কিযীর আছে এবং নাই

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০১:১৮ পিএম, ২৭ আগস্ট ২০২২

বইটির ফ্ল্যাপে লেখা আছে- ‘আছে আর নাই দুজন। তারা, মানুষ। তারা চরিত্র। তারা নিজ দোষগুণে ভরপুর দুই সত্তা। আছে আর নাই গল্প করে যায়, যখন তাদের দেখা হয়।’ এই গল্পগুলোর সমাবেশই এই বইটির বিষয়বস্তু।

তারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করে। আকাশ দেখার গল্প, বসন্তের হাওয়াই মিঠাই গল্প, সময়কে পড়তে না পারার গল্প, পোস্ট উৎসব সিনড্রোমের কথোপকথন এমন আরো অনেক বিষয় উঠে আসে তাদের গল্পে।

লেখক বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘আছে-নাই আমার জীবনজুড়ে। তাদের আমি হাসতে দেখি, দেখতে দেখি, বলতে দেখি, শুনতে দেখি, কাঁদতেও দেখি। আমার জীবনজুড়ে আছে আর নাই। কার জীবনে নেই? আমাদের সবারই তো জীবন ভরে থাকে- আছে আর নাই।’

বাস্তব জীবনেও দেখা মিলে আছে এবং নাই এর। এরা আসলে একজনকে ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ। আছে এবং নাই তাই আমাদের জীবনে চলে সমান্তরালে। একজন কখনও অন্যজনের ওপর প্রভাব বিস্তার না করে শুধুমাত্র চলার জন্যই তারা চলে কিন্তু তারা এটাও জানে যে তাদের একজনকে ছাড়া অন্যজনের চলবে না।

জীবন চলার পথে সামাজিকতার দায়ে বা রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতির দায়ে অনেক কিছুই করি। কিন্তু আমাদের অবচেতন মন একটু নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। একটু অনিয়ম হোক, একটু একান্তই নিজের ইচ্ছেই কোন কাজ হোক, অন্য লোকে কি ভাবলো সেটা বিবেচনায় না এনে নিজের মতো করে বাঁচতে চায় মানব মনের সেই অংশটা।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, ‘মানব মনের প্রায় ৯০ শতাংশই অবচেতন বাকি কেবল ১০ শতাংশ চেতন অবস্থায় থাকে। চেতন মনে জাগ্রত অবস্থায় মানুষ পারিপার্শ্বিক জগতের সঙ্গে সংযোগ রাখে। অবচেতন মনে সংযোগ রাখে অন্তরজগতের সাথে। অবচেতন মন যদিও আমাদের জাগ্রত চেতনার বাইরে তথাপিও কিছু প্রচেষ্টার বিনিময়ে একে আমাদের চেতন মনে আনা যায়।’

এই বইয়ে আছে এবং নেই এর বিশদ পরিচয় নেই। তবে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারা যায় আছে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আর নেই একজন শিশু। আছের কাছে যে কাজগুলোকে অনর্থক মনে হয় নেই’র কাছে সেই কাজগুলোই যেন খুবই সাধারণ। আছে’র মাথায় এমন অনেক প্রশ্নই আসে যেগুলোর উত্তর তার জানা কিন্তু সেই একই প্রশ্নের ভিন্ন উত্তর আছে নেই’র কাছে।

এভাবেই চরিত্রের বৈপরীত্য নিয়ে এগিয়েছে গল্পগুলো। আছে এবং নেই হয়ে উঠেছে একে অপরের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী এবং পরিপূরক। আছের আছে একটা পরিপাটি জীবন। সেই জীবনে আছে কর্ম, আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুবান্ধব। অন্যদিকে নেই’র জীবন অগোছালো। সে চলে নিজের মর্জি মাফিক। অবশ্য তারও বিভিন্ন বয়সী বন্ধু বান্ধব আছে কিন্তু তারাও তার মতোই নিজের খেয়াল খুশি মতোই চলে।

নেই আমাদের সাধারণ বিচারে অকারণে অনেক কাজই করে। জামার ছেঁড়া বোতাম ঘরের বের হয়ে থাকা সাদা সুতো ধরে টানতে থাকে। আবার কখনওবা জামার কলার ধরে টানতে থাকে। তার পা যেন বালুর পা। তার আছে দাঁতে পোকা, মাথায় উকুন। সে সবসময় ঘাসের ডগা মুখে অর্ধেক ঝুলিয়ে ঠোঁটের সঙ্গে চেপে ধরে রাখে। আছেও কি এমন একটা অনাড়ম্বর জীবন মনে মনে কল্পনা করে?

আছে এবং নেই এর গল্প বলতে গিয়েও লেখক তার জীবন সম্মন্ধে তার সূক্ষ্ম অনুধাবন গুলো তুলে ধরেছেন নিজস্ব উপমায়। আছের মতে বসন্ত হলো এক হাওয়াই মিঠাই, রং মাখানো মিষ্টি মিষ্টি চিটচিটে মুহূর্ত, যে মুহূর্ত শুদ্ধ এক বিস্ময় তৈরি করে, যে মুহূর্তে বিস্ময়ের কোনো তথাকথিত চিহ্ন থাকে না। জীবন সম্মন্ধে আছে আরেক জায়গায় বলেছেন, আমরা আসলেই কেউই সময় পড়তে পারি না।

আমরা ঘড়ি দেখে সময়ের হিসাব অনুমান করি মাত্র। কিন্তু সময়কে বুঝতে পারি না। ছুঁতে পারি না। আর পারি না বলেই জীবন এত আকর্ষণীয়, বেঁচে থাকার ভাবনা এত রোমাঞ্চকর। আছে'র ভাষায় বৃষ্টি শেষে ঘাসগুলো কেমন যেন কান্না শেষের ক্লান্ত মুখের মতো ভেজা ভেজা হয়ে আছে।

আছে’র মতে শহরে শীতের আগমন বড্ড অপেক্ষা করায়। বিকেল শেষের শহরকে মনে হয় কুয়াশার শামিয়ানায় ঢাকা এক মঞ্চ। এক্ষুনি ঢোল মাদল বাজিয়ে শীত তার আসর শুরু করবে। আয়োজন শেষ, মঞ্চ তৈরি কিন্তু আসর আর শুরু হয় না। আছে’র মতে সমুদ্রের বালুকাবেলার অস্তগামী সূর্য যেন গলে পড়া কুসুম।

জীবন নিয়ে নেই’র সোজাসাপ্টা জবাব, উল্টা পথে হাঁটলেই তো ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু আছে’র মতে, ফিরে যাওয়ার পথটুকু যখন হারিয়ে যায়, তখনই মানুষ বড় হয়ে যায়। আছে’র প্রশ্ন জেনে গেলেই কি সব অনাকর্ষণীয় হয়ে যায়, শুদ্ধতা কি অনাকর্ষণীয়?

আছে জানে নাই অন্যদের মতো না। সে বিশ্বাস করে নাই ভালো-মন্দ বোঝে। নাই’র কাছ থেকে তো আছে প্রতি মুহূর্তে কত কিছু শিখে ফেলে। আছে কাছে নাই শুদ্ধ এবং ঝকমকে। আর তারা দুজন দুরকম বলেই হয়তো একজন অন্যজনকে খুঁজে বেড়ায়। খুঁজে নেয়। আছে’র জীবনে নাই এমনি আসে এমনি যায়। যখন আসে ছাপ ফেলে যায়। রঙের ছাপ, সুগন্ধের মৌ মৌ ছাপ, যেন এক ছোপ জফরানি রং। যার সুগন্ধ আছে, রংও আছে।

লেখকের মতে- ‘আছে-নাই' মিলে আমরা আমাদের অনুভূতির হিসাবনিকাশ শেষে নিজেদের কাছে ফিরে আসি। সেই হিসাবনিকাশে শব্দ বা অংকের প্রয়োজন পড়ে না। ‘আছে-নাই’ এর উপস্থিতিই যথেষ্ট। বইটি নিয়ে সৈয়দ মনজুরুল স্যারের কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করি- ‘আছে নাই শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রত্যেকের গল্প, প্রতিদিনের গল্প। প্রচলিত চিন্তা আর ফর্মের বাইরে গিয়ে লেখা এ বইটি আমি নিশ্চিত, অনেকবার পড়ার জন্য।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]