নির্মমতা কতদূর গেলে জাতি হবে নির্লজ্জ

প্রত্যেক জাতির একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় নানাভাবে। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য তৈরি হয় বেশির ভাগ সময় অনুপ্রেরণার মধ্য দিয়ে। মানবজাতির মধ্যে সবসময় কেউ না কেউ কোনো না কোনোভাবে বিরাট কিছু হয়। গায়ক, নায়ক, কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, রাজনীতিবিদ, সাধক, গুরু, নবী, রাসুল ইত্যাদি।
আমরা সাধারণ মানুষ চেষ্টা করি তাদের অনুসরণ করতে। ভালো মানুষের পাশাপাশি দুষ্টু মানুষেরও জন্ম হয় নানাভাবে, কেউ মনেপ্রাণে তাদের অনুসরণ না করলেও তাদের মত খারাপ বা আরও খারাপ হয়ে থাকি। যদিও আমরা সবসময় ভালো থেকে আরও ভালো হতে চায়। এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়ার কথা কিন্তু না সেটা সব সময় বা সবক্ষেত্রে হয় না।
আমরা ভালো-মন্দ সম্পর্কে জানার পরও খারাপ দিকটার দিকে আকৃষ্ট হয়ে থাকি। কী কী সম্ভাব্য কারণ এর পেছনে জড়িত? আমরা বাঙালি জাতি হিসাবে আমাদের চরিত্রের নানা রূপ রয়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো। তবে যে জিনিসটা আমাকে বেশি কষ্ট দেয় সেটা হলো জাতি হিসাবে আমাদের মন মানসিকতার তেমন উন্নতি হয়নি।
এ বিষয়ে আমার মতামত বিশ্লেষণ করবো। তার আগে সুইডিস জাতির নৈতিকতা এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটু বিশ্লেষণ করি। সুইডিস ভাইকিং জাতি, কঠিন পরিশ্রম করতে শিখেছে, সবাইকে নিয়ে এগ্রি ট্যু ডিজ এগ্রি চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী সত্ত্বেও মোনার্কি মনোভাব জাতির হৃদয়ে বিদ্যমান। সব মিলে বড় মনের মানুষের অধিকারী তারা আমার মতে।
বাঙালি জাতির অতীত কেমন ছিল, শতভাগ বলতে পারব না। তবে তারা অতিথি পরায়ণ ছিল বলা যেতে পারে, তা না হলে ব্রিটিশদের জায়গা দিতো বলে মনে হয় না। সময়ের সঙ্গে বাঙালি জাতি হারাতে শুরু করে ব্যক্তিত্ব সাথে নৈতিকতা। পরে ব্রিটিশের চামচা হয়ে যায়। ব্রিটিশ চলে গেলেও চামচামি রয়ে গেছে বাঙালির মাঝে, সাথে যোগ হয়েছে তেল মারার প্রবণতা আর সৃষ্টি করতে শিখেছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যা আজ জাতির স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
বাঙালির বৈশিষ্ট্য তেল মাথায় তেল দেওয়া, পাম্প-পট্টি মারা, সমাজে বৈষম্য এবং ভেদাভেদ তৈরি করা। অর্থ বা শিক্ষার দাপট দেখানো, সমাজে যারা অল্প পয়সার বিনিময়ে বা কম শিক্ষার যোগ্যতায় কাজ করে, তাদের মানুষ মনে না করা। এ কাজ করতে একদল মানুষের বিবেকে বাঁধা দেয় না। কারণ এরা শুধু নিজেদেরই এলিট বলে দাবি করে।
বাসার কাজের লোকের সঙ্গে বসে খেতে এদের বিবেকে বাঁধা লাগে ইত্যাদি। এ ধরনের মন-মানসিকতায় গড়ে উঠার পেছনে যে জিনিসটা বেশি দায়ী তা হলো অতীতে বাঙালি জাতি নিজেরাই ব্রিটিশদের পাঁয়চারা করা থেকে শুরু করে গোলামি করত। অর্থে ধনী হলেও মন মানসিকতা সেই নিচুই রয়ে গেছে।
কয়েকটি উদাহরণ দিই। পথে কারো সঙ্গে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া লেগেছে কি বলবে? আমারে চেনোস আমি কে? আমার চোদ্দপুরুষ কি করে ইত্যাদি। আরও পরিষ্কার করে বলি, সবাই নিশ্চয় চিনবেন যদি বলি হিরো আলমের নাম। আমি তাকে ফেসবুকসহ মিডিয়াতে নানাভাবে ফলো করি। তাকে নিয়ে ইয়ারকি মসকারা থেকে শুরু করে, হাসি, ঠাট্টা, বিদ্রুপ করতে করতে বেচারা শেষে সমাজের সাধারণ মানুষের মন জয় করে নিয়েছে।
এখন তাকে নিয়ে হাসি তামাশা করলেও হিরো আলম সত্যি সত্যি হিরো আলম হয়ে গেছে। কিছুদিন আগে দেখলাম বাংলাদেশ চলচিত্র তাকে তাদের সংগঠনে ঢুকতে দিতে নারাজ অথচ সেখানে ঢুকতে যে ক্রাইটেরিয়ার প্রয়োজন তার সবই তার মধ্যে রয়েছে। তাহলে কেন তাকে সে সংগঠনে ঢুকতে দিতে বাঁধা? এখনও একজন চাষির ছেলের সঙ্গে যদি কোনো সচিবের মেয়ের প্রেম হয় বা পরে বিয়ে হয় বাংলাদেশ নিশ্চয়ই সেটা গিনেস রেকর্ড বুকে তুলে ধরতে চেষ্টা করবে।
অথচ সুইডেনের রাজকণ্যার বিয়ে হয়েছে তার ব্যক্তিগত ফিটনেস ট্রেনারের সঙ্গে। বাঙালি জাতির জন্য যারা রাষ্ট্রের সেবা দেবে বলে কর্মে ঢুকেছে, তারাই জাতিকে বাড়ির চাকর বানিয়ে শাসন-শোষণ করে দেশ পরিচালনা করছে। আবার যে জনগণের ভোটে মন্ত্রী, এমপি হয় সেই জনগণকেই তারা মানুষ বলে মনে করে না।
যারা সম্মানিত হতে সাহায্য করলো, তাদেরই এরা অসম্মান করে! এর নাম বাংলাদেশ। এই মানসিকতা যতদিন জাতির মন থেকে বিলীন না হবে ততদিন বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করা সম্ভব হবে না।
আমার কাছে অবাক লাগে, যে দেশে ৮৫ শতাংম মানুষ ইসলামী জীবনব্যবস্থায় বিশ্বাসী, যার মূলমন্ত্র হলো মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না, কিন্তু কি অবস্থা আমাদের? দেশে সত্যিকারে ইসলামের বেস্ট প্র্যাক্টিস আছে কি? আমি সমস্যাটি তুলে ধরলাম বটে তবে আমি নিজেই সেই বাঙালি জাতির একজন।
কারণ অন্যায় করে লজ্জিত না হওয়াটাও কিন্তু আরেক অন্যায়। অপ্রিয় সত্যকে তুলে ধরলাম জানি সত্য তারপরও ভুলে গেলে চলবে না, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তবে ঘৃণা তারে যেস তৃণসম দহে’।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/এএসএম