তারাবিহের আলোচনা

যে কারণে সাহাবিরা নিজেদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:০০ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২৩

১৪৪৪ হিজরির রমজান মাসের অষ্টম তারাবিহ আজ। আজকের তারাবিহতে সুরা তওবার ৯৪ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত, সুরা ইউনুস এবং সুরা হুদের প্রথম ৫ আয়াত পর্যন্ত পড়া হবে। সে সঙ্গে ১১তম পারার তেলাওয়াত সম্পন্ন হবে। আজকের তারাবিহতে পড়া হবে তাবুক অভিযানে না যাওয়া সাহাবিদের তওবা কবুলের ঘটনাসহ তিন নবির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও উপদেশ।

অষ্টম তারাবিহে হজরত নুহ, মুসা ও ইউনুছ আলাইহিস সালামের ঘটনার বর্ণনা করা হবে। পবিত্র মদিনা নগরীকে ইসলামি রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে এ সুরায় রয়েছে গভীর সম্পর্ক। হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পর্কিত আলোচনা পড়া হবে আজ। সুরাগুলো সংক্ষিপ্ত আলোচ্য সূচি তুলে ধরা হলো-

সুরা তওবা (৯৪-১২৯)

কয়েকজন মুসলমানের তওবা কবুল হওয়ার বর্ণনায় ১৬ রুকুর সুরাটি মদিনায় অবতীর্ণ হয়। আজকের তেলাওয়াতে তওবা কবুল ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং তাঁদের জন্য জান্নাত লাভের ঘোষণা আলোচিত হয়েছে। তবে শুরুতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বিশ্বনবিকে তাবুক অভিযান থেকে ফেরার পথে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, মদিনায় পৌঁছে মুনাফেকরা বিভিন্ন অজুহাত পেশ করবে। আর বাস্তবেই তাই ঘটেছিল। তারা মিথ্যা কসম খেয়ে নিজেদের স্বপক্ষে কথা বলছিল। আল্লাহ বলেন-

یَعۡتَذِرُوۡنَ اِلَیۡکُمۡ اِذَا رَجَعۡتُمۡ اِلَیۡهِمۡ ؕ قُلۡ لَّا تَعۡتَذِرُوۡا لَنۡ نُّؤۡمِنَ لَکُمۡ قَدۡ نَبَّاَنَا اللّٰهُ مِنۡ اَخۡبَارِکُمۡ ؕ وَ سَیَرَی اللّٰهُ عَمَلَکُمۡ وَ رَسُوۡلُهٗ ثُمَّ تُرَدُّوۡنَ اِلٰی عٰلِمِ الۡغَیۡبِ وَ الشَّهَادَۃِ فَیُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ

'তুমি যখন তাদের কাছে ফিরে আসবে, তখন তারা তোমাদের কাছে ছল-ছুতা নিয়ে উপস্থিত হবে; তুমি বলো, ছল কারো না, আমি কখনো তোমাদের কথা শুনবো না; আমাকে আল্লাহ তাআলা তোমাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে দিয়েছেন। আর এখন তোমাদের কর্ম আল্লাহই দেখবেন এবং তাঁর রাসুল। তারপর তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে সেই গোপন ও আগোপন বিষয়ে অবগত সত্তার কাছে। তিনিই তোমাদের বাতলে দেবেন যা তোমরা করছিলে।' (সুরা তওবা : আয়াত ৯৪)

এ আয়াতে সে সব লোকদের আলোচনা করা হচ্ছে, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জেহাদ থেকে ফিরে আসার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে নিজেদের জেহাদে অংশগ্রহণ না করার পক্ষে মিথ্যা ওজর আপত্তি পেশ করছিল। এ আয়াতগুলো মদিনায় ফিরে আসার আগেই অবতীর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে পরবর্তী সময়ে সংঘটিত ঘটনার সংবাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, আপনি যখন মদিনায় ফিরে যাবেন, তখন মুনাফিকরা ওজর-আপত্তি নিয়ে আপনার কাছে আসবে। (ফাতহুল কাদির)

