কৃষণ চন্দরের গাদ্দার
ঘৃণা ছাপিয়ে ভালোবাসার জয়গান

বইয়ের ভূমিকায় লেখক চমৎকার কিছু আসার বাণী শুনিয়েছেন। লিখেছেন এই বই রচনার শানে নযুল। লেখকের ভাষায়, ‘ভালো ও মন্দ দু’জাতীয় স্বপ্নই মানুষ দেখেছে। কোন স্বপ্নে থাকে উষর মরুকে আবাদ করে মানুষের বাসযোগ্য করার ইচ্ছা, কোন স্বপ্নে থাকে পরিপূর্ণ বরবাদ করার অভিপ্রায়। এক স্বপ্ন জমিতে ফসল ফলাতে চায়, আবার কোন পরিকল্পনায় সে ফসল পুড়িয়ে ছাই করে দেবার বাসনা নিহিত থাকে। আমি শুভ স্বপ্নের প্রত্যাশী, আমি তার মর্যাদা দিই, খারাপ স্বপ্নকে আমি অগ্রাহ্য করি, অশুভ বলে মন করি।’
‘মানুষের এই স্বপ্ন, এই সাধ অনেকটা মাটির মত, যে মাটিকে কুমোরের চাকে ফেলে খুশীমত অজস্র মূর্তি তৈরি করা যায়। আমি শুধু এ কথাই বলতে চাই, যে কাঁচা মাটির সম্মান কর। বিটোফেনের সুর নাও. ট্যাংক নিয়ো না, ভেনাসের স্ট্যাচু বানাও, যুদ্ধের নকশা কেন বানাবে? বেতার মারফত নিজের সংবাদ প্রিয়জনের কাছে পাঠাও, রকেট কেন তৈরি করবে?’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি কারু কাছ থেকে তার মাজহাব, তার কালচার, তার ইতিহাস, তার সভ্যতা ও ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য ছিনিয়ে নিতে চাই না। আমি চাই ঘৃণা দূর হোক। সবার মন থেকে ঘৃণা ধুয়ে মুছে ফেলতে হবে। এজন্যই ঘৃণার বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম। আর এজন্যই অতীতের ধংসস্তুপের চিত্র আমি এমনভাবে দেখতে চেয়েছি। আমি অতীতের জন্য অশ্রুপাত করছি না। আমি ভবিষ্যত ভাবনায় শঙ্কিত হচ্ছি আর আগত বিপদের সম্ভাবনা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছি।’
গল্পের শুরু উনিশশো সাতচল্লিশ সালের দোসরা আগস্ট। গল্পের নায়ক বা কথক একজন হিন্দু ব্রাম্মণ। তার নাম বৈজনাথ। গাদ্দারের গল্প আসলে বৈজনাথের অভিজ্ঞতার সমষ্টি এবং তার অন্তরের লুক্কায়িত আকাংখার প্রকাশ। বৈজনাথের নানীবাড়ি থেকে গল্প বয়ে চলেছে নব্য সৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানের অলিতে গলিতে। এরপর এসেছে ইরাবতী নদীর কথা। যে যদি হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তানকে ভাগ করে বয়ে চলেছে। যে নদীর ওপরের পুল দিয়ে একপার থেকে অপরপাড়ে মানুষ আসা যাওয়া করে। একদিক থেকে আসে হিন্দু শরণার্থীরা আর অন্যদিক থেকে আসে মুসলমান মোহাজেররা।
সেই পুলের ওপর তদারকের ভূমিকায় আছে একজন ইংরেজ সৈন্য। সেই ইংরেজ সৈন্য কামান নিয়ে পুল পাহারা দেয়। আর প্রতি দু ঘণ্টার জন্য একপাশ করে খুলে দেয়। দু ঘণ্টার মধ্যে যারা অপর পারে যেতে পারে তারা বেঁচে যায়। কিন্তু যারা যেতে পারে না তাদের কপালে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের অর্ধেক সদস্য অপর পারে চলে গেছে আর অর্ধেক সদস্য অন্য পারে আটকে আছে। এই চিত্রটা যেন সমগ্র ভারত রাষ্ট্রকে দুই ভাগ করে হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান বানানোর রূপক চিত্র।
