রামিন’স ফার্ম : সিডনির বুকে একখণ্ড বাংলাদেশ

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৪:৩৫ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

শৈশবের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমি বেড়ে উঠেছিলাম এমন একটি গ্রামে যেখানে বিদ্যুৎ বা টেলিভিশন ছিল না। তাই প্রত্যেকটা দিন ছিল প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। প্রত্যেকদিন সকালে উঠেই বাড়ির বড়দের সঙ্গে ক্ষেতে চলে যেতাম তারপর সারাদিন ক্ষেতে কাটিয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসতাম।

মাটির প্রকার অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেতে বিভিন্ন রকমের সবজি আবাদ করা হত। কোনটাতে উচ্ছে বা পটল বা মরিচ আবার কোনটাতে বাঙ্গি বা তরমুজ বা ধুন্দল। প্রত্যেকটা ক্ষেতই ছিল আলাদাভাবে সুন্দর।

বীজ থেকে ছোট গাছ তারপর একটা সময় ফুল সেখান থেকে ফল। বাংগির ক্ষেতে বাংগি পাকা শুরু করলে অনেক দূর থেকেও সেই ঘ্রাণ পাওয়া যেত। আর পটলের গাছ হত পটলের শাখা থেকে। সেটা হাট থেকে কিনে নিয়ে এসে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে মাটিতে লাগানো হত। এই প্রত্যেকটা ব্যাপারই ছিল আমাদের সাদামাটা শৈশবে উত্তেজনার উপকরণ। আর মাঝেমধ্যে আমি নিজে ক্ষেত পাহারা দেয়া লোকেদের সঙ্গে কুড়ের মধ্যে থাকার বায়না ধরতাম। সেটা ছিল একটা অন্যন্য অভিজ্ঞতা। কুড়ের মধ্যে শুয়ে রূপ কথার গল্প শুনতে শুনতে আর তারা গুণতে গুণতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম। এরপর একসময় শহরতলিতে বসবাস শুরু করলেও সেইসব স্মৃতি মস্তিষ্ক খুব সযতনে তুলে রেখেছিল।

Austrelia5.jpg

তাই যখন নিজে সন্তানের পিতা হলাম তখন স্বাভাবিকভাবেই মাথার মধ্যে এমন একটা চিন্তা কাজ করছিল যে ওদেরকেও আমার শৈশবের কিঞ্চিৎ হলে সেই ছোয়া দিয়ে বড় করবো কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে এই ক্ষেত আমি কোথায় পাব। আমি যে ক্ষেতের সন্ধান করছি এটা আমার পরিচিত সবাই জানত। এমনই একজন পরিচিত মানুষ রামিন ফার্মের সন্ধান দিলেন। গিন্নিকে বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলেন। বললেন ভালোই হবে কিছু তরতাজা শাক সবজি কিনে আনা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন শনিবার সকালে তাহিয়া আর রায়ানকে নিয়ে রামিন’স ফার্মে হাজির হলাম।

তাহিয়া আর রায়ান খোলা জায়গা পেলেই খুশি হয় তার উপর এখানে ভাগ ভাগ করে বিভিন্ন প্লটের মধ্যে বিভিন্ন শস্য দেখে খুশিতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। আমি পরিচিত হলাম রামিন’স ফার্মের স্বত্তাধীকারি হারুন ভাইয়ের সঙ্গে। হারুন ভাইয়ের মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকে ঠিক যেমন বাংলাদেশের কৃষকের মুখে হাসি লেগে থাকে সুখে দুঃখে সারাক্ষণ।

হারুন ভাই বাংলাদেশের টাংগাইলের মানুষ। অস্ট্রেলিয়া এসে ইউনিভার্সিটি অব ওলোংগং থেকে ম্যানেজমেন্টে অনার্স মাস্টার্স করে পেইন্টার হিসেবে কাজ করেন। শখের বসে ২০১৬ সালে তিনি এবং দু’জন বন্ধু মিলে সাড়ে চার একর জমির উপর ফার্মটা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন অস্ট্রেলিয়ার খুবই কম মাটি চাষাবাদের উপযোগী বেশিরভাগ মাটিই পাথুরে।

Austrelia5.jpg

শুরু করার পর একটা বছর তখন পেরিয়ে গেছে কিন্তু লাভের কোনো প্রকার দেখা নেই উল্টো ঘরের থেকে পয়সা খরচ করে ফার্মের দেখাশোনা করতে হয় তাই সংগত কারণেই তার সঙ্গের সবাই ফার্মের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন কিন্তু হারুন ভাই লেগে থাকলেন কারণ তিনি ফার্মের সময়টা খুবই উপভোগ করেন।

তাই ভাবির কষ্ট হলেও হারুন ভাইয়ের এই ব্যাপারটা মেনে নিলেন। অস্ট্রেলিয়াতে সাপ্তাহিক দিনগুলোতে মানুষ এতই ব্যস্ত থাকে যে নিশ্বাস ফেলার সময় থাকে না তাই সবাই সপ্তাহান্তের দিনগুলো পরিবার ও বাচ্চাদের সঙ্গে কাটায় কিন্তু হারুন ভাই সেটা না করে সেই সাত সকালে ক্ষেতে এসে হাজির হোন।

ভাবি দুই বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাওয়া শুরু করলেন তার উপর তখন উনার গর্ভে বেড়ে উঠছে তাদের তৃতীয় সন্তান। তবুও ভাবি দাঁতে দাঁত চেপে হারুন ভাইয়ের সমস্ত পাগলামি মেনে নিয়েছিলেন। হারুন ভাই সেই সকালে অবার্ন থেকে লেপিংটনে ফার্মের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দেন। অবার্ন থেকে লেপিংটনে যেতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করতে হয় তবুও তিনি হার মানার পাত্র নন।

