শ্রমের মর্যাদা

প্রাথমিকে পড়াশোনার খরচ ছিল নামমাত্র। কিন্তু মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনাটা থেমে যাওয়ার জোগাড় হলো। আব্বা রাজমিস্ত্রির জোগালি করে যৎসামান্য উপার্জন করেন। এতে পাঁচজন মানুষের তিনবেলার অন্ন জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। আমার কৃষক বাবা নদী ভাঙনের স্বীকার হয়ে শহরতলিতে এসে থিতু হন। কিন্তু যেহেতু কৃষিকাজ ছাড়া অন্যকোন কাজ জানতেন না তাই অবশেষে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন।
আমাদের গ্রামীণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সবার বাবাই কমবেশি কৃষিকাজ, ছোটখাটো ব্যবসা, অথবা সরকারি অফিসের ছোট কোনো কেরানির চাকরি করতেন। আর যারা উচ্চশিক্ষিত বা উচ্চবিত্ত তারা ছেলেমেদের শহরে পাঠাতেন পড়তে। স্কুলে একবার মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফিস মিলে অনেক টাকা বাকি পড়েছিল। প্রধান শিক্ষক বললেন, তোমার আব্বাকে বলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার আব্বা লুঙ্গি পরে, গায়ে একটা হাফ হাত গেঞ্জি আর গামছা জড়িয়ে স্কুলে এসেছিলেন। আমি কি একটু লজ্জিত হয়েছিলাম?
উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত দিনমজুরদের সারি
বুয়েটে ভর্তি হবার পর সত্যিকার অর্থে আমি ভদ্রলোকদের সংস্পর্শে আসলাম। সেইসাথে সামাজিকতার সাথেও সরাসরি পরিচিত হলাম। ভদ্রলোকদের সমাজে সব কথা বলতে হয় না। তাদের ভাষায়ও কৃত্রিমতাতে ঠাসা। ব্যাকরণশুদ্ধভাবে কথা বলতে হয়। কিন্তু আমার কেন জানি এই ভন্ডামীগুলো মনে ধরে না। আমি যা বলি সরাসরি বলতে পছন্দ করি। এক বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। কথা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার বাবা কি করেন? আমি কোনো রাখঢাক না করে উত্তর করলামঃ আমার আব্বা রাজমিস্ত্রির জোগালি। এরপর প্রশ্নকর্তার চেহারা হয়েছিল দেখার মতো।
বুয়েট থেকে পাশ করে বাংলালিংক মোবাইল কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরি করি। বিয়ের একেবারে উপযুক্ত পাত্র বলতে যা বুঝায়। কনেও একজন দেখা হলো। কনেদের পক্ষের সবাই মোটামুটি রাজি। আমাদের ভাইয়েরা ততদিনে সবাই নিজ নিজ পরিচয় তৈরি করে নিয়েছে। মেজটা কুয়েট থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি খুঁজছে। ছোটটাও ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। আব্বাও ততদিনে অবসর নিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমি তখন বিয়ের বাজারে একজন আদর্শ পাত্র। কিন্তু বিয়ে আটকে যাচ্ছে ছেলের বাবার পরিচয় দেওয়ার মতো কোনো জীবিকা নেই বা ছিল না।
কৃষি এবং কৃষক বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভিত
জীবনের বহমানতায় একটা সময় প্রবাসে চলে আসলাম কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা না করেই। এসেই পড়লাম অকুল পাথারে। টাকা যায় করতে হবে কারণ আমি সাথে করে গিন্নী এবং মেয়েটাকেও নিয়ে এসেছি। একটা কারখানায় ক্লিনিংয়ের কাজ শুরু করে দিলাম। সেটাতে পরিশ্রম হতো অনেক। সেই প্রথম আব্বার পরিশ্রম সম্মন্ধে একটু ধারণা পেলাম। এরপর একসময় নিজের লাইনের কাজও জুটিয়ে ফেললাম। কিন্তু ঐ দুই মাসের ক্লিনিংয়ের কাজটা আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে দিলো যে অস্ট্রেলিয়াতে আমাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না।
