রহস্যে ভরা ল্যান্ড ডাইভিং দ্বীপ

‘নিউজিল্যান্ডে বসবাসের সুযোগে আশপাশের প্যাসিফিক আইল্যান্ডের বিভিন্ন দেশে ঘুরতাম। যখনই ছুটি পেতাম তখনই চারদিন থেকে শুরু করে ১২ দিনের জন্য ছোট ছোট দেশে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তাম। শখ ছিল একবার বড় জাহাজে ভ্রমণ করব। টাইটানিক সিনেমা দেখার পর থেকেই আগ্রহ তৈরি হয়। স্বপ্নটা পূরণ করা একটু অসাধ্য ছিল আমার জন্য। কারণ আমি ছিলাম সলো ট্রাভেলার।’
‘কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশি পাসপোর্টে ১১৫ দেশ ঘোরা কাজী আজমেরী আসমা। ‘বড় বড় জাহাজগুলোতে একজনের জন্য কেবিন থাকে না। একদিন সাহস করে ভানুয়াতুতে যাওয়ার জন্য একটি কেবিন বুক করলাম। ভানুয়াতু নিউজিল্যান্ডের একটি চমৎকার আইল্যান্ড। বইয়ে পড়েছি দেশটি সম্পর্কে। দক্ষিণ পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় আশিটি দ্বীপ নিয়ে প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র ভানুয়াতু।’
১৬০৬ সালে দেশটি প্রথম খুঁজে পেয়েছিল এক পর্তুগিজ নাবিক। তবে যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৩০০ বছর আগে দেশটিতে মেলোনেশিয়ানদের জনবসতি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এই মেলোনেশিয়ানদের ১৯৮০ পর্যন্ত ফরাসি ও ব্রিটিশরা স্বাধীন করেছে। সেজন্য সেখানে ফরাসি এবং ইংলিশ ভাষা মিশে রয়েছে দুটো সমন্বয় ‘বিসলিমা’ ভাষা তৈরি হয়েছে।
‘ভানুয়াতুতে যাওয়ার এত আগ্রহের কারণ হচ্ছে সেখানে যেতে আমার বাংলাদেশি পাসপোর্টে ভিসা লাগবে না। অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, নিউ কেলোডোনিয়া, সোলেমান আইল্যান্ড দ্বারা বেষ্টিত। এর চেয়ে চমকপ্রদক ছিল ‘ল্যান্ড ডাইভিং’। যা ছোট্ট করে বলা চলে ‘বাঁশের কেল্লা থেকে লাফ দিয়ে দৌড়ানো’।
এটা এমনই এক আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল যে পৃথিবীর আর কোথাও এ রকম খেলা নেই। এজন্য কখন এই উৎসবটি হয়, সেটা জেনে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ ১১ দিনের জন্য জাহাজ ভ্রমণের জন্য কেবিন বুক করলাম। তারপর নিউজিল্যান্ডের নানা ওয়েবসাইটে আমার কেবিনের কেবিনমেট খুঁজতে লাগলাম। বলছিলেন, খুলনার মেয়ে আসমা।
‘দ্রুত একজন বয়স্ক নারীকে কেবিনমেট হিসেবে পেয়ে গেলাম। তার নাম ছিল ক্রিস্টিনা। তিনিও অনেকদিন ধরে জাহাজে যাবেন যাবেন করছেন কিন্তু কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই যাওয়াও হচ্ছিল না।’
‘ভানুয়াতুর অ্যাডভেঞ্চারাস ট্যুরে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গায় যাব। এটা ভেবেই আনন্দ হচ্ছিল।’ কোনো এক সময় রানী এলিজাবেথ ভানুয়াতুতে এসেছিলেন। তিনি একটি দ্বীপের নাম দিয়েছিলেন মিস্টরিয়াস আইল্যান্ড, এই দ্বীপটি সত্যিই রহস্যে ভরা সৌন্দর্যে। তিনি পেন্টেকোস্ট এসে দেখেছিলেন বাঁশেরকেল্লার লাফ দেয়া দৌড়।
তার আগমন উপলক্ষে বিশেষ উৎসবের আয়োজন হয়। দুঃখের বিষয়- উৎসবে একজন লোক বাঁশেরকেল্লা থেকে পড়ে গিয়ে তার পায়ের গোড়ালি ভেঙে গিয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি মারা যায়। তারপর থেকে শুধুমাত্র শুকনো মৌসুমে তিনটি নির্দিষ্ট দিনে তারা উৎসবটি করে থাকেন। সেই বছর একুশে এপ্রিল এই উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। জাহাজ কোম্পানি সেটাকে মাথায় রেখেই সেই দিনটিতে ভানুয়াতু দ্বীপে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।
‘যথারীতি ১৮ তারিখে জাহাজে উঠলাম। অনেক চমকপ্রদ অ্যাডভেঞ্চারাস আর লাক্সারিয়াস ১৬তলা জাহাজের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য কলম্বাসের বিশ্ব আবিষ্কারের মতো ভানুয়াতু আবিষ্কারে বের হলাম।’
