‘এসব মেনে নেওয়া যায় না’

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ০৪:৪৩ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২২

সেদিন ছিল জোসনা রাত। জমিদার বাড়ির বৈঠকখানায় সালিস বসেছে। জমিদার বৈঠকখানায় তার নির্ধারিত আসনে বসা। দুইটা হ্যাজাক বাতি দুইপাশে জ্বালানো। আসমান থেকে চাঁদের হ্যাজাক সরাসরি আলো ফালাচ্ছে। বৈঠকখানা, উঠান আলোতে এক্কেরে ঝকঝকা।

বাইরে উঠান ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই সালিসের রায় শুনতে এসেছে। খুবই নাজুক এক ঘটনা; জমিদার আগের সালিশে দুইজন প্রধান আসামি ছাড়া ও পৃথক তিনজনের সাক্ষ্য শুনছেন, ওইদিন রায় হওয়ার কথা।

গ্রামের অষ্টাদশী কন্যা কোহিনুরের ঘর থেকে ভোরবেলা পাশের গ্রামের ২৪-২৫ বছরের যুবক সাইদুলকে বের হতে দেখা গেছে, সাক্ষী পাশের বাড়ির মঈনুদ্দিন ব্যাপারী। সে ফজরের ওয়াক্ত হলে ওজু করতে উঠে দেখছে সাইদুলকে কোহিনূরদের ঘর থেকে বের হতে। মঈনুদ্দিন এখন এই কেলেঙ্কারির বিচার চায়, তার ভাষ্য, হয় এদের বিয়ে দেওয়া হোক নয়তো দোররা মেরে বিচার করা হোক।

বিজ্ঞাপন

কোহিনুরদের বাসার দুইঘর পরের হোসেন ব্যাপারীকে ডাকা হয়েছিল, সে সাক্ষ্য দিয়েছে সাইদুল ভালো ছেলে। কোহিনুর ছলনা করে তাকে ডাকছে ফাঁদে ফেলার জন্য। মেয়ে চরিত্রহীনা, সাইদুল বিয়ে করলে করুক। যদিও এই চরিত্রের মেয়েরে বিয়ে করাও ঠিক না।

সাইদুল সাক্ষ্য দিয়েছে, সে রাতে গিয়েছিল কোহিনুরের ঘরে। কারণ কোহিনুর তাকে ডাকছে, তার সঙ্গে কোহিনুরের মহব্বত। সে তারে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু কোহিনুর সাক্ষ্য দিছে সব মিথ্যা আর বানানো, সে কাউকে ডাকেনি, তার ঘরে কেউ আসেনি, কিন্তু সাইদুল অনেকদিন ধরে তাকে কুপ্রস্তাব দেয়। সে সাড়া না দেওয়ায় এখন তার নামে অপবাদ দিচ্ছে। সে সাইদুলকে বিয়ে করতে চায় না।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

কোহিনুরের বাবা মিরাজ মিঞা বলছে, এটা সাইদুল, মঈনুদ্দিন আর হোসেনের চক্রান্ত। তার মেয়েকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে কেলেঙ্কারিতে ফাঁসানো হচ্ছে। এদের কারোরই নিজেদের চরিত্র ভালো না, গ্রামের সবাই জানে। সেই রাতে কোহিনুর বাড়িতেই তার বোনের সঙ্গে ঘুমিয়েছিল, কেউ আসেনি তার ঘরে। তিনি তার মেয়ের নামে মিথ্যা অপবাদের বিচার চান।

জমিদারকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
একটা নিশাচর পাখি ডাকতে শুরু করলো!

তার দুই পাশে দুইপক্ষের লোকজন ও গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বসা। আমার আব্বাও ছিল সেখানে। চারপাশে ফিসফাঁস শব্দ, কিন্তু জোরেসোরে কেউ কিছু বলছে না। আমি গ্রামের অন্য লোকদের সঙ্গে দাঁড়ানো। রায় শোনার অপেক্ষায়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

পর্দার আড়ালে কোহিনুর, তার মা আর বোনের সঙ্গে বসা। হঠাৎ গলা খাকারি দিয়ে হেডমাস্টার রহমত উল্লাহ বলে উঠলেন, সালাম জমিদার, কিছু কি মনস্থির করছেন? নাকি আরো সময় বা সাক্ষী নেবেন?