এরপর বিভিন্ন দাওয়াত বা আড্ডাতে যখনই অস্ট্রেলিয়ার প্রথম জীবিকার প্রশ্ন উঠতো। আমি দৃঢ় গলায় বলতাম ক্লিনিং জবের কথা। এখনও বলি। আমি জানি প্রবাসী প্রজন্মের প্রায় সবারই প্রথম কাজটা এমনই। কিন্তু আমি টের পাই আমার উত্তরটা আড্ডার পরিবেশ ভারি করে তুলে। সামনাসামনি কেউ কিছু বলে না বা বললেও আমি অভ্যাসবশত অবজ্ঞা করেই চলি। কিন্তু গিন্নি এগুলো সহজে নিতে পারেন না। মাঝে মধ্যেই আমাকে প্রশ্ন করেন, মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে? ব্যাপারটা এমন যে এসব কাজের কথা বললে মেয়ের জন্য পাত্র পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু আমি সেদিকে মোটেও ভ্রূক্ষেপ করি না।
আমি এখন একটা কন্সট্রাকশন সাবকন্ট্রাক্টর কোম্পানিতে কাজ করি কুয়ান্টিটি সার্ভেয়ার হিসাবে। আমি একটু চেষ্টা চরিত্র করলেই প্রজেক্ট ম্যানেজার হয়ে যেতে পারি। কিন্তু ইদানিং আর জীবিকার এই দৌড়ে নিজেকে শামিল করতে ইচ্ছে করে না। চল্লিশ বছর বয়সের পরে সুস্থভাবে বেঁচে আছি এটাকেই পরম সৌভাগ্য বলে মনে করি। আর এখানে জব বদলালে বেতন যেমন বাড়ে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ট্যাক্সের হার। তাই দিনশেষে আয়ব্যয়ের হিসাবে তেমন কোন তফাৎ চোখে পড়ে না। আমিও আর চেষ্টা করি না। অনেকেই প্রথম পরিচয়ে ধরে নেয় আমি হয়তোবা প্রজেক্ট ম্যানেজার। আমিও আর সেই ভুলটা ভাঙাই না।
পাটুরিয়া ঘাটের জুতা পালিশওয়ালা
আমাদের বর্তমান কোম্পনি ব্রিক (ইট) এবং কংক্রিটের ব্লক সরবরাহ এবং স্থাপনের কাজ করে। আমাকে মাসে মাসে সাইটগুলো পরিদর্শনে যেতে হয় কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য। আমার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে বিল্ডারের কাছে আমাদের কোম্পানি জমা দেয়। সাইটে গেলে যারা সাইটে কাজ করে সবার সাথেই কুশল বিনিময় করি। তাদের হাসি দেখলে বুঝা যায় তারা নিজ নিজ কর্ম নিয়ে সুখী। আমাদের যারা সাইটে কাজ করে তাদের অস্ট্রেলিয়ানদের ভাষায় বলে ব্রিকি মানে তারা ব্রিক নিয়ে কাজ করেন। আমিও গর্বভরে তাদের বলি আমার বাবাও ব্রিকি মানে রাজমিস্ত্রি ছিলেন। ওরা খুব দ্রুতই আমাকে আপন করে নেয়।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণি বৈষম্য খুবই প্রকট হোক সেটা দেশে কিংবা বিদেশে। আমরা একটা অদ্ভুত সমাজ ব্যবস্থায় বেড়ে উঠি। শিক্ষিত মানুষেরা ভদ্রলোক আর অশিক্ষত মানুষেরা চাষাভুষা। আর তাদের কাজগুলোও মানহানিকর। এটাই মোটাদাগে আমাদের সমাজের স্ট্যান্ডার্ড। তাই জীবনের প্রয়োজনে যদিও কেউ বিভিন্ন ধরনের কায়িক পরিশ্রম করে থাকেন কিন্তু সেটাকে কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না সম্মান হারানোর ভয়ে।
অবশ্য তারাই মে দিবস আসলে শ্রমিকের এবং শ্রমের মর্যাদা নিয়ে গালভরা বুলিও দেন। আমাদের দ্বিচারিতা নিয়ে একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যায়। বাংলাদেশে সবচেয়ে ঘৃণিত পেশার নাম হলো মেথর কিন্তু প্রবাসে একজন প্লাম্বারের বা মোটাদাগে একজন ট্রেডির ঘণ্টাব্যাপী আয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমরা কেউই নিজেদের ছেলেমেয়েকে ট্রেডি বানাতে চাই না।
