হিরো আলমের উত্থানে দায় কার?

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৯:২১ এএম, ০১ এপ্রিল ২০২৩
ছবি: সংগৃহীত

হিরো আলম এখন এক আলোচিত নাম। যার পুরো নাম আশরাফুল আলম। তার মায়ের নাম আশরাফুন বেগম। আলম তার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেন। বাড়ি বগুড়া জেলার ইরুলিয়া ইউনিয়নে। বাবা পেশায় ছিলেন চানাচুর বিক্রেতা। সেই আয় দিয়ে ভালোই চলে যাচ্ছিল তিনজনের সংসার। এরপর আব্দুর রাজ্জাক দ্বিতীয় বিবাহ করেন যখন আলমের বয়স দশ বছর।

এরপর একদিন ঝড়বৃষ্টির দিনে গভীর রাতে আলম এবং তার মাকে বাসা থেকে বের করে দেন তারই বাবা। এরপরের পুরো গল্পটাই সংগ্রামের। অভাবের কারণে আলমের পড়াশোনা বেশিদূর এগোয়নি। সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া হয়নি তার।

এরপর কুড়িয়ে পাওয়া একটা সোনার দুল মাত্র আটশ টাকায় বিক্রি করে আলমও শুরু করেন চানাচুরের ব্যবসা। সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় চানাচুর ফেরি করে দিনশেষে এসে বসতেন নিজ পাড়ার সিডির দোকানে। এভাবেই দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল। এরপর সিডি দোকানের বিক্রেতা বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে তার কাছ থেকে দোকানটি কিস্তিতে কিনে নেন আলম। তখনও আলমের বয়স পনের হয়নি। তবুও আলম একসাথে দুটো ব্যবসা চালাতে থাকেন। দিনের বেলায় ফেরি করে চানাচুর বিক্রি আর রাতের বেলায় সিডির দোকান চালানো।

একই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন আলমের দোকানের নিয়মিত ক্রেতা। আলমের প্রত্যয় এবং পরিশ্রমে মুগ্ধ হয়ে তিনি আলমকে দত্তক নেন। এরপর গ্রামে আসে ডিশ এন্টেনা। তখন আলম ক্যাবল টিভির ব্যবসা করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আব্দুর রাজ্জাকের সহায়তায় আলম সকাল সন্ধ্যা কেবল নেটওয়ার্ক নামে ব্যবসা শুরু করেন। প্রত্যেক মানুষই মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন পুষে বেড়ান সারাজীবন। কিন্তু খুব কম মানুষই সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দুঃসাহস দেখান।

আলমের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল চচ্চিত্রের নায়ক হওয়ার। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন যে তার নায়কোচিত চেহারা বা গায়ের রং নেই। ক্যাবল টিভির ব্যবসা শুরু করার পর তার মনের মধ্যে এই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার বাসনাটা আবার জেগে উঠে। তখন তিনি নিজের উদ্যোগে এবং খরচে বাংলা এবং হিন্দি বিভিন্ন বিখ্যাত গানের মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করতে শুরু করেন। এবং সেটা তার নিজস্ব ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কে চালাতে শুরু করেন।

২০০৮ সালে তিনি তার প্রথম মিউজিক ভিডিও প্রচার করেন। আলম নিজের নামের আগে হিরো শব্দটি যুক্ত করেন। এই ভিডিওটাকে স্থানীয় লোকজন পছন্দ করলে তিনি আরও মিউজিক ভিডিও নির্মাণের উদ্যোগ নেন। উল্লেখ্য মিউজিক ভিডিও নির্মাণের স্ক্রিপ্ট, পরিচালনা এমনকি সংগীত পরিচালনা তিনি নিজেই করতেন। বছর না ঘুরতেই তিনি প্রায় পাঁচশ মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করেন।

২০১৬ সালে কেউ একজন তার একটি মিউজিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করলে সেটা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। কারণ এমন চল ভাঙা, খর্বকায় এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণের কোনো মানুষ যে নায়ক হওয়ার দুঃসাহস দেখতে পারেন সেটা কারো কল্পনায়ই ছিল না। তার মিউজিক ভিডিও তার গ্রামের মানুষ পছন্দ করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মানুষ মোটেও পছন্দ করেনি। কারণ তার চেহারা এবং গায়ের এইসব মানুষদের কমফোর্টেবল জোনে সরাসরি আঘাত করেছিল।

