পাইলটবিহীন ড্রোন ও কিছু কথা

কী হবে বিশ্বায়নে যদি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণ হয়? এমনটি ভাবনা অনেকের কিন্তু জানি না কেউ কি ভাবছেন অ্যাভিয়েশন ও স্পেসের দিক থেকে যে ক্ষেপণাস্ত্রটি (ড্রোন) ব্যবহৃত হচ্ছে তার ভয়াবহতা কত পাষন্ড! ড্রোন এখন পাইলটবিহীন বিমান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির এই ছোট্ট প্লেনটি কখনও বড় বিমানের মতো হতে পারে আবার হতে পারে হাতের তালুর চেয়েও ছোট। ড্রোনকে রোবোটিক্স ও ইলেকট্রনিক্সের সর্ব উন্নত প্রযুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
১৯১৬ সালে স্যার নিকোলাস টেসলা প্রথম এই পাইলটবিহীন এয়ারক্রাফ্টের ধারণা দেন। আর তার সূত্র ধরেই প্রথম ড্রোন চালু করা হয় ১৯১৭ সালে। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র প্রথম এর ব্যবহার করে। তবে তখন ড্রোনকে রেডিও দ্বারা পরিচালিত করা হতো। ড্রোনটি প্রথম আকাশে উড়াল দেয় ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই মাঝখানের সময়টাতে ড্রোনকে আরও বেশি কার্যকর বানানোর পেছনে কাজ চলতে থাকে।
প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ড্রোনের আবিষ্কার ও ব্যবহার এবং এর প্রয়োগ হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধে। এরপর তা আস্তে আস্তে আরও কয়েকটি যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। ২০১৩ সালে অ্যামাজন যখন এটি সম্পর্কে একটি নোটিশ জারি করে তখন সবাই ড্রোন সম্পর্কে জানতে পারে। সেই থেকে মানুষ এর ব্যবহারে উৎসুক হয়। আর এভাবেই এখন সেই ড্রোন নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
হাতে একটা জয়স্টিক নিয়ে এবং জিপিএস ব্যবহার করে একটা ড্রোন চালাতে অনেকের কাছে এটা গেম খেলার মতোই লাগবে। আর তাই ড্রোন দিয়ে খেলতে অনেকেই ভালোবাসে। যাই হোক সরলসিঁধে ড্রোনের পেছনে অর্থাৎ এর ভিতরের বিষয়গুলো কিন্তু একটু জটিল। ড্রোনে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ড্রোন টেকনোলজি মূলত খুবই হালকা রকমের পদার্থ দিয়ে তৈরি যার ফলে ড্রোনকে অতি উচ্চতায় উড়তে সাহায্য করে।
সচরাচর যে ড্রোনগুলো আমাদের চোখে পড়ে তা মূলত আকারে অনেকটাই ছোট এবং বাচ্চাদের খেলনা হিসেবেই প্রকাশ পায়। কিন্তু খেলনাতেই কি এর ব্যবহার শেষ? না, মোটেও তা নয়। এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি এর ব্যবহারের পরিসরও বৃহৎ। বিমানের সাইজের ড্রোন মূলত দূরবর্তী স্থান হতে ভারি মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
আর এর ব্যবহার প্রকট হয় ঠিক তখন যখন কোনো একটা দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদে নিয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে। এর মাধ্যমে কোনো পাইলটের জীবনকে আশংকায় না ফেলেই মানুষকে উদ্ধার করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি যেক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহৃত হয় তা হলো সামরিক ক্ষেত্র।
আর ছোট্ট ড্রোনগুলো খেলনার পাশাপাশি শোভা পায় বিভিন্ন ফটোগ্রাফারের কাছে। এর মাধ্যমে তারা উপর হতে ছবি তুলতে পারে। আর এভাবেই মানুষের নানামুখী চাহিদাকে একাই বিভিন্নরূপে পূরণ করে যাচ্ছে ড্রোন। যার শত শত উদাহরণ আমাদের সামনেই।
