মানবতার দার্শনিক অভিযাত্রী প্রফেসর ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরী
সামাজিক বিজ্ঞান কেবল অ্যাকাডেমিক গবেষণা নয়—এটি হতে পারে মানবতার আত্মসন্ধান। এই বিশ্বাস থেকেই মালয়েশিয়ার লিংকন ইউনিভার্সিটি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও লিংকন–ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টারের উপ-পরিচালক প্রফেসর ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরী কাজ করছেন জ্ঞান, দর্শন ও নৈতিকতার এক সমন্বিত দৃষ্টিকোণ গড়ে তুলতে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রফেসর ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরী
ড. জাহিদ মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়া থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। তার রচিত ‘রেসিপ্রসিটি ইন সোশ্যাল রিসার্চ’ গ্রন্থটি ৮০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যক্রমের অংশ।
এছাড়া ‘উবুন্টু ফিলোসফি ইন দ্য নিউ নরম্যালসি’ গ্রন্থে তিনি ব্যক্তিবাদ পেরিয়ে বিশ্বজনীন সংহতির দর্শন উপস্থাপন করেছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭টি এবং গবেষণা অধ্যায় ২৬টি।
মালয়েশিয়ায় ইউনূস সেন্টারের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস
বাংলাদেশের রাখাইন জনগোষ্ঠীর উদ্ভিদভিত্তিক চিকিৎসা নিয়ে তার গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। তার প্রস্তাবিত ‘বায়ো ব্যাংক অব প্ল্যান্ট-বেইসড ইনডিজিনাস মেডিসিনাল নলেজ’ প্রকল্পের মাধ্যমে আদিবাসী চিকিৎসা জ্ঞানকে সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবে এরই মধ্যে মালয়েশিয়ান সরকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ড. জাহিদের উপস্থাপিত ‘রেসিপ্রোকাল থিওরি’ জ্ঞানের পারস্পরিক ও মানবিক বিনিময়ের ধারণাকে তুলে ধরে। অন্যদিকে ‘ইন্ডিজিনাস গ্নোসিওলজি’ স্থানীয় সংস্কৃতি ও মানবিকতাকে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে—যা পশ্চিমা নিরপেক্ষতা ধারণার বিকল্প দর্শন হিসেবে উদ্ভাসিত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেআইউ) ‘গবেষণা পদ্ধতি’ শীর্ষক কর্মশালায় ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরী
তিনি বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞান যদি নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তবে তা আত্মাহীন হয়ে পড়ে। তার গবেষণায় কুরআনের শিক্ষা, তাতাব্বুর ও ইহসান দর্শনের সঙ্গে পশ্চিমা ন্যায়বিচার তত্ত্বের তুলনামূলক বিশ্লেষণ স্থান পেয়েছে। ইবনে সিনার চিকিৎসা ও দর্শনকেও তিনি সমাজবিজ্ঞানের সঙ্গে একীভূত করেছেন।
ড. জাহিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি পূর্ণ তহবিলভিত্তিক পিএইচডি স্কলারশিপ স্কিম, যার আওতায় ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষক ও গবেষক ইতোমধ্যে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণমাধ্যম গবেষকরা।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মালয়েশিয়ার লিঙ্কন ইউনিভার্সিটি কলেজের একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরে ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরী
লিংকন ইউনিভার্সিটি কলেজের প্রেসিডেন্ট ড. অমিয় ভৌমিকের দিকনির্দেশনায় প্রতিষ্ঠিত এই সেন্টারটি বিশ্বের ১১৪টি ইউনূস সেন্টারের মধ্যে ১১২তম। এর লক্ষ্য—সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসা ও মানবিকতার সমন্বয়ে সমাজমুখী উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়ন। এখানে চলছে গবেষণা অনুদান, নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ ও সামাজিক উদ্ভাবন কর্মসূচি। সেন্টারটি এরই মধ্যে, ক্লিন্টন ফাউন্ডেশন, বান কি–মুন ফাউন্ডেশন, কফি আনান ফাউন্ডেশন–এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করেছে।
তার সর্বশেষ চিন্তাধারা ‘সেল্ফোসফি’ বা আত্ম-দর্শন—যা মানুষকে নিজেকে চেনা, আত্মিকভাবে সুস্থ হওয়া ও সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। এর মূল ধারণা ‘সেল্ফ–রিপেয়ারিং মডেল’, যেখানে আত্মসচেতনতা সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত। যদিও ড. জাহিদ আন্তর্জাতিক গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তার হৃদয় এখনো বাংলাদেশে প্রোথিত।
বাংলা প্রেসক্লাব মালয়েশিয়ার প্রকাশিত প্রবাস বুলেটিন ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরীর হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রেসক্লাব সভাপতি আহমাদুল কবির।
রাখাইন, খাসি, সাঁওতালসহ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনচর্চা তার গবেষণার মূল অনুপ্রেরণা। তার বিশ্বাস—বাংলাদেশ আমার ল্যাবরেটরি নয়; এটি আমার মাতৃভূমি, আমার অনুপ্রেরণা।
প্রফেসর ড. জাহিদ সিরাজ চৌধুরী দেখিয়েছেন, শিক্ষা ও গবেষণা কেবল জ্ঞানের অনুশীলন নয়—এটি মানবতার জাগরণ। তার দর্শন প্রমাণ করে, যখন জ্ঞান নৈতিকতার সঙ্গে মেলে, তখনই সমাজ ও সভ্যতা আলোকিত হয়।
এমআরএম