বস্তুতঃ ঘটনাও তাই ঘটেছিল। এ আয়াতগুলোতে তাদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, যখন এরা আপনার কাছে ওজর আপত্তি পেশ করার জন্য আসে, আপনি তাদেরকে বলে দিন যে, মিথ্যা ওজর পেশ করো না। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আব্দুল্লাহ ইবন কাব ইবন মালেক বলেন, আমি কাব ইবন মালেককে তাবুকের যুদ্ধে পিছিয়ে থাকা সম্পর্কে বলতে শুনেছি, আল্লাহর শপথ! ঈমান আনার পরে আল্লাহ আমার উপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সত্য কথা বলার মত নেআমত ছাড়া আর অন্য কিছু দেননি। যখন অপরাপর মিথুকরা মিথ্যা কথা বলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। যখন তার কাছে অহি নাজিল হয়েছিল এ বলে যে, তোমরা তাদের কাছে ফিরে আসলে অচিরেই তারা তোমাদের কাছে আল্লাহর শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের উপেক্ষা কর। কাজেই তোমরা তাদের উপেক্ষা কর; নিশ্চয়ই তারা অপবিত্র এবং তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ জাহান্নামই তাদের আবাসস্থল। তারা তোমাদের কাছে শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও। এরপর তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো ফাসিক সম্প্রদায়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না।’ (বুখারি ৪৬৭৩)

আমরা তোমাদের কথাকে সত্য বলে স্বীকার করব না। কারণ আল্লাহ তাআলা অহির মাধ্যমে আমাদেরকে তোমাদের মনের গোপন ইচ্ছা বাতলে দিয়েছেন। ফলে তোমাদের মিথ্যাবদিতা আমাদের কাছে প্রকৃষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই কোন রকম ওজর আপত্তি বর্ণনা করা অর্থহীন। তবে এখনও অবকাশ রয়েছে যেন তারা মুনাফেকি পরিহার করে সত্যিকার মুসলিম হয়ে যায়। ফলে আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসুল তোমাদের কার্যকলাপ দেখবেন যে, তা কি এবং কোন ধরনের হয়। যদি তোমরা তাওবাহ করে নিয়ে সত্যিকার মুসলিম হয়ে যাও, তবে সে অনুযায়ীই ব্যবস্থা করা হবে; তোমাদের পাপ ক্ষমা হয়ে যাবে। অন্যথায় তা তোমাদের কোনো উপকারই সাধন করবে না।’ (তাবারি, ফাতহুল কাদির)

অলসতার কারণে যে সাহাবিরা তাবুক অভিযানে যাননি

আবার অলসতার কারণে তিনজন ঈমানদার তাবুক অভিযানে যেতে পারেনি। তারা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কোনো ওজর পেশ না করে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেছে যে, কোনো ওজরের কারণে নয় বরং অলসতার কারণে তারা তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণ করেনি। তাদের অলসতার জন্য শাস্তিস্বরূপ তাদের ৫০ দিন বয়কট করে রাখা হয়। আবার সত্য প্রকাশে তাদের দেওয়া হয় বিশেষ পুরস্কার। আল্লাহ বলেন-

وَ اٰخَرُوۡنَ اعۡتَرَفُوۡا بِذُنُوۡبِهِمۡ خَلَطُوۡا عَمَلًا صَالِحًا وَّ اٰخَرَ سَیِّئًا ؕ عَسَی اللّٰهُ اَنۡ یَّتُوۡبَ عَلَیۡهِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

'আর কোন কোন লোক রয়েছে যারা নিজেদের পাপ স্বীকার করেছে, তারা মিশ্রিত করেছে একটি নেককাজকে ও অন্য একটি বদকাজের সঙ্গে। শিগগিরই আল্লাহ হয়ত তাদের ক্ষমা করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।' (সুরা তওবা : আয়াত ১০২)

