বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:২৬ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৫
কামতা বিজয়ের স্মরণে হোসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত পানবাড়ি মসজিদ ছবি: উইকিপিডিয়া

মওলবি আশরাফ

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ—বাংলার ইতিহাসে এমন এক শাসক, যার নাম শুনলে মধ্যযুগের সমৃদ্ধ বাংলা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তিনি হোসেনশাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসক ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তার আমলই ছিল মধ্যযুগীয় বাংলার সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়।

জন্ম ও শৈশব

তার জন্মসাল ও পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অনেকে ঐতিহাসিক মনে করেন তার বাবা আরব থেকে এসেছিলেন, এবং তিনি নবীজির (সা.) বংশধর। ঐতিহাসিক নীতিশ সেনগুপ্তের মতে তার মা ছিলেন বাঙালি, আর এ কারণেই তিনি তার শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শৈশব সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য কম। একটি মত হলো—তার পরিবার বঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বাধ্য হয়ে কামতা অঞ্চলে চলে যায়। আবার কেউ বলেন তারা পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চলের চান্দপুর/চান্দপাড়া এলাকায় স্থায়ী হন। তিনি স্থানীয় কাজির অধীনে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীতে সেই কাজির কন্যাকে বিয়ে করেন। 

যেভাবে বাংলার সুলতান হন হোসেন শাহ

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কীভাবে হাবশি সুলতান শামসুদ্দিন মোজাফফর শাহের উজিরের পদ লাভ করেছিলেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায় না। অনেক বলেন, হাবশিরা ক্ষমতা দখল করার আগে তিনি সুলতান জালালউদ্দিন ফাতেহ শাহের সভাসদ ছিলেন। হাবশিরা ক্ষমতা দখল করার পর তাকে উজির বানায়।

বাংলার ক্ষমতায় থাকা হাবশিরা

হাবশিরা ইলিয়াস শাহী রাজবংশের শেষ সুলতান জালালউদ্দিন ফাতেহ শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিল এবং তাদের শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ছয় বছর। ছয় বছরেই হাবশিদের অত্যাচার-নির্যাতনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।

এক পর্যায়ে হাবশি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হলে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ প্রথমত গোপনে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেন। পরবর্তীতে তিনি প্রকাশ্যে তাদের নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। হাবশি সুলতান মোজাফফর শাহ নিহত হলে হোসেন শাহ সুলতান হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

হোসেন শাহের শাসনকাল

ক্ষমতায় বসে সুলতান হোসেন শাহ প্রথমেই রাজধানীর নিরাপত্তা ও শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠন করেন—লুটতরাজে জড়িত বারো হাজার সৈন্যকে মৃত্যুদণ্ড দেন, প্রাসাদের পাইক বাহিনীকে ভেঙে দেন এবং হাবশি অভিজাতদের সরিয়ে তুর্কি, আরব, আফগান ও বাঙালি অভিজাতদের সমন্বয়ে নতুন প্রশাসন গড়ে তোলেন।

তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিল ধর্মপ্রাণ মুসলিম; শাসনকার্যে তিনি কখনও হিন্দু জনগণের প্রতি বৈরী নীতি গ্রহণ করেননিবরং হিন্দু জমিদার, সেনাপতি এবং মুনশিদের প্রশাসনে যুক্ত করে তিনি বাংলার সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করেন। এই নীতি তাকে জনসমর্থন এনে দেয় এবং শাসনব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তি দেয়।

১৪৯৮ সালে তিনি কামরূপ ও আসাম দখলে নেন। পরে ১৫১৬ সালের দিকে উড়িষ্যাও বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহের মুদ্রা

উত্তর ভারতের লোদি সাম্রাজ্যের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত তিনি কূটনৈতিকভাবে সামাল দেন এবং গঙ্গার পশ্চিম অঞ্চল লোদিদের হাতে রেখে পূর্ব অঞ্চল নিজের অধীনে রাখেন। তার শাসনামলে জয়পুর-আজমগড় অঞ্চলে মসজিদ নির্মাণসহ উত্তর ভারতে বাংলার প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

ত্রিপুরার সাথে তার চারবার যুদ্ধ হয়; শেষ পর্যায়ে ত্রিপুরার কিছু এলাকা বাংলা সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আরাকানের সঙ্গে সংঘাতেও তিনি সফল হন এবং চট্টগ্রামসহ উত্তর আরাকান বাংলা সালতানাতের শাসনাধীন হয়। তার আমলে সোনারগাঁও ছিল সমৃদ্ধ প্রশাসনিক কেন্দ্র।

এক কথায় বললে—আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন এমন এক সুলতান, যিনি শক্ত হাতে ক্ষমতা ধরে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে রাষ্ট্রের ভিত্তি বানিয়েছিলেন। ন্যায়, সাম্য ও উন্নয়নকে একসূত্রে গেঁথে তিনি এক স্বর্ণযুগ নির্মাণ করেছিলেন।

সাংস্কৃতিক অবদান

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ শুধু সামরিক সাফল্যের রাজা ছিলেন না—তিনি শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক, জনকল্যাণমূলক বহু কাজের উদ্যোক্তা এবং কালজয়ী বহু স্থাপত্যের নির্মাতা ছিলেন। তাঁর শাসনামলে বাংলার বাণিজ্য, কৃষি, সাহিত্য ও স্থাপত্যশিল্প অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি অর্জন করে।

সোনা মসজিদ

তার শাসনাধীন চট্টগ্রামের গভর্নর পারাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কাবিন্দ্র পরমেশ্বর পাণ্ডববিজয় রচনা করেন, যা মহাভারতের বাংলা রূপান্তর। পরবর্তীতে তার পুত্র ছুটি খানের অনুপ্রেরণায় শ্রীকর নন্দিও মহাভারতভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেন। একই সময়ে বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গল রচনা করেন এবং তিনি হোসেন শাহকে ‘নৃপতি তিলক’ ও ‘জগৎ-ভূষণ’ বলে উল্লেখ করেন। তার দরবারের যশরাজ খান বৈষ্ণব পদ রচনা করেন এবং তাতেও সুলতানের প্রশংসা করা হয়েছে। স্থাপত্যশিল্পেও তার অবদান উজ্জ্বল—উদাহরণ হিসেবে গৌড়ের ‘ছোট সোনা মসজিদ’ উল্লেখযোগ্য।

মৃত্যু

১৫১৯ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ইন্তেকাল করেন। এরপর তার বড় ছেলে নুসরত শাহ বাংলার সুলতান হন এবং হোসেন শাহী বংশের শাসন অব্যাহত থাকে।

ওএফএফ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।