ফুটপাতে অপেক্ষারত দিনমজুরদের সারি
জীবিকা প্রসঙ্গে আমাদের বন্ধু তনুর বাবা এবং কুষ্টিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান আনোয়ার কাকুর একটা কথা মনে পড়ে। একবার আমার খালু সোহরাব গণি দুলাল আমাকে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আনোয়ার কাকু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার আব্বা কি করেন? আমি বলেছিলাম, আমার আব্বা রাজমিস্ত্রি কারণ ততদিনে আব্বা জোগালি থেকে মিস্ত্রি হয়ে গেছেন। আমার কণ্ঠস্বরে হয়তোবা একটু দ্বিধা প্রকাশ পেয়েছিল। সেটা ধরতে পারে উনি বলছিলেন, শোন ইয়াকুব তোমার আব্বা কৃষিকাজ করতেন বা রাজমিস্ত্রি ছিলেন এটা নিয়ে কখনোই মনে কোনো দ্বিধা রাখবে না। আমাদের প্রত্যেকেরই দুই তিন প্রজন্ম পেছনে গেলে দেখবে তারা সবাই কৃষক ছিলেন।
আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষা এবং সামাজিকতা নিয়ে বড় ধরনের গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের শ্রেষি-বৈষ্যমের উৎসসন্ধান করে তার মূলোৎপাটন এখন সময়ের দাবি। একটা দেশ তখনই এগিয়ে যায় যখন সামগ্রিকভাবে পুরো জনগোষ্ঠির জীবনমানের পরিবর্তন হয়। কিন্তু আমাদের উন্নয়ন কখনও সমানভাবে হয় না। উত্তরা থেকে রেললাইন পাড়ি দিয়ে আমাকে উত্তরখান যেতে হয় এখনও। উত্তরাতে রাত্রে একটা সময়ের পর সব রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তখনও উত্তরখানের রাস্তায় অনেক মানুষ জ্যামে আটকা পড়ে থাকেন। এসব মানুষই আসলে ঢাকা শহরের সব কাজ করে শহরটাকে চালু রেখেছেন।
ফুটপাতের পেপার বিক্রেতাও সমাজের অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেন
ঢাকা শহরে কাজের মানুষ নিয়ে অনেক ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। তারা একবার ঈদের ছুটিতে গেলে আর ফেরার নাম করে না। ঢাকা শহরের মানুষেরা ভুলে যায় যে এই মানুষগুলো কিন্তু তাদের আত্মীয়স্বজনকে আরও একটু স্বচ্ছলতা দেয়ার আশায় ঢাকায় এসে কায়িক শ্রম দিচ্ছেন। তাই দিনশেষে তাদের কাছেই ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব হয় না তাই বছরান্তে ঈদের সময় যেয়ে একটু বেশি সময় স্বজনদের পাশে থাকেন। ভদ্রলোকেরা এটা মেনেও নিতেও নারাজ। ব্যাপারটা এমন যে শুধুমাত্র তাদেরই স্বজন থাকতে পারে কাজের মানুষেদের সেই অধিকার নেই। চরম হাস্যকর তাদের এই আচার আচরণ।
জীবনের বহমানতায় অনেকরকমের পেশার মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছি। সেখানে আছে ফুটপাতের হকার, দিনমজুর, বাসের হেলপার, হোটেলের বেয়ারা, গাড়ির ড্রাইভার, ভিক্ষুক, ফুটপাতের উদ্বাস্তু এমন আরো অনেকে। এইসব মানুষের সাথে পরিচয়ে জীবন সম্মন্ধে অনেক কিছুই শিখেছি। আমার যেটা প্রয়োজন ওদের জন্য সেটা হয়তোবা বিলাসিতা। পাশাপাশি শিখেছি কত ন্যূনতম প্রয়োজন মিটিয়ে জীবন চালিয়ে নেওয়া যায়। আর পৃথিবীর কোনো কর্মই ছোট না। কারণ সবাই তার নিজ নিজ কর্ম দিয়ে পৃথিবীর ভারসাম্য ধরে রেখেছেন।
এমআরএম/জিকেএস