Austrelia5.jpg

ইতোমধ্যেই তিনি পাশে পেয়েছেন আরও কিছু বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী যারা বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন যেমন একবার দেশে তার বাবা অসুস্থ হলে তার বেশ কিছুদিনের জন্য দেশে যেতে হয়েছিল তখন তারা ক্ষেতে পানি দেয়ার কাজটা করে দিয়েছিল।

রামিন’স ফার্মের জায়গাটা আমাদের পরিবারের সবারই খুবই পছন্দ হয়ে গেল আর সেই সঙ্গে হারুন ভাইয়ের মিষ্টি ব্যবহার। সবমিলিয়ে রামিন’স ফার্মে গেলেই আমাদের মনটা ভালো হয়ে যায়। আমি ক্ষেতের প্রত্যেকটা প্লট দেখি আর নিজের শৈশবে হারিয়ে যায়। রামিন’স ফার্মের মাঝ বরাবর একটা পায়ে হাঁটার রাস্তা তার দু’পাশে বিভিন্ন সব্জির প্লট। সেখানে কাচা মরিচ, লাল শাক, পুঁই শাক, কচুর শাক, উচ্ছে, বেগুন, ধুন্দল, চিচিংগা, মিষ্টি কুমড়া, টোম্যাটো, বাংগি আর আছে লাউয়ের মাচা।

লাউয়ের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে কারণ সিডনির প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে তার ক্ষেতের লাউ এখন একটা অবশ্যম্ভাবী সবজি। দু’পাশের ক্ষেত পার হয়ে একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলে সেখানে রয়েছে একটা খাল। সেই খালে সারাবছরই কম বেশি পানি প্রবাহ থাকে। সেই খালেই আমি সিডনিতে প্রথম বারের মতো ক্ষুদে পানা দেখতে পেলাম আর হোগলার বন। সেখান থেকেই সেচের বেশিরভাগ পানির যোগান আসে বলে হারুন ভাই জানালেন।

রামিন’স ফার্মে গেলে সবচেয়ে খুশি হয় রায়ান কারণ সেখানে অবিরত সেচ দেয়ার ফলে মাটি থাকে নরম। সেই নরম মাটিতে হেটে বেড়ানো রায়ানের সবচেয়ে পছন্দের একটি কাজ। একটু পরেই রায়ানের জুতা মাটিতে ভারি হয়ে যায় তখন সেটা খুলে দিলে সে আরো খুশি মনে কাদার মধ্যে হাঁটা শুরু করে।

Austrelia5.jpg

রায়ানের কর্মকাণ্ড দেখে আমি হারুন ভাইকে বলেছি তিনি যেন রায়ানকে উনার ক্ষেতে নিয়োগ দিয়ে দেন। তার বিনিময়ে আমাকে কোট টাকা পয়সা দিতে হবে না শুধু ওকে তিনবেলা খেতে দিলেই হবে তাও অন্ততপক্ষে ওর জ্বালাতন থেকে আমরা রেহাই পাব।

হারুন ভাই বলেন আমার ছোট ছেলেটাও রায়ানের বয়সী নাম রাকিন সেও ঠিক একই রকম দুষ্টু। অবশ্য তার বড় ছেলে যার নাম এই ফার্মের নামকরণ সে কিছুটা শান্ত আর সবার ছোট মেয়ে আইজা বেশ শান্ত স্বভাবের। রামিন, রাকিন সুযোগ পেলেই হারুন ভাইয়ের সাথে ক্ষেতে চলে এসে বাবার সাথে কাজে লেগে পরে।

তাহিয়াও খুশি হয় কারণ সে আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে ক্ষেতে নেমে পরে লাল শাক, পুঁইশাক তুলতে। আমি কেটে দিই আর ও সেটা ওর হাতে ধরা পলিথিনে রাখে। এছাড়াও আমি গ্রামের ছেলে বলে ক্ষেতের মধ্যে আগাছা হিসেবে হওয়া আরো কিছু শাক আবিষ্কার করেছি যেমন বৈথার শাক, নোনতা শাক ইত্যাদি।

রামিন’স ফার্ম নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। শনিবার এলেই তাহিয়া জিজ্ঞেস করতে থাকে আমরা আজ রামিন’স ফার্মে যাব কি না কারণ রামিন’স ফার্ম সাধারণত শনিবার সবার সময়টা খোলা থাকে। আপনিও যদি তরতাজা সবজি একেবারে ক্ষেত থেকে সঠিক দামে পেতে চান তাহলে চলে যান লেপিংটনের রামিন’স ফার্মে।

রামিন’স ফার্মে যেয়ে আমি বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যারা আমাদের মা বাবার বয়সী। তারা এসেই ক্ষেতের মধ্যে বসে পড়েন ধুলো ময়লার পরোয়ানা করে। দৃশ্যটার মধ্যে এমন একটা অকৃত্রিমতা আছে যে আমি আর চোখ ফেরাতে পারি না। তবে রামিন’স ফার্মে গেলে ক্ষেতে ঢোকার আগে হারুন ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে নেয়া ভালো কারণ ক্ষেতের মধ্যে আমি বিছুটি গাছ দেখেছি যেটা আপনার গায়ে লাগলে ভয়ংকর চুলকানি শুরু হবে। আর হারুন ভাই বললেন তিনি একদিন একটা বড় সাপও দেখেছেন।

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]