসান রাফি
রাকিব হাসান রাফি রাকিব হাসান রাফি , স্লোভেনিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৮:৩২ পিএম, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০

 

‘বগ’ হলো কোনও একটি অঞ্চল, যা ভেজা কিংবা স্যাঁতসেঁতে মাটি দ্বারা তৈরি। এ অঞ্চলটি কোনও ভারী বস্তুকে ধরে রাখতে পারে না, খুবই নরম। বিশেষ কোনও ধরনের ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল এবং হ্রদ, বিল এবং হাওড় কিংবা সমভূমির মতো বগ।

বিজ্ঞাপন

আর এ ধরনের বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলের সন্ধান পাবেন পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের দেশগুলোতে। যেমনঃ লাটভিয়া, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, রাশিয়ার সাইবেরিয়া, নরওয়ে। কিংবা আপনাকে যেতে হবে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি থাকা কোনও অঞ্চলে যেমনঃ আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়াতেও দেখা মিলবে।

আজ থেকে দশ হাজার বছর পূর্বের কথা, জীবিজ্ঞানী কিংবা ভূ-গোলবিদদের মতে সে সময়কে বলা হয় ‘পোস্টগ্ল্যাসিয়াল’ যুগ। পৃথিবীর সমুদ্র পৃষ্ঠের অনেক জায়গায় জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করে এবং পৃথিবীর অনেক জায়গায় আজকের দিনের মতো স্থলভাগ সৃষ্টি হতে আরম্ভ করেছে। ওই সময় পৃথিবীর আবহাওয়াও উষ্ণ এবং আর্দ্র হতে শুরু করেছে। পৃথিবীর পৃষ্ঠে এ বিশাল পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর উত্তরাঞ্চলের কিংবা দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গার জলাশয়ের তলদেশে সাপ্রোপেলিক নামক এক বিশেষ ধরনের অধঃক্ষেপ সৃষ্টি হতে শুরু করে (সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ মূলতঃ বেলেমাটি এবং জমে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীর অংশবিশেষ থেকে তৈরি হয়)।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ বগ সৃষ্টির প্রথম ধাপ, এরপর আরও এক থেকে দুই হাজার বছর পর অর্থাৎ আনুমানিক আট থেকে ৯ হাজার বছর পূর্বে পৃথিবীর আবহাওয়া যখন আরেকটু শুষ্ক হতে শুরু করে তখন পালুডিফিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে মস জন্মাতে শুরু করে। আমরা সকলেই জানি যে মস হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের অপুষ্পক উদ্ভিদ যা মূলতঃ স্যাঁতসেঁতে ও ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মলাভ করে, মসবর্গীয় উদ্ভিদগুলোতে কোনও ধরনের পরিবহন টিস্যু থাকে না এবং এরা থ্যালয়েড অর্থাৎ কোমল কাণ্ড ও পাতা থাকে।

এ ধরনের উদ্ভিদে কোনও প্রকৃত মূল থাকে না, মূলের পরিবর্তে রাইজয়েড বিদ্যমান এবং এদের বহুকোষী যা চারদিকে বন্ধ্যাকোষ দ্বারা আবৃত্ত থাকে। ক্রমবর্ধমান সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ এবং বিভিন্ন জৈব পদার্থের উপস্থিতি মস বিশেষ করে পিট আর স্প্যাগন্যাম জাতীয় মসের বৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করে এবং সেই সাথে মসের একটি স্তরের সৃষ্টি হয়।

এরপর আরও দুই থেকে তিন হাজার বছর পর অর্থাৎ আজকের থেকে পাঁচ কিংবা সাত হাজার বছর পূর্বে পোস্টগ্ল্যাসিয়াল যুগের শেষ পর্যায়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠের উষ্ণতা এবং আর্দ্রতা যখন মোটামুটি একটা পর্যায়ে উপনীত হয়, এ সময় এ সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায় কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ পুষ্টি উপাদানের স্বল্পতার দরুণ এ সময় এ অঞ্চলে থাকা অন্যান্য গাছপালার পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যা এ অঞ্চলে মসের বংশবৃদ্ধিতে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই ধারাবাহিকতায় পূর্বে সৃষ্টি হওয়া মসের স্তরটি ডিকম্পোজড হয় এবং এর ওপর স্তরভিত্তিতে মসের সৃষ্টি হতে থাকে। এটি হচ্ছে বগ সৃষ্টির সেকেন্ডারি ধাপ। এরপর আরও এক থেকে দেড় হাজার পর যখন পৃথিবীর শুষ্ক এবং উষ্ণ আবহাওয়া ক্ষণিকের জন্য মাঝে-মধ্যে আর্দ্রতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া শুরু করল।

অর্থাৎ আজ থেকে তিন-চার হাজার বছর পূর্বে যখন মসের এ স্তর পুরু হতে শুরু করলো তখন এ মসগুলো এমন অবস্থায় উপনীত হলো যে তাদের পক্ষে মাটি থেকে পানি এবং পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করা সহজ হয়ে উঠলো, এ সময় তখন আবার উদ্ভিদের প্রজনন শুরু হয় এ অঞ্চলে গড়ে উঠা এ মসের স্তরের উপর ভিত্তি করে। এ সকল স্তর এ অঞ্চলের উদ্ভিদকে একটি অবকাঠামো দান করে এবং উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও পুষ্টি উপাদানের উৎস হিসেবে রূপান্তরিত হয়।

আজ থেকে এক হাজার বছর পূর্বের বগগুলো যে রকম অবস্থায় আছে সে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, অর্থাৎ স্তরভিত্তিকভাবে মস জন্মাতে জন্মাতে তা মাটির মতো অবকাঠামো লাভ করে যার উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থানে পৌঁছায়।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

ক্রমবর্ধমান মসের কারণে বগের গঠন এখনও চলছে এবং একটি বগ সৃষ্টি হতে কমপক্ষে কয়েক হাজার বছর লাগে। বগকে তাই ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে বগ এমন একটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল যা সৃষ্টি হয়েছে কোনও জলাভূমির তলদেশে সৃষ্ট সাপ্রোপেলিক অধঃক্ষেপ থেকে এবং স্প্যাগন্যাম জাতীয় মসই আসলে এ বগকে পূর্ণতা দান করে।

যেহেতু এ অঞ্চলটি মস থেকে সৃষ্ট তাই এ অঞ্চলের মাটির পিএইচের পরিমাণ অত্যধিক অর্থাৎ অম্লীয় মাটি এখানকার প্রধান ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। তাই এ অঞ্চলে গাছপালার খুব একটি বেশি বৃদ্ধি ঘটে না, মূলতঃ এখানে বেরি, কোনিফার এবং পাইন জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়। আর মসের আবরণের জন্য এ অঞ্চলের মাটি অনেকটা স্পঞ্জের মতো এবং আপনি যদি এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে আপনার কাছে মনে হবে যে কিছু একটা জিনিস আপনাকে নিচের দিকে টানছে। অম্লীয় এবং শুষ্ক পরিবেশের কারণে এ অঞ্চলে জলজ প্রাণী জন্মতে পারে না তবে গ্রীষ্মকালে এখানে সারস, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির বকের পদচারণা দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

এ রকম একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, জায়গাটির নাম হচ্ছে কেমেরি ন্যাশনাল পার্ক যা লাটভিয়ার রাজধানী রিগা থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রিগার সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেনেই যেতে পারবেন কেমেরি ন্যাশনাল পার্কে এবং ভাড়া পড়বে দেড় ইউরোর মতো। কেমেরির ট্রেন স্টেশন থেকে আরও প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয় পার্কে পৌঁছাতে।

এখানে থাকা এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুবাদে স্লোভেনিয়া ও লাটভিয়া দুইটি সেনজেনের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র তাই স্লোভেনিয়ার টেম্পোরারি রেসিডেন্স পারমিট দিয়েই আমি লাটভিয়া ভ্রমণ করেছি। তবে বাংলাদেশ থেকে লাটভিয়া যদি কেউ বেড়াতে আসেন তাহলে অবশ্যই তাকে সেনজেন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এমন কোনও দেশের ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।