এখানে একটা ব্যাপার উল্লেখ্য যে হিরো আলমের এই চল আসলে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের চল। যারা রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একবেলা অন্নের সংস্থান করার চেষ্টা করেন। সুষম পুষ্টির অভাবে বাংলাদেশের শিশুদের বিভিন্ন রকমের সমস্যা হয়। শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি কমে যায়। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকভাবে বড় হয় না। তার চল ভেঙে গালের মধ্যে ঢুকে যায়। যেটা বাংলাদেশের কৃষকদের দিকে তাকালে সহজেই টের পাওয়া যায়। আর রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বাংলাদেশের কৃষকদের গাত্রবর্ণ হয়ে যায় একেবারে তামাটে যেটাকে ভদ্রলোকেরা বলেন ট্যান্ড।

আলমও সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চানাচুর বিক্রি করতেন যারফলে তার গাত্রবর্ণও কৃষকদের কাছাকাছি চলে আসে। আর ঠিকমতো খেতে না পাওয়ার কারণে চল দুটোও ভেঙে গিয়েছিল। ২০১৬ সালে ভাইরাল হওয়ার পর আলমের জীবনে বড় রকমের পরিবর্তন আসে। ব্যবসায় শাস্ত্রে একটা কথা আছে, নেগেটিভ মার্কেটিং ইজ অলসো মার্কেটিং। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকেই আছে নেগেটিভিটিকে পুঁজি করে।

এখানে যেকোনো নেগেটিভ বিষয় সেকেন্ডের ব্যবধানে ছড়িয়ে পড়ে যেটাকে বলা হয় ভাইরাল হওয়া। কিন্তু সে তুলনায় পজিটিভ খবর ছড়ায় না। আলমের মিউজিক ভিডিও রাতারাতি ছড়িয়ে পড়লে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া আসলো। যারা নিজেদের সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন মনে করতেন তারা নড়ে চড়ে বসলেন তাদের সংস্কৃতি রসাতলে যাচ্ছে বলে। মিডিয়া সংশ্লিষ্ট সবাই নাক সিটকালেন- যে না শ্রী তার নাম আবার হিরো আলম।

কিন্তু পাশাপাশি যারা অনেকদিন ধরে মার্কেটিংয়ের নতুন উপায় খুঁজছিলেন তারা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। আলম খুব দ্রুতই অনেকগুলো বিজ্ঞাপনের কাজ হাতে পেয়ে যান। এবং সে সমস্ত বিজ্ঞাপনও রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। এভাবেই হিরো আলমের কদর আরও বেড়ে যায়। কিছুদিন আগে যারা আলমের চেহারা এবং কাজ নিয়ে নাক সিটকাতেন তারাই তখন হিরো আলমের সাথে সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করতে থাকেন নিজের পরিচয় বাড়ানোর তাগিদে।

এরপর আলম নিজেকে একজন পরিপূর্ণ নায়ক হিসেবে দেখার ইচ্ছে পোষণ করেন। তখন তিনি নিজের প্রযোজনায় ‘মার ছক্কা’ বলে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং নিজেই প্রধান নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। আলমের প্রযোজনায় ২০২০ মুক্তি পায় দ্বিতীয় সিনেমা ‘সাহসী হিরো আলম’। যেটার নাম ভূমিকায়ও তিনি নিজেই অভিনয় করেন।

এখানে একটা ব্যাপার লক্ষণীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া, বিভিন্ন মাধ্যমে কাজের সুযোগ পাওয়া এই বিষয়গুলো কিন্তু আলম সচেতনভাবে করেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ভাইরাল করেছেন কোনো একজন শিক্ষিত ব্যক্তিই। এরপর যেসব মাধ্যমে তিনি কাজ করেছেন তারাও আলমের প্রচারকেই কাজে লাগিয়ে নিজের পণ্যের মার্কেটিং করে নিয়েছেন। আলম হয়তোবা সেখান থেকে সামান্য মজুরি পেয়েছেন। ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর আলম নিজের নাম ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলেন ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই এবং ইউটিউব অ্যাকাউন্ট খুলেন ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।

এখন আলমের ফেসবুকে অনুসারীর সংখ্যা দুই দশমিক দুই মিলিয়ন মানে তার অনুসারীর সংখ্যা বাইশ লক্ষাধিক এবং সেটা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। আর ইউটিউবে অনুসারীর সংখ্যা এক দশমিক ছয় দুই মিলিয়ন মানে ষোল লাখ বিশ হাজার এবং প্রতিদিনই সেটাও বাড়ছে।