দাঙ্গার আতংকে মানুষের মন থেকে মানবতা একেবারে দূরীভূত হয়ে যায়। তখন মা মেয়েকে ভুলে, মেয়ে বাপকে ভুলে, বাপ আপন সন্তানকে ভুলে যে যার মতো পালতে শুরু করে। সবাই শিকারীতাড়িত জানোয়ারের মত শরীর ও মনের সমগ্র শক্তি দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালাচ্ছে। সবার বাহ্যিক চেহারা আপাতঃদৃষ্টিতে স্বাভাবিক দেখালেও সবার মনেই আতংক জমে আছে, তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাচ্ছিল। তাদের দৃষ্টিতে সেই শঙ্কা, মৃত্যুহীন শীতলতা বিরাজ করছিল। মৃত্যুপথযাত্রীর মুখ থেকে শেষ যে নাম উচ্চারিত হয়েছিল সে নাম ঈশ্বরের। হত্যাকারীদের মুখেও ছিল তাঁরই নাম। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় যে প্রতিপক্ষের তরুণীকে ধর্ষণের জন্য তরুণের দল লাইনে দাঁড়ায় রেশনের লাইনের মতো করে।
পালানোর সময় বৈজনাথদের বাসার পালিত কুকুর রুমী তার পিছু নেয়। তার উদ্দেশ্যে বৈজনাথের কথাগুলো যেন সমগ্র মানবসভ্যতার নিকট প্রশ্নের আকারে ধরা দেয়। তার ভাষায়, ‘তুই কি মানুষ যে প্রাণের ভয় করছিস। এসব তো সভ্যতার উপকরণ - এই উচু সম্প্রদায় আর বর্ণের বিভেদ। এই তলোয়ার তো বিরাট সভ্যতা রক্ষার জন্য বানানো হয়েছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে এ অস্ত্রে তোর গলা কাটা হবে না- তুই তো সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণের জীব নোস্। শোকর কর তুই। তুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্পৃশ্য জীব। কৃতজ্ঞতা জানা ঈশ্বরকে যে তুই মজহাবের মানে জানিস না। তুই কখনো সন্ধ্যা আহ্নিক করিসনি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িসনি। গীর্জায়, মন্দিরে, মসজিদে যাসনি, তুই স্বাধীনতার প্রয়োজন বুঝিসনি। তুই কখনো কোনো রাজনীতি করা নেতার বক্তব্য শুনিসনি। শুকরিয়া জানা যে তুই কুকুর। মানুষ নোস্।’
দুজন মুচী যারা ছোটবেলায় বন্ধু ছিল দেশভাগের দাঙ্গার সময় তাদের আবার দেখা হয়ে যায়। তাদের মানচিত্র বদলালেও তাদের তো পেশার বদল হবে না, হবে না ভাগ্যের বদলও। আহমদ ইয়ার এবং নাথুর মনে একই প্রশ্ন খেলা করে- এসব ঝগড়া কি জন্য? একজন প্রেমিক ইমতিয়াজ তার প্রেমিকা পার্বতীর জন্য হিন্দুস্তানে থেকে গিয়েছিল কিন্তু তার কপালেও একই পরিণতি নেমে এসেছিল। তাই পার্বতী চলে যাচ্ছে বাপ দাদার ভিটা হিন্দুস্তান ছেড়ে পাকিস্তানে তার প্রেমিকের পরিবারের কাছে।
সেখানে যেয়ে সেই পরিবারে সে ছেলের বৌয়ের মত থাকার পরিকল্পনা করে। তখন বৈজনাথ তাকে বলে, ‘পাগলী কোথাকার! এই পৃথিবীতে প্রেমের জন্য কেউ মরে না কি? মানুষ অর্থের জন্য মরে, যশের জন্য, ঐশ্বর্যের জন্য, শক্তির জন্য, দেশের জন্য, সম্প্রদায়ের জন্য, পরকালের শান্তির জন্য মরে কিন্তু মিথ্যা কল্পনার জন্য মরে যাওয়া কি সাজে?’