পাশে বসা আড়ৎদার হাসেম মিঞা বলে উঠলো, বেয়াদবি মাফ করেন জমিদার। দুইজন পুরুষ সাক্ষ্য সাইদুলের পক্ষে গেছে, কোহিনুরের বাপ তো নিজের মেয়েরে ভালোই কবি। তাহলে আর চিন্তা করার কিছু নাই। হয় বিয়ে পড়ানোর আদেশ দেন, নয়তো শাস্তির ব্যবস্থা করেন। আমরা দশঘর মিলে সমাজ, এমন কেলেঙ্কারি তো মেনে নেওয়া যায় না।

জমিদার খুবই চিন্তিত, কারণ কোহিনুর বিয়ে করতে রাজি না। এখন এর সমাধান কি? দোররা! কিন্তু তিনি নিজেই দোররার বিপক্ষে।

বিজ্ঞাপন

এ সময় অন্দরমহল থেকে আমারে ডাক পাঠাইলো লোক মারফত, আমি গিয়ে দেখি আপনার নানা আর আপনার আব্বা আসফাকউদ্দীনের বেজায় জ্বর। বিছানায় শোয়া, তিনি যখন কিশোর বয়স ১৫-১৬ হবে। গা এক্কেরে পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

বেগম আম্মার মাথায় সব সময় কাপড় থাকতো, ওই দিন দেখি নাই, পাশে ছেলের হাত ধরে বসা। আমি তাকে এখনো আম্মা ডাকি, অত্যন্ত সম্মানও করি। ওই দিন প্রথম মাথার কাপড় ছাড়া দেখলাম, কি যে সুন্দর আম্মা। সুবহানআল্লাহ।

আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি মাথার কাপড় দিয়ে বললেন, তমিজ আসছো? দেখতো আমার আব্বার কি হলো, জ্বর নামছে না তো।

বিজ্ঞাপন

আমি রোগী দেখে মাথায় পানি ঢালতে বলি। পুরো শরীর ভেজা গামছা দিয়ে মুছে দিতে বলি। এরপরে জ্বরের ওষুধ বাড়ি থেকে আইনা দিতেছি কয়ে যেই যাবার নিছি।

তিনি তখন বললেন, দাঁড়াও তমিজ, বৈঠক খানায় সালিস চলছে। তোমার আব্বা, কবিরাজও আছেন ওখানে। তার হাতে এই চিরকুট দিয়া বলবা জমিদার সাহেবকে এখনই দিতে। তাড়াতাড়ি যাও।

বেগম আম্মা, একটা ভাঁজ করা চিরকুট আমার হাতে দিলেন। আমি নিয়ে আব্বার হাতে দিলাম, কানে কানে বললাম, বেগম আম্মা যা বলছেন। আব্বা উঠে গিয়ে জমিদারের পেছনে দাঁড়ায়ে সালাম দিলেন। জমিদার পেছনে তাকাইলে আব্বা বললেন অন্দর মহল থেকে পাঠাইছে। বলে চিরকুট টা দিলেন।

বিজ্ঞাপন

জমিদার চিরকুট হাতে নিলেন, ভাঁজ খুলে পড়লেন। তাতে লেখা‘জমিদার সাহেব বড় ছেলেটার ভীষণ জ্বর, একটু অন্দর মহলে আসেন।’

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে বললেন আমি এখন আসছি। আপনারা সবাই থাকেন, দেরি হবে না। তিনি আব্বাকে বললেন আপনিও আসেন আমার সঙ্গে। আব্বার পিছে পিছে আমিও গেলাম, আব্বাকে যেহেতু ডাকছেন। আব্বা রোগী দেখে যেই ওষুধ বলবেন সেইটা বাড়ি থেকে আনবো এজন্য।