টানা দু’দিন নীল সমুদ্রে জাহাজ ভাসমান থাকার পর একদিন সকাল বেলায় যথারীতি সকল যাত্রীকে নামিয়ে দিলো পেন্টেকোস্ট আইল্যান্ডের জাহাজ ঘাটে। ঘাট থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটার পর দেখতে পেলাম গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে চমৎকার উৎসবের আমেজ।
গ্রামের কয়েকটা বাড়ির উঠানে বাচ্চারা জড়ো হয়ে নাচতে শুরু করেছে গায়ে লতাপাতার জামা-কাপুড় পরে। তারপর আরো কিছুদূর এগিয়ে দেখলাম একটি বিশাল মাঠ। যেখানে চলছে উৎসব। তবে কিছুটা অবাক হয়েছি কারণ ভানুয়াতুর মানুষগুলো অনেকটাই আফ্রিকানদের মতো দেখতে। অন্যান্য প্যাসিফিক আইল্যান্ড থেকে এরা অনেক বেশি কৃষ্ণবর্ণের।
তাদের কোঁকড়ানো কালো চুল ঠিক যেন আফ্রিকানদের মতো। এই মানুষদের ভাষা ফরাসি ও ব্রিটিশদের শাসনের জন্য দুই ভাষার সমন্বয়ে তার সঙ্গে মেলানেশিয়ানদের এই ৩ ধরনের থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিসলামা ভাষা। বিসলামা ভাষা মূলত ইংরেজির সঙ্গে মিক্স করা এবং খুবই মজার। যেমন তারা বলে ‘Gud Moning’ যা ইংরেজিতে ‘Good morning’ আমরা যেমন ইংলিশে বলি ‘thank you’ ওরা বলে ‘Tangkyu’। অনেক মজার এবং সহজেই শেখা যায়।
‘কিছুটা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসলাম ঠিক মাঠের কাছে। যেখানে সমস্ত ট্যুরিস্টরা উৎসব শুরুর অপেক্ষা করছিল আর গ্রামবাসীরা সাজিয়েছিল তাদের উৎসবকে। কিছু কাঁচা ফলও, ভানুয়াতুর ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ‘Laplap’ ও ‘tuluk’ ওরা ফেরি করে বিক্রি করছিল। উৎসবের ছবি তোলার সময় পরিচয় হলো আমেরিকান ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে। তারা গ্রামবাসীদের কাছে জানতে চাচ্ছিল কীভাবে এই বাঁশেরকেল্লায় লাফ দিয়ে দৌড়ানো হয়।’
এই উৎসবের ইতিহাস ছিল এমন। স্বামীর যৌন ইচ্ছা বেশি হওয়ায় স্ত্রীকে সর্বদাই জ্বালাতন করতেন। একদিন এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করছিলেন। স্ত্রী তার স্বামীর থেকে বাঁচতে একটা বটগাছের চূড়ায় উঠেছিলেন এবং গোপনে তার পায়ের গোড়ালির চারদিকে একটি লতা বেঁধে রেখেছিলেন। গাছের উপরে স্ত্রীকে দেখে স্বামী উপরে উঠেছিলেন।
আর স্ত্রী তাকে উপরে উঠতে দেখে নিচে লাফিয়ে পড়লো। স্বামীও তার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তবে স্বামী নিজের গোড়ালিতে লতা বাঁধেনি, ফলে স্বামী বেচারা সাথে সাথেই মারা গেল। এভাবে স্ত্রী তার স্বামীকে ধোঁকা দিয়েছিলেন। সাধারণ নারীরা এই ধোঁকাকে মেনে নিতে পারেনি। তারাও এইভাবে মৃত্যুবরণ করেন, কিন্তু তাতে গ্রাম থেকে লোক সংখ্যা কমে যাচ্ছিল আর নারীরা গাছের উপর থেকে ঝাঁপ দিলে তাদের শরীর বিবস্ত্র হয়ে যেত।
তবে স্বামীরা তাদের স্ত্রীদেরকে এভাবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। তাই নারীদের জন্য খেলাটি নিষিদ্ধ করা হয়। আর পুরুষরা এভাবেই কয়েকশো বছর আগে খেলাটির সূচনা করে।
গাছ থেকে লাফিয়ে পড়াটা ধীরে ধীরে বিশেষভাবে নকশাকৃত কাঠের কেল্লায় পরিবর্তীত হয়েছিল। যা এখন বাঁশের কেল্লায় রূপ নিয়েছে। জীবনে একবার হলেও পেন্টেকোস্টের পুরুষদের এই লাফ দিতে হত।
সাধারণত পরিবারের বড় ছেলে (১৬ বছর) হলে সামর্থ্য অনুযায়ী সৌভাগ্যের প্রমাণ দিতে ল্যান্ড ডাইভিং দিতে হয়। অনুষ্ঠানের দিনে ভোরে পুরুষেরা নাম্বা ও নারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক কোমরে পরে। স্তনের যায়গায় কখনো কখনো যুবতীরা ঘাসের পাতা পরে ঢেকে রাখে।
এছাড়া গ্রামের ১০ থেকে ২০ জন পুরুষ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। যা সত্যিই একটি বিরল ঘটনা। যা আমি আগে কখনোই দেখিনি। এই ঐতিহ্যটি এখন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস করেছে।
এমআরএম/জেআইএম