আলম ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পর দেশের বাইরে থেকেও কাজের অফার পেতে থাকেন। কলকাতা, সিঙ্গাপুর এমনকি আমেরিকা থেকেও তিনি কাজের অফার পান। এর মধ্যে বলিউডে একটা সিনেমাতেও অভিনয়ের কথা পাকা হয়। সিনেমার নাম- বিজু দ্য হিরো। গুগল অনুসন্ধান প্রবণতায় আলম বলিউডের প্রভাবশালী নায়ক সালমান খানকেও একটা সময় অতিক্রম করেন বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানে আলম এখন অতি পরিচিত হিরো আলম।

এরপর আলম অভিনয়ের পাশাপাশি গানে মনোনিবেশ করেন। তার ভাষায় প্রত্যেক মানুষই গানকে ভালোবাসেন। গান মনের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়। তিনিও গান ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার জায়গা থেকেই তিনি গান গাইতে শুরু করেন। যেহেতু তা গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না তাই তার গানগুলো প্রচন্ড রকমের সমালোচনার স্বীকার হয়। রবীন্দ্র সংগীত গাওয়ার পর বোদ্ধামহল গা ঝাড়া দিয়ে উঠেন এবং আদাজল খেয়ে তার সমালোচনা শুরু করেন।

যারা রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা করেন এটা তাদের কাছে অনেকটা ধর্মের মতো বিষয়। তারা নিজেদের সেই ধর্মের রক্ষক মনে করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই আলমকে বাংলাদেশে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা তাদের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে যায়। এতে করে পাশার দান উল্টে যায়। যারা এতদিন ধরে আলমকে দুয়ো দিচ্ছিলো তারাই আলমের পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করেন।

বাংলাদেশের বদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশে আলম যেন এক বিদ্রোহের নাম হয়ে উঠেন। সবাই দ্রুত আলমের মুক্তি চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম করে তোলেন। অবশ্য গোয়েন্দা পুলিশ মুচলেকা নিয়ে আলমকে ছেড়ে দেন। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এমন কোন কিছু করার এখতিয়ার বাংলাদেশ পুলিশের আছে কি না। সে যেটাই হোক এর সবকিছুই আলমকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। যারা আগে আলমকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতেন তারাও আলমের পক্ষ নিতে শুরু করেন।

আলমের আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। আলম বরাবরই রাজনীতি সচেতন। আমরা ভদ্রলোকেরা যেহেতু নিজেদের ভদ্রলোক দাবি করি তাই রাজনীতি থেকে নিজেদের শতহস্ত দূরে থাকি। কিন্তু একটা বিষয় আমরা কখনওই স্বীকার করতে চাই না। সেটা হলো এই পৃথিবীর সকল কিছুর নিয়ন্ত্রক হলো রাজনীতি। আমি যেটা বলি রাজনীতি অনেকটা বাতাসের মতো। আপনি না চাইলেও আপনাকে সেই বাতাসেই শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষিত মানুষেরা নিজেরা সবসময়ই গাঁ বাঁচিয়ে চলেন।

আলম উপজেলা নির্বাচন করেছেন ২০১১ এবং ২০১৬ সালে যদিও অকৃতকার্য হয়েছেন। এরপর এক সময় তিনি জাতীয় রাজনীতিতেও নাম লেখালেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হিরো আলম স্বতন্ত্র প্রাথী হিসেবে সিংহ প্রতীকে নির্বাচন করেন। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করলে বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।

হিরো আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দুটো আসনেরই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তিনি মাত্র ৮৩৪ ভোটে বগুড়া-৪ আসনে হেরে যান। উপ-নির্বাচনে হারলেও তার সমর্থকরা তাকে ‘জনতার এমপি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সম্প্রতি আলম আবারও আলোচনায় আসেন দুটো কারণে।

প্রথমত পুলিশের এজাহারভুক্ত আসামি আরাভ খানের দুবাইয়ের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে গিয়ে। দ্বিতীয়ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের একটা মন্তব্যকে কেন্দ্র করে। তিনি বলেন ‘রুচির দুর্ভিক্ষে হিরো আলমের উত্থান’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কৃতি কি? আর সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষই বা কি? সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ চিৎপ্রকর্ষ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন।

ইংরেজি Culture-এর প্রতিশব্দ হিসেবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯২২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয়। কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি। প্রশ্ন হচ্ছে সংস্কৃতির এসব জ্ঞানগর্ভ সংজ্ঞা বাংলাদেশের মতো একটা দেশের জন্য ঠিক কতখানি প্রযোজ্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী পূর্বপুরুষের আমল থেকে কৃষিজীবী এবং তারা গ্রামেই বসবাস করেন।