বেগম আম্মা তৈরি ছিলেন। আমাদের রোগীর ঘরে নিলেন। আমার আব্বা রোগী দেখে বললেন শক্ত জ্বর, ভালো ঠেকছে না, আমি বাড়ি থেকে ওষুধ বানায় আনি, তমিজ তুমি এখানে রোগীর কাছে থাকো, মাথায় পানি দাও।

বিজ্ঞাপন

জমিদার চিন্তা নিয়েন না, রাতটা ভুগবো, সকালে ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ, বলে আব্বা বের হয়ে গেলেন। বেগম আম্মা জমিদারকে নিয়ে বারান্দায় গেলেন।

তাকে বললেন, জমিদার সাহেব, আপনি কিন্তু ন্যায় বিচার করবেন, সাক্ষী যে যাই বলুক, কোহিনুর নির্দোষ, তার সঙ্গে সাইদুলের মন দেওয়া নেওয়া থাকলে সে বিয়েতে রাজি হইতো, এগুলান সাইদুলের চক্রান্ত। আর সত্যি হইলেও কোনো মেয়ে একলা চরিত্রহীন হইতে পারে না, সে চরিত্রহীন হইলে সাইদুল আরও বড় চরিত্রহীন, সে ভালো হলে রাইত বিরাতে মেয়ের ঘরে আসছে কেন?

মনে রাখবেন, ভুল রায় দিলে কিন্তু আখেরাতে আটকে যাবেন। জমিদার বললেন, আমি সেটা জানি, কিন্তু কোহিনুরের পক্ষে তো কোনো সাক্ষী নাই তার বাপ ছাড়া, আমি কিভাবে এই রায় ঠেকাবো?

সেইটা আপনাকে আপনার বিচক্ষণতা দিয়ে করতে হবে। দুনিয়ায় অনেক মানুষ জন্মে, সবাই জমিদার হয় না, সবাই বিচারের দায়িত্ব পায় না, আমি আর কিছু বলবো না।

জমিদার মুখ কালো করে বের হয়ে গেলেন। বেগম আম্মার মুখ থমথমে। আরও মিনিট ১৫-২০ পর আব্বা আসলো ওষুধ নিয়া, রোগীকে খাওয়ানোর পর ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে আমরা অন্দরমহল থেকে বিদায় নিলাম।

সালিসে জমিদার সাইদুলকে ডাকলেন। সাইদুল সামনের এসে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। জমিদার জিজ্ঞাসা করলেন,
কোহিনুর ডাকলেই তুমি গেলে কেনো?

জ্বী, তারে ভালো লাগে, বিবাহ করতে চাই। তুমি যাকে ভালো পাও, তার ঘরে অমাবস্যার রাতে গেলা? দিনের আলোয় না বিবাহের পয়গাম নিয়ে যাবা। কোহিনুর এবং তার বাবা বলছে তুমি মিথ্যা বলছো।

জ্বী জমিদার সাহেব, ভুল হইছে। কিন্তু দেখেন আমার কাছে কোহিনুরের কানের দুল আছে। সে পকেট থেকে ছোট একটা দুল বের করে দিলো জমিদারকে। আপনি বিবাহের ব্যবস্থা করেন, আমি রাজি।

জমিদার থমকে গেলেন, সাইদুলকে বিদায় দিয়ে কোহিনুরকে ডাকলেন। মাথায় কাপড় দেওয়া কোহিনুর আসলো।

এই কানের দুল কি তোমার? দেখে বলো।

জ্বী জমিদার সাহেব আমার, এই মিথ্যা ঘটনার তিনদিন আগে নদীতে গোসল করতে গিয়ে হারায় গেসিলো, অনেক খুঁজছি, পাই নাই, মাফ করবেন আমাকে। সাইদুল মিথ্যা বলছে, আমি মিথ্যাবাদীকে বিবাহ করবো না। চারপাশে শোরগোল, মঈনুদ্দিন বলে উঠলো মেয়ে মানুষের আবার মত কি? মেয়ের বাপরে জিজ্ঞাসা করেন।