এরা সেসব একনিষ্ঠ মুসলিম, যারা কোনো ওজর আপত্তি ছাড়াই শুধু শৈথিল্যের কারণে তাবুক অভিযানে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে শরিক হয়নি। তবে পরে তারা আপন ভুল বুঝতে পারে এবং তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়।

যে দশজন মুমিন বিনা ওজরে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণে বিরত ছিলেন তাঁদের সাত জন মসজিদের খুঁটির সঙ্গে নিজেদের বেঁধে নিয়ে মনের অনুতাপ অনুশোচনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এদের উল্লেখ রয়েছে এ আয়াতে। হজরত ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘দশজন সাহাবি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তাবুকের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। এদের মধ্যে সাতজন নিজেদের মসজিদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, এরা কারা, যারা নিজেদের খুঁটির সঙ্গে বেঁধেছে? সাহাবায়ে কিরাম বললেন, এরা আবু লুবাবা ও তার কিছু সাথী। যারা আপনার সঙ্গে যাওয়া থেকে পেছনে ছিল। তারা নিজেরা নিজেদের বেঁধে নিয়েছে এ বলে যে, যে পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমাদের বাঁধন খুলে দেবেন এবং আমাদের ওজর কবুল করবেন, ততক্ষণ আমাদের যেন কেউ না খুলে দেয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমিও তাদের বাঁধন খুলব না, তাদের ওজর গ্রহণ করবো না, যতক্ষণ না আল্লাহ নিজেই তাদের ছেড়ে দেন বা ওজর গ্রহণ করেন। তারা আমার থেকে বিমুখ ছিল, মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যায়নি। যখন তাদের কাছে এ কথা পৌছল তারাও বলল, আমরাও আল্লাহর শপথ নিজেদের ছাড়িয়ে নেব না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ আমাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা না করেন। তখন এ আয়াত নাজিল হয়। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে লোক পাঠিয়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেন। (আত-তাফরিরুস সহীহ)

ঘটনা যদিও সুনির্দিষ্ট তথাপি এর দাবি ব্যাপক। যারাই ভাল ও মন্দ আমলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে তাদের ক্ষেত্রেই এ আয়াত প্রযোজ্য। যেমন হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত সামুরা ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বলেছেন, গত রাতে আমার কাছে দুজন এসেছেন, তারা আমাকে উঠালেন, তারপর আমাকে নিয়ে এমন এক নগরীতে নিয়ে গেলেন যার একটি ইট স্বর্ণের অপরটি রৌপ্যের। সেখানে আমরা কিছু লোক দেখলাম, যাদের শরীরের একাংশ এত সুন্দর যত সুন্দর তুমি মনে করতে পার। আর অপর অংশ এত বিশ্রী যত বিশ্রী তুমি মনে করতে পার। তারা দুজন তাদেরকে বলল, তোমরা ঐ নালাতে গিয়ে পতিত হও। তারা সেখানে পড়ল। তারপর যখন তারা আমাদের কাছে এলো, দেখলাম যে, তাদের খারাপ অংশ চলে গেছে, এরপর ভীষণ সুন্দর হয়ে গেছে। তারা দুজন আমাকে বলল, এটা হলো জান্নাতে আদন। আর ওখানেই আপনার স্থান। তারা দুজন বলল, আর যাদেরকে আপনি অর্ধেক সুন্দর আর বাকী অর্ধেক বিশ্রী দেখেছেন, তারা হচ্ছেন, যারা এক সৎকাজের সঙ্গে অন্য অসৎকাজ মিশিয়ে ফেলেছে।’ (বুখারি ৪৬৭৪)

জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের সম্পদ ক্রয়

আল্লাহ তাআলা মুমিনদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়। আর সে কথাও ঘোষণা করেছেন এভাবে-

