আসুন পর্যটকদের বরণ করে নিই
ভ্রমণ করতে পছন্দ করে না এমন মানুষের সঙ্গে আজও দেখা হয়নি। ছোটবড় সবাই ঘোরাঘুরি পছন্দ করে। ছোটবেলা যখন নৌকায় করে নদীপথে নানা বাড়ি যেতাম। সারাদিন লেগে যেতো। তবুও ক্লান্তি অনুভব করিনি কখনো। কারণ নৌকা ভ্রমণে নানা বাড়ি যাওয়ার আনন্দ দূর করতো সব ক্লান্তি।
বাড়ি থেকে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলেই আনন্দে আটখানা হয়ে পড়তাম। এখনো দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করা, নতুন নতুন শহর, প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা, উপভোগ করার মাঝে রয়েছে এক মনোমুগ্ধকর অনুভূতি, যা শুধু হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। ভ্রমণের বর্ণনায় সব সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েকটি বিষয়ের ওপর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে কি করণীয় হতে পারে তার ওপর কিছু তথ্য তুলে ধরবো।
ভ্রমণে সবসময় পরিবেশ বা পরিস্থিতি মনপূত হয় না, তা সত্ত্বেও ভ্রমণের সময়টুকু সবাই চেষ্টা করে ম্যানেজ করে চলতে। যারা নিয়মিত দেশ-বিদেশ ঘোরাঘুরি করে তাদের জিজ্ঞেস করলে বলবে, সব ভ্রমণ সব সময় সমপরিমাণ বিনোদন দেয় না। এতে বেদনা ও আনন্দ দুটোই থাকে। যেমন অনেক সময় দেখা যায় প্লেনের ভ্রমণ ভালো হয় না, কারণ ছিটে জায়গা কম বা ভালো সেবার অভাব।
কখনো হোটেলের সার্ভিস ভালো হয় না যেমন নোংরা টয়লেট, আবার রেস্টুরেন্টের খাবার ও সার্ভিস ইচ্ছেমতো হয় না। কখনও সাগরের আশপাশের পরিবেশ বা সমুদ্র-সৈকতের পরিবেশ পছন্দমতো হয় না ইত্যাদি। আবার ভ্রমণ হতে পারে একাকী, স্বামী-স্ত্রী বা একটি পুরো পরিবার মিলে। তবে ভ্রমণে যাওয়ার আগে কোথায় ভ্রমণ কেন ভ্রমণ এ বিষয়ের ওপর সবার মতামত ও একটি বাজেট নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
সবাই যেন ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ ভ্রমণে একটি বিষয় সচরাচর ঘটে তাহলো নিজেদের মাঝে মনোমালিন্য। পশ্চিমা দেশগুলোতে ডিভোর্স পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে বা হয়ে থাকে। যদি আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের অভাব হয় ভ্রমণকালীন। হোটেলে থাকার সময় ভালো সেবা পেতে হোটেলের কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে।
অনেকে হোটেল থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হয়তো বকশিস বা টিপস দেয়, ভালো সার্ভিসের কারণে। হোটেলে ঢুকেই প্রথম দিন টিপস দেই যেন তারা ভালো সেবা দেয় প্রথম থেকেই। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বিশেষ করে ইউরোপে যে রেস্টুরেন্টে লোকাল লোকজন বেশি যায় সেখানে খাবার ও সার্ভিস ভালো হয়ে থাকে। এশিয়ায় বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার স্ট্রিটফুড সবসময় সুস্বাদু। দামও কম হয়ে থাকে।
ওয়েস্ট ইউরোপ ও আমেরিকায় কোনো কিছু ভালো না হলে অভিযোগ করা যেমন সহজ তেমনটি সহজ নয় মধ্যপ্রাচ্য বা ইস্ট ইউরোপে। কারণ আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইউরোপে ক্রেতার প্রাধান্য সবসময় বেশি দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে তুরস্কে অভিযোগ করে তেমন ভালো ফল পাওয়া দুষ্কর। এদের উগ্র মেজাজ ও দুর্ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়। ভালো সেবা না পেলে সেখানে দ্বিতীয়বার না যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করি। ইদানীং ইউরোপের হোটেলে সিটি ট্যাক্স নেওয়া শুরু হয়েছে যা চেক আউটের দিন পে করতে হয়।
একটি উদাহরণ দিই, গত বছর সামারে বুকিং দিয়েছিলাম সেন্ট্রাল প্যারিসে একটি ফোর স্টার হোটেল যা পঞ্চাশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট অফার করেছে। হোটেলের ছবি, লোকেশন ও ডিল সব মিলে ভালোই মনে হয়েছে তাই বুকিং দিয়েছি। হোটেলে ঢুকে দেখি কিছুই মনপূত নয়, পয়সা দিয়েছি আগে বিধায় তা আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
দুদিন থেকেছি, প্রতিদিনই সকালে নক করে ঘুম থেকে আমাদের তুলেছে তাড়াতাড়ি রুম পরিষ্কার করার জন্য। শেষের দিনও একই কাজ করেছে, যদিও আমাদের চেক আউটের সময় দুপুর বারোটা। আমার বেশ মেজাজ খারাপ হয়েছে বারবার বিরক্ত করার কারণে। ক্লিনারদের রিসিপশন ডেস্ক থেকে চেক করার কথা রুমে গেস্ট আছে কি-না! তা না করে, বারবার নক করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে যা ছিল খুবই বিরক্তিকর।