তুমি আমার কথার মাঝে কথা বলছো কেন মঈনুদ্দিন?
ভুল হইছে, মাফ কইরে দেন জমিদার সাব আর হবে না।

জমিদার বললেন, মেয়েদের অবশ্যই মত নিতে হবে। বিয়ে পড়ানোর সময় কাজী বা মৌলানা আগে কার কাছে যায়? মেয়ের কাছে, মেয়ে কবুল বললে তারপর ছেলের কাছে যায়। মেয়েরা বিবাহ করে বলেই ছেলেদের বিবাহ হয়।

উল্টা-পাল্টা কথা বলবেন না। সবাই চুপচাপ বসেন। দশ মিনিট পর নায়েব রায় পড়ে শোনাবেন। সালিশে রায় হয়ছিল। সাইদুলকে আশিটা দোররা, কোহিনুরকে পঞ্চাশ দোররা, আর এ রকম আবার হলে দুই পরিবারকেই গ্রামছাড়া একঘরে করা হবে। দোররা পরেরদিন কার্যকরী হবে।

রায়ের পর কোহিনুরের মায়ের বিলাপ শুরু হলো। আল্লাহ গো মেয়ে হওয়া বলে রহমতের লক্ষণ, এই তার নমুনা? আল্লাহ এইডা রহমতের নমুনা? জমিদার একদমই গম্ভীর হয়ে উঠে গেলেন।

এ ঘটনার পরদিন সকালে কোহিনুরকে তার বাড়ির পেছনের তেঁতুল গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। রাতে মিরাজ মিঞা মেয়েরে বকাঝকা করছিল বিয়েতে রাজি হয় নাই কেন? অবশেষে গলায় দড়ি দিয়েছিল কোহিনুর।

কোহিনুরের মায়ের বিলাপ, হামার রহমত তুমি উঠায় নিয়া গেছো আল্লাহ। কি দোষে যে মেয়ের মা হইছিলাম। ও কোহিনুরের বাপ, এখন শান্তি পাইছো? হামার কোহিনুর চইলা গেছে।

সেদিন সকালে আব্বার সঙ্গে আবার জমিদার বাড়ি যাই আপনার নানাকে দেখতে। তিনি তখন একটু ভালো কিন্তু কোহিনুরের মৃত্যুর সংবাদ ততক্ষণে গ্রামে চাউর হয়ে গেছে।

দেখলাম বেগম আম্মার চোখ লাল,
তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন।

জমিদার বললেন, বোঝার চেষ্টা করো কিভাবে কোনো সাক্ষী ছাড়া আমার মন চাইছে বলে আমি রায় দেই?

বেগম আম্মা বললেন, আমি আপনার সঙ্গে কোনো কথাই বলবো না, আপনি ভুল রায় দিয়া একটা মেয়ের সম্মান, জীবন দুইটাই খুন করছেন। এজন্য আপনি কষ্ট পাইবেন?

বেগম আম্মা ওই ঘর থেকে উঠে চলে গেলেন।
আমি আর আব্বাও চলে আসি।

এর ঠিক চৌদ্দ দিন পর অমাবস্যার রাতে গ্রামে তিনটা খুন হয়। সাইদুল, মঈনুদ্দিন, হোসেনমিঞা, তিনজনকেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় যার যার বাড়িতে।

কেউ জানে না কে খুন করছে বা কিভাবে? কোনো সাক্ষী পাওয়া যায় নাই। অনেকেই বলছে কোহিনুরের বাপ মারছে। অনেকেই বলছে উত্তরপাড়ার কলিম মারছে, তার সঙ্গে কোহিনূরের ভাব ছিল। এ পর্যন্ত বলে থেমে গেলেন তমিজ কবিরাজ।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

চলবে…

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com