গত বছরের শেষের দিকে লাটভিয়া ভ্রমণে যাই। ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে “Couchsurfing”- এ নামটি জনপ্রিয়। “Couchsurfing”- কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে তুলনা করা যায়। ধরুন, আপনি কোনও একটি স্থানে ভ্রমণের জন্য বের হচ্ছেন। ঘোরার পাশাপাশি সে জায়গাটি সম্পর্কে কিংবা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কিংবা সে অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আপনি বিশেষভাবে আগ্রহী।

বিজ্ঞাপন

কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গা সম্পর্কে কিংবা কোনও একটি অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে জানার সুযোগ হচ্ছে এ Couchsurfing. গুগল প্লে স্টোর কিংবা আইস্টোর থেকে আপনি অ্যাপটি ডাউনলোড করতে পারেন। আপনি আপনার ই-মেইল অ্যাড্রেস কিংবা ফেসবুকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অ্যাপটির সদস্য হিসেবে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। যে স্থানে আপনি ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন সে জায়গার নাম লিখে সেখানে সার্চ আপনাকে তারা কয়েকজন মানুষের প্রোফাইল দেখাবে যারা ওই অঞ্চলে বসবাস করেন।

আপনি তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। যদি তাদের কারও আপনাকে পছন্দ হয় এবং যেদিন আপনি সেখানে ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন সেদিন যদি তিনি সময় বের করতে পারেন তাহলে তিনি আপনাকে নিয়ে ওই দিন ঘুরবেন, আপনাকে স্থানীয় কৃষ্টি কিংবা সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেবেন। এমনকি ভাগ্য ভালো হলে তার বাসায় আপনি কয়েক রাত (সাধারণত দুই রাত) অতিথি হিসেবে থাকার জন্য প্রস্তাব পেতে পারেন।

অ্যাপটির মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয় বাইবা রয়ালের। বয়সে সে আমার থেকে দশ বছরের বড় কিন্তু তাকে দেখে এখনও মনে হয় আঠারো বছরের কিশোরী। রূপ-লাবণ্যের দিক থেকে তার তুলনা নেই। ব্যবহারেও অমায়িক। এক পলকে তাকে দেখার সাথে সাথে যে কেউ তার প্রেমে পড়ে যাবে। লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে তার বসবাস। যদিও তিনি বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের ওপর মাস্টার্স করেছেন তবে বর্তমানে তিনি অ্যাকাডেমিভিত্তিক কোনও জায়গায় না গিয়ে বরং নিজ উদ্যোগে নিজের জীবন অতিবাহিত করছেন।

বিজ্ঞাপন

মূলত একজন ফটোগ্রাফার এবং পাশাপাশি একজন ট্যুর অপারেটর হিসেবে কাজ করেই তার সময় কাটে। এক রাত তার বাসায় অবস্থান করার সুবাদে তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমি নিজেও বলতে গেলে তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। বাইবা আমাকে বগ ভ্রমণের পরামর্শ দিলেন, কেননা বাইবা তার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে যেটা দেখেছিলেন যে দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই এমনকি মধ্য কিংবা পূর্ব ইউরোপের অনেক অধিবাসীদের কাছেও এ ‘বগ’ শব্দটি তেমনভাবে পরিচিত নয়।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

নতুন কোনও জিনিসের প্রতি সবসময় আমার আলাদাভাবে আগ্রহ কাজ করে, তাই কোনও কিছু চিন্তা না করে বাইবার পরামর্শমতো তার সাথে পরের দিন বেরিয়ে যাই কেমেরি ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। আমার কাছে বগ ছিলও সত্যি অন্য এক ধরনের অভিজ্ঞতা। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ কেউ যদি নতুন কোনও অভিজ্ঞতা নিতে চান তাহলে আপনি আপনার ভ্রমণ তালিকায় কেমেরি ন্যাশনাল পার্ককে রাখতে পারেন।

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com