দাঙ্গার ভয়াবহতা দেখে মানুষ হিসাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে মানবজাতি হিসাবে নিজের সভ্যতাকে প্রশ্ন করেছে বৈজনাথ। কিসের জন্য আমি মাথা উচু করে চলেছি? কিসের জন্য আমরা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বড়াই করি? নিজের অপরাধ স্বীকারের বেলায় সঙ্কোচ বোধ কেন আমাদের? ঐ ঐতিহ্য সম্পূর্ণ নয়, পরিপূর্ণ নয়। এর মধ্যে কি গভীর ঘৃণার বীভৎস অন্ধকার। হিন্দু সংস্কৃতি, ইসলামী তাহজীব, খ্রীষ্টীয় কালচার, শিখ ও ইউরোপীয় সভ্যতা- এদের চোখ ঝলসানো ঐতিহ্যের আবরণের ভেতর কী ফাঁপা গহ্বর!
কী প্রচণ্ড অন্ধকার! কেউ সে কথা বলে না, কেউ স্বীকার করতে চায় না, প্রকাশ করতে চায় না এই হীনতা, দৈন্য। তাদের মুখের ভাষা পরম রমণীয়, চাকচিক্যময় আবরণে আচ্ছাদিত। কেউ যদি সাহস করে বাইরের আপাত বর্ণাঢ্য আচ্ছাদন সরিয়ে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করতে চায়, তাকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়, পেছন থেকে বল্লম ছুঁড়ে শেষ করে দেওয়া হয়।
নির্দিষ্ট সময়ে পুল পার হতে ব্যর্থ হওয়া জনগোষ্ঠির ওপর প্রতিপক্ষের হামলার পর জায়গাটা একেবারে শ্মশানে পরিণত হয়। চারদিকে অসংখ্য লাশ। বৃদ্ধের শব, নারীর মৃতদেহ। শিশুর মৃতদেহ - উলটো, সোজা, কাৎ হয়ে থাকা নগ্ন লাশ, হাতহীন লাশ, চোখ খুলে থাকা, চোখ বন্ধ লাশ, কোন লাশের হাতে দুধের বোতল - অজস্র। চারিপাশে সেই শবস্তুপ যা জীবনের সমস্ত বিষ পান করে চিরদিনের জন্য শুয়ে পড়েছে। বৈজনাথ হিন্দু হয়েও অন্তরের তাড়নায় অবশেষে এক মুসলিম শিশুকে জীবিত উদ্ধার করে এই লাশের স্তুপ থেকে। আমার মনেহয় এই জন্যই লেখক এই উপন্যাসের নামকরণ করেছেন - গাদ্দার।
এসব লাশের স্তুপে দাঁড়িয়েও বৈজনাথ আশায় বুক বাঁধে। স্বপ্ন দেখে এক সোনালী ভবিষ্যতের। তার ভাষায়, ‘আমি সেই আগামী দিনের কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম, যা আজ নেই, কিন্তু ভবিষ্যতে আসবে। যখন হিন্দুস্তান হবার আয়োজন হয়েও কোন হিন্দুস্তানই সৃষ্ট হবে না, কোন পাকিস্তান হবে না, কোন ইরান, কোন আফগানিস্তান, কোন আমেরিকা, কোন রাশিয়া, বা চীন বা জাপান - হবে না। সেদিন সমগ্র পৃথিবী সর্বস্তরের মানুষের বাসের উপযোগী একটি ছোট গ্রামের মত হয়ে গড়ে উঠবে। সেখানে সারা দুনিয়ার মানুষ যে যার আপন জায়গায়, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি নিয়ে প্রতিবেশী হয়ে স্বাধীনভাবে চিরকালের জন্য সুখ শান্তিতে কাটাতে পারবে।’ এভাবেই আসলে লেখকেরা আমাদেরকে সবসময় সবকিছু ছাপিয়ে মানবতার বাণী শোনান, শোনান ভ্রাতৃত্বের জয়গান।
এমআরএম/জিকেএস