ভাষাগতভাবে, পুরুষ তথা কর্মী মৌমাছিদের ড্রোন (Drone) বলা হয়। রানি মৌমাছির হয়ে কাজ করতে গিয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়াই ড্রোনদের কাজ। প্রাপ্তবয়স্ক ড্রোনদের প্রতি রানি মৌমাছির কোনো দায় দায়িত্ব থাকে না। একইরকমভাবে, খরচ হয়ে যাওয়ার উপযুক্ত মনুষ্যচালক ছাড়া দূর থেকে বা নিজের থেকে নিয়ন্ত্রণ হওয়া এক রকম উড়নযন্ত্রকে আজকাল ড্রোন বলা হচ্ছে।
সাধারণ ওড়াউড়ি ছাড়াও ড্রোনের কিছু বিশেষ সুবিধার জন্য একে ফটোগ্রাফি, গোয়েন্দা কাজে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেহেতু আকারে-আকৃতিতে একটি ড্রোন একটি খেলনার থেকে খুব বেশি বড় হয় না, এটি প্রায়শঃই রাডার যন্ত্রে ধরা পড়ে না। তাই একটি ড্রোনে ক্ষেপণাস্ত্র বা বন্দুক লাগালে তা যুদ্ধবিমানের বা হেলিকপ্টারের বিকল্প হতে পারে।
একটি ড্রোন যেকোনো জায়গা থেকে সরাসরি উড়তে পারে। এর নিজস্ব মাইক্রো প্রসেসর মস্তিস্ক থাকার জন্য বিভিন্ন উপগ্রহ থেকে সাহায্য নিয়ে একটি ড্রোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট জায়গায় উড়ে যেতে পারে। এই উপগ্রহ নিয়ন্ত্রিত দিক নির্ণয়কারী ব্যবস্থাকেই জিপিএস বলা হয়। একটি ড্রোনের তৈরিতে খরচ কম ও এটি যদি শত্রুপক্ষের হাতে নষ্টও হয়ে যায়, তাতেও তেমন ক্ষতি হয় না। অন্ততঃ একটি মানুষ বিমান বা হেলিকপ্টার চালকের জীবন রক্ষা পায়। তাই বর্তমানে বিভিন্ন বিপজ্জ্বনক ও অসুবিধাজনক ক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ড্রোনের মতো টেকনোলজি মানুষের জীবনকে করেছে আরও স্বাছন্দ্যময়। সেই সাথে যোগ করেছে কিছু বাড়তি সুবিধা। আর আমাদের যথাযথ প্রয়োগের মাঝেই এর সার্থকতা লুকিয়ে আছে। তাই আমরা যদি এর যথাযথ ব্যবহার করতে পারি তা হলেই আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার সার্থক বলে পরিগণিত হবে। যেমন ইদানীং সেলফি তোলার সময় এক হাতে স্মার্টফোন বা সেলফি স্টিক ধরে রাখতে হয় বলে অনেক সময় ছবির মান ভালো হয় না।
সমস্যার সমাধান দেবে ‘পিক্সি’। আকারে ছোট ক্যামেরাযুক্ত ড্রোনটি নিজ থেকেই সেলফি তুলে দেবে। শুধু তা–ই নয়, ওয়্যারলেস প্রযুক্তির সাহায্যে ধারণ করা ছবি বা ভিডিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠাতে পারে ড্রোনটি। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ আরো অনেক দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ড্রোনটি।
জার্মানির নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিত্রদের অস্ত্র দিতে ‘লেন্ড-লিজ অ্যাক্ট’ পাস করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন ইউক্রেনকে অস্ত্র দিতে সেই আইন আবার ফিরিয়ে আনলো দেশটি। গত সোমবার এ সংক্রান্ত আইনে সই করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এখন ইউক্রেনে ট্যাংক-বিধ্বংসী, উড়োজাহাজ-বিধ্বংসীসহ শক্তিশালী ও আধুনিক সব অস্ত্র পাঠাতে বাইডেন এ পদক্ষেপ নিলেন।
বর্তমানে আমেরিকা প্রচুর পরিমাণ ড্রোন ইউক্রেনকে দিয়েছে যার ফলে পাইলট ছাড়াই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এই ড্রোন গিয়ে ভয়াবহ অঘটন ঘটিয়ে চলছে। বিশ্বায়নে চলছে যুদ্ধ পাইলট বা অন্যন্য প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহায্যে। তবে পাইলটবিহীন যে মারাত্মক অপারেশন চলছে তাতে মনে হচ্ছে সৈন্যবিহীন যুদ্ধই ভবিষ্যতের সাইবার অ্যাটাকের মতো ভয়ংকর ক্ষেপনাস্ত্র ড্রোন। ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে ড্রোনগুলো দিয়েছে তা জায়গামতো গিয়ে যেকোনো কিছু ধ্বংস করতে সাহায্য করছে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস