‘শাঁখের করাত’

আমার বাবা অসুস্থ, অথচ সে ব্যস্ত সম্পত্তি নিয়ে

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
প্রকাশিত: ০২:২১ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

আমি খুবই দুঃখিত, আপনার জন্য খারাপ লাগছে। ওই দিকে আপনার স্ত্রীও তো মানসিকভাবে অসুস্থ। তার এমন এক সমস্যা যে পুরোপুরি ভালো হওয়া কঠিন।

জ্বি, আমার বাইরে বাইরে থাকা বেড়ে গেলো। অফিস শেষে গুলশান ক্লাবে পড়ে থাকি। একদিন এত বেশি ড্রিংক করে ফেললাম যে রাতে বাসায় ফিরতে পারিনি, ওখানেই ঘুমিয়ে গেছি। এটা নিয়ে রিমি অনেক হট্টগোল করলো। অনেক কিছুই বাড়িয়ে বললো।

বিজ্ঞাপন

এমনিতে; অন্তঃসত্ত্বার জন্য সে তখন বাসাতেই থাকতো ছুটিতে।

এই ঘটনার দুইদিন পর আমার আব্বা-আম্মা আমাকে তাদের ঘরে ডেকে পাঠালেন। বোঝালেন এগুলো ঠিক হচ্ছে না। কয়দিন পর বাচ্চা হবে। আমি যেন রিমিকে বোঝায়। নিজেও সংসারে মন দেই ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

রিমিকে আর কি বোঝাবো! কিছুই বুঝতে চায় না। আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম, চিকিৎসক দেখলাম। আরও কিছু ওষুধ যোগ হলো জীবনে।

কয়মাস পর আমার ছেলে হলো, বাসায় সবাই খুবই খুশি। এই কয়দিন রিমি ঠিক ছিল, ব্যস্ত ছিল নিজের শরীর নিয়ে। এবার শুরু হলো তুলনা। তার ছেলে হয়েছে, কে কি উপহার দিলো, আমার ভাইয়ের মেয়েকে বেশি দামি উপহার দিয়েছে সবাই! আমার ছেলেকে নাকি কম এসব নিয়ে শেষ না হওয়া বিরক্তিকর কিছু কাহিনি।

এর মাঝেই আমার অস্ট্রেলিয়ার ভাইভা, ভিসা হয়ে গেলো। আমি চলে আসবো রিমি আসতে দেবে না, সেও আসবে। এত ছোট বাচ্চা নিয়ে কীভাবে কি করবে, তাই আমি বললাম তুমি থাকো, আমি গিয়ে একটু গুছিয়ে নেই তারপরে তোমরা আসো।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আমি চলে আসার আগে আমার আম্মা স্ট্রোক করলো, আব্বার কিডনির সমস্যা বাড়লো। সব মিলিয়ে আমার এবং
ভাই-বোনের সবার মন খারাপ।

ছোট ভাইকে সব বুঝিয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এলাম। এখানে এসে ছয়মাস অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। একটা সাধারণ কাজ করতাম তখন। আমার অনেকদিনের অভিজ্ঞতা থাকার পরে অনেকগুলো কাজের আবেদন করে ছয়মাস পর একটা সরকারি চাকরি পেয়ে যাই।

আরও ছয়মাস পর দেশে গিয়ে আব্বা-আম্মাকে দেখে, রিমি আর আমার ছেলে রেশাদকে নিয়ে আসি। এই এক বছরে আমি রিমির কথামতো তাকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছি কারণ সে রেশাদের জন্য আর কাজে যোগদান করেনি সুতরাং তার হাত খরচ এবং রেশাদের খরচ বাবদ।

বিজ্ঞাপন

সে বেশিরভাগ সময় তার মায়ের বাসাতেই থাকতো এবং তার ছেলে সন্তান হওয়াতে সে খুবই অহংকার করা শুরু করলো। প্রায়শই কথা শোনাতো ছোট ভাইয়ের বউ তিশাকে। এগুলো নিয়ে আম্মার বেশ মন খারাপ।

আমি রিমিকে বোঝালাম, এই জামানায় ছেলে বা মেয়ের তফাৎ কি? আর তিশার তো কেবল একটা বাচ্চা, পরে তো আরো বাচ্চা হতে পারে, তখন ছেলে হলে তুমি কি করবে? এগুলো কেন বলো?

রিমি তাও বলবে!

বিজ্ঞাপন

যাই হোক, আমরা সবাই অস্ট্রেলিয়া এলাম। আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব আছে এখানে, যারা শুরু থেকেই অনেক সহযোগিতা করেছে আমাকে। রিমি আসার পরেও অনেক সাহায্য করলো।

দুই তিন মাস গেলো। এবার আমার ছেলের চেইন হারিয়ে গেলো। আমার আম্মা দিয়েছিল রেশাদকে জন্মের পর। রিমি বলে কোথায় যে রাখছে খুঁজে পায় না। এনেছে না দেশে রেখে এসেছে আমিতো তাও জানি না।

ঠিক ওই সময় দেশ থেকে খবর এলো, আব্বার শরীর বেশ খারাপ, দিনে দুইবার ডায়ালাইসিস লাগছে। এখন রিমির মাথা খারাপ হয়ে গেলো আমার আব্বার সম্পত্তি নিয়ে, আব্বা মরে গেলে আমি কি কি পাবো। রেশাদ কি কি পাবে ইত্যাদি কথা সারাক্ষণ!

বিজ্ঞাপন

আমার আব্বা অসুস্থ, সেটা নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকি, কিন্তু আমি বাসায় ফিরে দেখি রিমি তার বোনকে ফোন দিয়ে আমার ভাই-বোন বলে সব সম্পত্তি নিয়ে নেবে। সে কীভাবে আমার ভাগ উদ্ধার করবে, সেই চিন্তায় মহাব্যস্ত।

বলেন কেমন লাগে?

জ্বি দুঃখজনক, আসলে ছোটবেলায় মানুষের বেড়ে ওঠার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব গঠনে যে প্রভাব ফেলে তা পরে খুব একটা বদলায় না। বিয়ে আসলেই মানুষের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।

বিজ্ঞাপন

এই সিদ্ধান্ত কখনোই হুট করে বা কারো প্ররোচনায় নেওয়া ঠিক না। ভয়ঙ্কর ঝগড়া হয়ে গেলো রিমির সঙ্গে। বললাম তুমি কি আমাকে বিয়ে করছো নাকি আমার আর আমার বাবার টাকাকে?

সারাক্ষণ এগুলো ভালো লাগে না। সেও অনেক কথা বললো, এরপর সে এতিম বলে আমার সঙ্গে আছে বলে কান্না শুরু করে দিলো।

ওদিকে আব্বা আইসিইউতে। আমার মনে হলো আমি নিজেই তো যে কোনো দিন এতিম হয়ে যাবো এমনকি আমার ছেলেও এতিম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।

শরীর খারাপ লাগে, চিকিৎসকের কাছে যাই, আরও কিছু ওষুধ যোগ হয় জীবনে। এটা নাকি কোনো জীবন! আপনার ওয়াইফ যেমনভাবে কথা বলেন তাতে তাকে ব্যস্ত রাখা আপনার জন্য ভালো, তার জন্যও ভালো। আপনি তাকে কোনো কোর্স বা চাকরি করতে বলতে পারেন, এখন তো আপনার ছেলে একটু বড় হয়েছে।

জ্বি, আমি অনেকবার বলেছি, সে নাকি সময় পায় না বাচ্চা সামলিয়ে, রান্না করে কোনো কোর্স করার। দুই বছর হয়ে গেছে এখানে আসার। এখন আবার এগুলোর সঙ্গে অন্য উপসর্গ শুরু হয়েছে।

সেটা কেমন?

আমার বন্ধুদের বাসায় মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে দাওয়াত থাকে, তো আমরা সবাই মিলেই যাই। বাসায় আসার পরে শুরু হয়। যদি বন্ধুর বাসায় ৫০ ইঞ্চি টিভি থাকে তাহলে আমার ৬০ ইঞ্চি টিভি কিনতে হবে। যদি তাদের টু ডোরের ফ্রিজ থাকে তাহলে আমার থ্রি বা ফোর ডোরের ফ্রিজ কিনতে হবে।

কিনলেই হবে না, ফেসবুকে নানান কায়দায় সেগুলোর ছবি দেবে রিমি এবং বন্ধুদের দাওয়াত দিতে হবে। এরপর দাওয়াত দিয়ে রিমি তেমন কিছু রান্না করবে না। একটা বা দুইটা ডিশ রাঁধবে, সেটাও ঠিকমতো সার্ভ করবে না, উল্টো আমার রান্না করতে হয় নয়তো খাবার কিনতে হয়। পরিবেশন করতে হয়, মেহমান আসলে সঙ্গে সে মেহমানদের মতো বসে নতুন যা কেনা হয়েছে সেটার গল্প করে!

আমি জানি আমার বন্ধুর বউ, ভাবিরা মুখ টিপে হাসে, কিন্তু আমাকে কেউ কিছুই বলেন না।

ইদানীং বায়না ধরছে আমার দোতালা বাড়ি কিনতে হবে। কারণ আমার একটা ফ্রেন্ড কিনেছে। কিন্তু তারা তো অনেক আগে এসেছে, দু’জনেই জব করে এগুলো রিমি বুঝতেই চায় না। এখন লাগছে আব্বা তো অসুস্থ, আমার সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে বাংলাদেশ থেকে টাকা এনে যেনো বাড়ি কিনি।

কেমন লাগে বলেন?

আব্বা তো অসুস্থ হলেও জীবিত।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইফতি, এরপর বললো আমি হাঁপিয়ে উঠেছি, আর পারছি না। আমার আব্বা হাসপাতালে, আম্মা অসুস্থ,
ফোন করে কান্নাকাটি করে দেশে তাদের সবকিছুই আমার ছোটভাই আর তিশা দেখভাল করে।

আর আমি এখানে একজন এতিম মেয়ে নিয়ে আছি। এখন আমার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। রেশাদের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকতে চেষ্টা করি। পারছি না। মাথা গরম হয়ে যায়।

ভয় পাই রেশাদ না আবার রিমির মতো হয়। রিমিই তো বড় করছে, আমি তো দিনের বেশিরভাগ সময় কাজেই থাকি।
আমি বুঝি বাচ্চা নেওয়াটা চরম ভুল হয়েছে। কিন্তু কিছুই আমার আয়ত্তে ছিল না।

এখন আপনি বলুন, আমি কি করব?

হুম, সমস্যা জটিল...

আচ্ছা আপনি আসলে কী চান?

রিমির সঙ্গে সংসার করতে চান নাকি চান না?

আপনার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সমাধান।

ইফতি চুপ করে আছে,

আপনি চাইলে আমরা পরের সেশনে এটা নিয়ে কথা বলতে পারি, আপনি সময় নিয়ে চিন্তা করে তারপর জানান।

আচ্ছা, আমি আগামী সপ্তাহে আসি তাহলে।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, বলে ইফতি উঠে চলে গেলেন।

পারিজাত রহমান নিজেও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

মানুষের জীবনে কতরকমের সমস্যা...

এক সপ্তাহ পর একই দিনে, একই সময়ে ইফতি এলেন।

কেমন গেলো আপনার সপ্তাহ?

জ্বি, ভালো না।

আব্বার অবস্থা আরো খারাপ।

রিমি সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মহাচিন্তিত।

আমি চিন্তিত আব্বা আম্মা আর রেশাদকে নিয়ে..

আচ্ছা আমার জীবনটা এমন হলো কেন?

আমি তো কারো ক্ষতি করিনি

ঈশিতা কিছু না বলে চলে গেলো।

রিমি এসে জুড়ে বসে জীবন ছারখার করে দিলো।

দুঃখজনক, আপনার কি কখনো নিজের ক্ষতি করতে ইচ্ছে করে?

আরও ক্ষতি! কিছু বাকি আছে?

আপনি কি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন আপনি কি চান এখন?

আমি খুবই সিদ্ধান্তহীনতায় আছি, তবে কিছুতেই এই জীবন চাই না, শান্তি চাই।

আপনি একটা সাদা কাগজে, বা নোটপ্যাডে বা ই-মেইলে লিখবেন আপনি আসলে রিমির কাছে থেকে কি চান আর কি একেবারেই চান না। এরপর লেখাটা দুই থেকে তিনবার পড়বেন। লেখার কোথাও সমস্যা বা ভুল আছে মনে হলে কারেকশন করবেন।

এরপর একটা সময়সীমা উল্লেখ করে (যেমন দুইমাস বা তিনমাস বা ছয়মাস) তাকে পাঠাবেন। বলবেন এই সময়ের মধ্যে আপনি চাচ্ছেন এগুলো ফিক্স করতে। তাকেও বলবেন লিখে উত্তর দিতে, এতে তিনিও বুঝবেন যে আপনি বিষয়গুলো নিয়ে সিরিয়াস।

এরপরেও যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে আপনি যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

জ্বি, আচ্ছা...

আমি আজই লিখবো, কালকেই তাকে দেবো। সে ঠিক হলে ভালো, নয়তো এটাই শেষ। আমি আর তার সঙ্গে নেই, যদিও ক্লাস নিয়ে কথা বলা ঠিক না, কিন্তু রিমির ক্লাসের সঙ্গে আমি নিজেকে আর অ্যাডজাস্ট করতে পারছি না, মনের ওপরে প্রতিনিয়ত চাপ অনুভব করি।

আপনাকে ধন্যবাদ।

আচ্ছা, আপনার স্ত্রী কি আমার এখানে আসবেন?

কখনো না, দেশেই তো নিতে পারিনি।

আপনার কি এখন অন্য কাউকে ভালো লাগে বা কারো সঙ্গে সম্পর্ক আছে?

থাকলে তো খুবই ভালো হতো, আমি বেঁচে যেতাম তাহলে, আমার স্ট্রেস রিলিফের একটা জায়গা থাকতো।

কেন যে নাই...

সত্যি শূন্য লাগে, মনের কথা শোনার কেউ নেই।

আচ্ছা, আজ আসি, প্রয়োজন পড়লে আবার আসবো, দোয়া করেন আমি যেন মনের মতো কাউকে খুঁজে পাই।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে অনেক সময় নিয়ে আমার এত কথা শোনার জন্য। আমার কাউকে না কাউকে বলা প্রয়োজন ছিল।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

আপনাকেও ধন্যবাদ।

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com