নবিজী (সা.) যেভাবে বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করেছেন

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৮:৪৬ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতিটি সৃষ্টি স্বাধীনতা পছন্দ করে। আর এ কারণেই ইসলামে বিজয় ও স্বাধীনতার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। বিজয় এবং স্বাধীনতা মহান সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত।

ইসলাম চায় সব মানুষ যেন স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারে। ইসলাম আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, আমরা যেন আমাদের ভূখণ্ড তথা মাতৃভূমিকে ভালোবাসি।

বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ থেকেও আমরা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং বিজয়ের আনন্দ উদযাপনের দৃষ্টান্ত পেয়ে থাকি। তাই দেশের বিজয় দিবস উদযাপন হোক আমাদের গৌরব।

স্বাধীনতার ইসলামি স্বরূপ হচ্ছে- মানুষ মানুষের গোলামি করবে না। মানুষ একমাত্র তার সৃষ্টিকর্তার গোলামি করবে। আমাদের মাতৃভূমি বাংলার বিজয়ের পেছনে রয়েছে অনেক ত্যাগ; দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত।

আল্লাহ তাআলা তাঁর জমিনে পরাধীনতা পছন্দ করেন না। যেখানে স্বাধীন ভূখণ্ড নেই সেখানে ধর্ম নেই আর যেখানে ধর্ম নেই সেখানে কিছুই নেই। তাই ইসলামে গোলামীর জিঞ্জির থেকে বিজয়ের গুরুত্ব অতি ব্যাপক।

সৃষ্টির প্রতিটি জীব স্বাধীনতা ও বিজয় পছন্দ করে। পৃথিবীতে এমন কোন জাতি বা জীব পাওয়া যাবে না যারা পরাধীন থাকতে চায়। তাই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সবাই কতই না চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে থাকে।

আর এই স্বাধীনতার জন্যই নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে মক্কাকে করেছিলেন স্বাধীন। তিনি সবাইকে বিজয়ের প্রকৃত আনন্দ উপভোগ করতে দিয়েছিলেন।

বিজয়কে কেন্দ্র করে পবিত্র কুরআনে দু’টি সুরা রয়েছে। একটি সুরাতুল ‘ফাতাহ’ (বিজয়), অন্যটি সুরা আন-নাসর

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, তখন মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা (ইসলামে) প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা কর। আর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।’ (সুরা আন-নাসর : আয়াত ১-৩)

এখানে বিজয়ের যে আনন্দ প্রকাশ তা আল্লাহর শুকরিয়া, আল্লাহর পবিত্রতা ও বড়ত্ব বর্ণনা করার মাধ্যমেই আমাদের দেয় ইসলাম। তাইতো মক্কা বিজয়ের আনন্দে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  সেদিন ক্ষমার ঘোষণা করেছিলেন।

মক্কা বিজয়ের সময় আবু সুফিয়ানের একটি ঘটনাও ইতিহাসে সংরক্ষিত আছে। কী সেই ঘটনা?

আবু সুফিয়ানকে যখন গ্রেফতার করে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে উপস্থিত করা হয়, তখন তিনি তাকে বলেন, বলো কি চাও?

সে বললো, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কি আপনার জাতির প্রতি দয়া করবেন না। আপনিতো পরম দয়ালু ও মহানুভব এছাড়া আমি আপনার আত্মীয়ও বটে ভাই হই তাই আমাকে সম্মান দেখানোও প্রয়োজন। কেননা, এখন আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, যাও মক্কাতে ঘোষণা করে দাও; যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার ঘরে আর কতজনের সংকুলান হবে। এতোবড় শহর তা আমার ঘরে আর কতজন আশ্রয় নিতে পারবে।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘ঠিক আছে, যে ব্যক্তি কাবা শরিফে আশ্রয় নেবে তাকেও নিরাপত্তা  দেওয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! কাবা শরিফও ছোট্ট একটি জায়গা সেখানেইবা কতজন আশ্রয় নেবে তারপরও লোক বাকি থেকে যাবে।

তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন, যে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে, তাকেও নিরাপত্তা  দেওয়া হবে।

এবার আবু সুফিয়ান বলল- হে আল্লাহর রাসুল! যারা রাস্তা-ঘাটে বসবাস করে তারা কোথায় যাবে?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বললেন, ঠিক আছে, তারপর তিনি একটি পতাকা বানান এবং বলেন, এটি  বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা। তাকে সঙ্গে নিয়ে এ পতাকাসহ চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করো, যে এ পতাকার নিচে এসে দাঁড়াবে; পতাকার নিচে আশ্রয় নেবে তাকেও প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে।

আবু সুফিয়ান বললেন, ঠিক আছে এবার যথেষ্ট হয়েছে। আমাকে গিয়ে ঘোষণা করার অনুমতি দিন। যেহেতু মক্কার কুরাইশ নেতারাই অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। তাই ভয় পাবার কোনো কারণই ছিল না।

আবু সুফিয়ান মক্কায় প্রবেশ করে ঘোষণা করেন, ‘নিজ নিজ ঘরের দরজা বন্ধ রাখো আর কেউ বাইরে এসো না। কাবা শরিফে চলে যাও এবং হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকার নিচে যারা আশ্রয় নেবে তাদের সবাইকে নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তাদের সবার প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে এবং কিছুই বলা হবে না। আর তোমাদের অস্ত্র সমর্পণ কর। ফলে মানুষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করা আরম্ভ করে আর হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা তলে সমবতে হতে আরম্ভ করে।

এরূপ প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্ত হজরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের এটিও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে-

‘তোমরা যাকে দাস মনে করতে, তিনি যার কোনো গোত্র বা আত্মীয়স্বজন মক্কায় ছিল না। তিনি একেবারেই নিঃস্ব এবং পায়ে ঠেলার মত মানুষ মনে করে তোমরা তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছ।

আজ শুন এবং দেখে নাও! তোমরা শক্তিশালী নও, তোমরা সফলকামী নও, পরাক্রমশালী তোমরা নও বরং মহা পরাক্রমশালী হচ্ছেন মুহাম্মাদু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহ। আর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর বৈশিষ্ট্যাবলী অবলম্বন করেছেন এবং এ গুণাবলী ধারণ করেছেন। এভাবে বিজয় লাভের পর প্রতিশোধ নেন, যার মাঝে ছিল না কোনো অহংকার।

পুরো বিশ্বের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অবলোকন করেছে, কীভাবে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বত্র স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরাধীনতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য তিনি যেমন লড়েছেন তেমনি তিনি সকলকে করেছিলেনও স্বাধীন।

বিজয়ের এ দিনে আমাদের করণীয়-

বিজয় দিবসে আমরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা, দোয়া এবং শহিদদের আত্মার মাগফিরাত ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে উদযান করার চেষ্টা করব।

নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মক্কা বিজয়ের আনন্দে প্রথমে তিনি নফল নামাজ আদায় করেছিলেন। আমরাও রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া ও বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করতে পারি

আমাদের প্রত্যাশা বিশ্বজুড়ে সব মুসলিম আবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্বময় আবার ইসলামের বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করবে। বিজয়ের আনন্দে আবার উদ্ভাসিত হবে মুসলিম উম্মাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বিজয়ের প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।