গ্রামের চায়ের দোকানে বসলে সেখানকার একটা আর্থ-সামাজিক চিত্রের ধারণা পাওয়া যায়। গ্রামে এক সময় নির্দিষ্ট বিরতিতে যাত্রা হতো, সার্কাস হতো, হতো নাটকও। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক অনেক আচার ছিল। যেমন বৃষ্টির গান, সুন্নতে খৎনার গীত, বিয়ের গীত, লাঠি খেলা, সাপের খেলা, বায়োস্কোপ। এছাড়াও আড়ং বলে পহেলা বৈশাখে বসতো মেলা। ছিল রথের মেলা। তাছাড়াও প্রত্যেক এলাকাতেই কোনো না কোনো সাধু সন্যাসী বা পীরকে কেন্দ্র করে ছিল বিভিন্ন উৎসব।

একটা কথায় তো প্রচলিত ছিল। সেটা হলো বাঙালির বারো মাসে তের পার্বণ। তাই কখনোই বিনোদনের অভাব হয়নি। এরপর আকাশ সংস্কৃতির কালো থাবায় সব একটা সময় হারিয়ে যেতে বসলো। এখন সবকিছুই বোকা বাক্সের মধ্যে আটকা পড়েছে। চার দেয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মন বিষিয়ে উঠছে। সরকারিভাবে কোনদিনই আমাদের সংস্কৃতির এইসব স্থানীয় উপকরণকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো প্রকার চেষ্টা করা হয়নি।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে সময়ের সাথে শাসক বদলেছে কিন্তু এসব খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য বদলায়নি। তারা এখনও সেই তলানিতেই আছেন। তাদের গণনা করা হয় শুধুমাত্র ভোটের সময়। এখন তো অনেকদিন ধরে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনও হয় না। তাই তাদের আর তেমন কোন মূল্যই নেয় রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে। আলমের ভিডিওগুলো মানের প্রশ্নে চলনসই না হলেও মানুষকে ভিন্নতার স্বাদ দিয়েছিল। আমার ধারণা এটাই তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ। তবে এই জনপ্রিয়তা কতদিন থাকবে সেটাই দেখার বিষয়।

তাহলে সংস্কৃতির যে দুর্ভিক্ষের কথা বলা হচ্ছে সেটা আসলে শুধু আজকের ব্যাপার না। দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসন আমাদের সবকিছুরই একটা স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়ে গেছে। জীবন কেমন হবে, শিক্ষা কেমন হবে, চিকিৎসা কেমন হবে, পোশাক কেমন হবে, চলাফেরা কেমন হবে সবকিছুর জন্যই এখনও আমরা সেই উপনিবেশবাদের কাছেই ধরা। এমনকি আমাদের দেশের যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক কাঠামো সেটাও ব্রিটিশদের বানানো।

আর যেহেতু তারা এখন অনেক ভালো আছেন তাই মনে হয় আমাদের সবকিছুই তাদের মতো হতে হবে। কিন্তু একটা বিষয় আমরা ভুলে যায়। সেটা হচ্ছে তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে। সেটা কিন্তু আমাদের নেই। ইউরোপ আমেরিকাতে মানুষ যেই জীবন যাপন করে সারা পৃথিবীর মানুষ যদি সেই স্ট্যান্ডার্ডে জীবনযাপন করতে চাই তাহলে আমাদের আরও সাতটা পৃথিবী লাগবে। আর ওইসব তথাকথিত উন্নত দেশের বেশিরভাগ গায়ের মানুষের গাত্রবর্ণ যেহেতু সাদা তাই এখনও আমরা আমাদের কৃষ্ণবর্ণ নিয়ে দ্বিধায় ভুগি। এই হীনমন্যতা থেকে আশু মুক্তি নেই।

জনগণ যেমন হয় তাদের নেতাও তেমনই হয়। ঠিক তেমনি জনগণের রুচি যেমন হবে তাদের সংস্কৃতিও তেমনই হবে। বাংলাদেশে একটা সময় আমরা পরিবারের সবাই মিলে দলবেঁধে হলে গিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র দেখতাম। এখনও আমাদের মনে সেইসব শৈশব কৈশোরের স্মৃতি উজ্জ্বল পাশাপাশি মাঝে মধ্যে দেখা হতো টাইটানিকের মতো জগতবিখ্যাৎ সিনেমাও।

আর ভিসিআরয়ে দেখা হতো ভারতীয় বাংলা এবং হিন্দি সিনেমা। আকাশ মুক্ত হয়ে যাওয়াতে এখন সহজেই বিশ্বের সবকিছুই আমাদের হাতের মুঠোয়। আর মতামত প্রকাশের জন্য আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সভ্যতার ওপর পিঠেই আছে সংকট। তাই সংকটকে বাদ দিয়ে সভ্যতাকে আলিঙ্গন করার কোনো উপায় নেই।

আলম হিরো হয়েছে কারণ অধিকাংশ মানুষ চেয়েছে। সেটা তার ফেসবুক এবং ইউটিউব প্রোফাইল দেখলেই বোঝা যায়। এখন কতটা মানসম্পন্ন সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অবশ্য কোনো মানদণ্ডে আপনি সেটা মাপবেন। সেটাও একটা প্রশ্ন। আলম মানুষদের বিনোদন দিচ্ছে সেই বিষয়ে তো এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। আর আমাদের হারিয়ে যেতে বসা সংস্কৃতিতে আমাদের নিজেদের তেমন কেউই নেই যাকে দেখে মনে হয় আরে এই লোকটা তো আমাদেরই প্রতিনিধি।

আমাদের নায়কেরা সবাই হলিউড বলিউড নায়কদের মতো। চলচ্চিত্রে তাদের সবকিছুই ভিনদেশিদের অনুকরণে হয়। এমনকি চিত্রায়নও অনেক সময়ই হয় দেশের বাইরে। এসব চলচ্চিত্র একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শকদের ভালো লাগলেও বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের তার সাথে রিলেট করতে পারেন না। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশের কথ্য ভাষা আর প্রমিত ভাষার পার্থক্য। আমরা সাহিত্যের মতো চলচ্চিত্রেও প্রমিত ভাষায় ব্যবহার করি। ফলে আমাদের সাহিত্য যেমন আমাদের সাধারণ মানুষদের কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছায় না আমাদের চলচ্চিত্রও।

আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি কতটা জনবিচ্ছিন্ন। সেটার একটা বাস্তব উদাহরণ দিই। একবার আমাদের পুরো পরিবার নিয়ে রমনা বটমূলে গিয়েছি ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে। যেয়েই তো চক্ষু চড়কগাছ। পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছে সোয়াট (SWAT) এর সদস্যরা। কারণ কয়েক বছর আগেই বোমা হামলা হয়েছিল। তাদের ফাঁক দিয়ে শিল্পীদের খুঁজে পাওয়ায় দায়। একসময় অনুষ্ঠান শেষ হলো সানজিদা খাতুনের একটা বক্তব্যের মাধ্যমে।

একটা লাইন এখনও কানে বাজে, এভাবে আমাদের এক রকম বন্দি করে ফেলা হচ্ছে। জানি না কতদিন এভাবে চলবে। সাধারণ মানুষ কিন্তু পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যায় মেলাটা উপভোগ করতে সেটাই আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু ছায়ানটের পুলিশে ঘেরা এই অনুষ্ঠান, চারুকলার পুলিশে ঘেরা এই শোভাযাত্রা আর কতদিন এভাবে চলবে। আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি।

আমাদের নিজেদের হারানো সংস্কৃতিগুলোকে ফিরিয়ে আনার সময়ও এখনও শেষ হয়ে যায়নি। না হলে এখন একজন আলম হিরো হয়েছেন এরপর হাজারো আলম দাঁড়িয়ে যাবেন। তখন আপনি কাকে দুষবেন। পরিশেষে কিছু ভালো বিষয় দিয়ে শেষ করি। হিরো আলমের সংগ্রামমুখর জীবন এখন অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা।

হিরো আলম এরই মধ্যেই একটা বই লিখেছেন, ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলান আমরা সমাজকে বদলে দেবো’। বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা আছে, বিখ্যাত হতে আসিনি শুধু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে চেয়েছি। এই বইয়ের মূল কথায় হচ্ছে জীবনে কোনোভাবেই ভেঙে পড়া যাবে না বিপদ যতই কঠিন হোক। তিনি বারবার একটা কথায় বলে গেছেন, আমি আলম যদি পারি তাহলে আপনি কেন পারবেন না।

আমার ধারণা এই কারণেই তিনি অনেকের কাছে বাস্তব জীবনের হিরো। সপ্তম শ্রেণি পাশ একজন চানাচুর বিক্রেতা এখন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। এটাই হিরো আলমের সফলতা। আর যে বাকি সাংস্কৃতিক বিচার সেটা বিচারের ভার ছেড়ে দিতে হবে জনগণের হাতে। কারণ দিনশেষে তারা নির্ধারণ করবেন কে হিরো আর কে জিরো।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]