বিষয়টি ম্যানেজারকে জানাতেই দুঃখিত বললো। পরে চেক আউটের সময় সিটি ট্যাক্স হাতে ধরিয়ে দিতেই রাগ করে বললাম তোমার শহরের মেয়রকে শুভেচ্ছা দিও যে তার সিটিতে গেস্ট নিরিবিলি ঘুমাতে পারেনি, হোটেলের ক্লিনারের বারবার দরজায় নক করার কারণে। সেজন্য গেস্ট সিটি ট্যাক্স পে না করে সুইডেনে চলে গেছে। এ কথা বলার পর হোটেল ম্যানেজারের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, তৎক্ষণাৎ বলল যে আমাকে সিটি ট্যাক্স দিতে হবে না।
আমেরিকায় যদি এমন ঘটনা ঘটে কাস্টমার তার ন্যায় বিচার পেয়ে থাকে, কিন্তু ইস্ট ইউরোপে এ ধরনের সেবা পাওয়া কঠিন। আমি মনে করি ভালো ব্যবহার, ভালো সেবা সবসময় দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি করে। সেক্ষেত্রে সব দেশের উচিৎ পর্যটকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা ও তাদের ভালো সার্ভিস দেওয়া। ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছুই জানা সম্ভব তাই এর সাহায্যে একটু রিসার্চ করে অনেক বিষয়ে ভ্রমণের আগে অবগত হওয়া ভালো।
যেমন অনেক সময় লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে ইন্টারনেটে টিকিট কেনা যেতে পারে যা কিছুটা সস্তাও বটে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার তা হলো ছোটদের হাতে সিটি ম্যাপ তুলে দেওয়া। তাদের ট্যুর গাইডের দায়িত্ব দেওয়া। এতে করে ছোটরা ভ্রমণের সঙ্গে সম্পৃক্তি লাভ করে ও কাজের উপর দায়িত্ববান হতে শেখে।
যদি লন্ডনের আন্ডার গ্রাউন্ডে পুরো পরিবারকে গাইড দিয়ে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে নেওয়ার দায়িত্ব তারা পায় এবং যদি সত্যি সত্যি ম্যানেজ করতে পারে তবে বলতে হবে ‘wow what a great success!’ একই সঙ্গে হতে পারে সিটি ম্যাপ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ যা প্রশিক্ষণের এক বিরল নিদর্শন।
ভ্রমণে শুধু বিনোদন নয় রয়েছে শিক্ষা, জানা, শোনা, শেখা ও দেখার সুযোগ। ভ্রমণে মানসিক চিন্তাশক্তির বৃদ্ধি ঘটে। মন মানসিকতা বড় হয়। অন্যান্য মানুষের সাংস্কৃতিক, রীতিনীতি সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়।
দেশে শুরু হয়েছে ফাগুন মাস। মনে পড়ছে ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’- পুরো দেশ ভরা পরম করুনাময়ের রহমত (আল- কাওসার) তা সত্ত্বেও পর্যটকদের হৃদয়ে জায়গা করা সম্ভব হচ্ছে না কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? সম্ভব্য কারণ গুলো যেমন, আমাদের পর্যটন স্পটগুলোতে হকার, টোকাইদের হয়রানি, খাবার, আবাসিক খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি, কোনো কোনো সময় প্রতারণাও শিকার হন পর্যটকরা।
পর্যটন এলাকার পরিবহন খরচও মাত্রারিক্ত রাখা হয়। বিদেশি দেখলে তো আর কথাই থাকে না। নিরাপত্তার সংকটতো আছেই। সর্বোপরি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। কারণ দেখুন কেউ এখন ইউক্রেনে যেতে রাজি হচ্ছে না বরং সেখান থেকে সবাই পালাতে উঠে পড়ে লেগেছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে এতটুকু বলব ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা শিখতে হবে, তাদের নিরাপত্তা দিকে হবে, সেখানে পর্যটকদের আনা-গোনা সেখানে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
মনে রাখতে হবে পর্যটন থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ অর্থনীতিতে যেভাবে উপকৃত হচ্ছে, তার শত ভাগের এক ভাগ যদি আমরা ম্যানেজ করতে পারি তাহলে বিষয়টি বুজতে সহজ হবে পর্যটোকের গুরুত্ব কী। বাংলাদেশ তার সুন্দর ব্যবহার ও নিরাপত্তার মাধ্যমে বিশ্বের পর্যটকদের বিলাসিতা নিশ্চিত করতে পারে। যেসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে আমাদের দেশে তা সত্যিই উপভোগ করার মতো।
কিন্তু তা উপভোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দেশের অস্থিতিশীলতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সর্বোপরি নোংরা পরিবেশের জন্য দায়ী। আমি আশা করি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়গুলোর ওপর কড়া নজর দেবেন দ্রুত। বিশ্বের পর্যটকদের নতুন করে বরণ করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বের নানা দেশ ঘুরছে বা ঘুরতে শুরু করেছে তাই মনে হলো শেয়ার করি আমার কিছু অভিজ্ঞতা। সেই সাথে কামনা করি ভ্রমণের দিনগুলো আনন্দের হোক সবার জন্য।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
[email protected]
এমআরএম/জেআইএম