اِنَّ اللّٰهَ اشۡتَرٰی مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ وَ اَمۡوَالَهُمۡ بِاَنَّ لَهُمُ الۡجَنَّۃَ ؕ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَیَقۡتُلُوۡنَ وَ یُقۡتَلُوۡنَ ۟ وَعۡدًا عَلَیۡهِ حَقًّا فِی التَّوۡرٰىۃِ وَ الۡاِنۡجِیۡلِ وَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ وَ مَنۡ اَوۡفٰی بِعَهۡدِهٖ مِنَ اللّٰهِ فَاسۡتَبۡشِرُوۡا بِبَیۡعِکُمُ الَّذِیۡ بَایَعۡتُمۡ بِهٖ ؕ وَ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন (এর বিনিময়ে) যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। অতএব তারা মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কোরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আর নিজ ওয়াদা পূরণে আল্লাহর চেয়ে অধিক কে হতে পারে? সুতরাং তোমরা (আল্লাহর সঙ্গে) যে সওদা করেছ, সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং সেটাই মহাসাফল্য।' (সুরা তওবা: আয়াত ১১১)

আয়াতের শুরুতে ক্রয় শব্দের ব্যবহার করা হয়। মুসলিমদের বলা হচ্ছে যে, ক্রয় বিক্রয়ের এই সওদা তোমাদের জন্য লাভজনক ও বরকতময়; কেননা, এর দ্বারা অস্থায়ী জান-মালের বিনিময়ের স্থায়ী জান্নাত পাওয়া গেল। মালামাল হলো আল্লাহরই দান। মানুষ শূন্য হাতেই জন্ম নেয়। তারপর আল্লাহ তাকে অর্থ সম্পদের মালিক করেন এবং নিজের দেওয়া সে অর্থের বিনিময়েই বান্দাকে জান্নাত দান করেন। তাই হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, 'এ এক অভিনব বেচা-কেনা, মালও মূল্য উভয়ই তোমাদের দিয়ে দিলেন আল্লাহ।’ (বাগভি)

হজরত হাসান বসরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, লক্ষ্য কর, এ কেমন লাভজনক সওদা, যা আল্লাহ সকল মুমিনের জন্য সুযোগ করে দিয়েছেন। (বগভি, কুরতুবি, ইবন কাসির) তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তোমাদের যে সম্পদ দান করেছেন, তা থেকে কিছু ব্যয় করে জান্নাত ক্রয় করে নাও। (বাগভি)

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তির জন্য জামিন হয়ে যান যিনি তাঁর রাস্তায় বের হয়। তাকে শুধুমাত্র আমার রাহে জেহাদই এবং আমার রাসুলের উপর বিশাসই বের করেছে। আল্লাহ তার জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন যে, যদি সে মারা যায় তবে তাকে জান্নাত দেবেন অথবা সে যা কিছু গনিমতের মাল পেয়েছে এবং সওয়াব পেয়েছে তা সহ তাকে তার সে ঘরে ফিরে পৌছিয়ে দেবেন যেখান থেকে বের হয়েছে।’ (বুখারি ৩১২৩, মুসলিম ১৮৭৬)

আল্লাহ তাআলা এসব মুমিনদের গুণগুলোও তুলে ধরেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সুসংবাদ দিতে এভাবে ঘোষণা করেছেন-

اَلتَّآئِبُوۡنَ الۡعٰبِدُوۡنَ الۡحٰمِدُوۡنَ السَّآئِحُوۡنَ الرّٰکِعُوۡنَ السّٰجِدُوۡنَ الۡاٰمِرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ النَّاهُوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ الۡحٰفِظُوۡنَ لِحُدُوۡدِ اللّٰهِ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ

‘তারা তওবাকারী, ইবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সঙ্গে) সম্পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সেজদা আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া সীমাসমূহের হেফাজতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে। (সুরা তওবা : আয়াত ১১২)

এ গুণাবলীগুলো হলো সেসব মুমিনের যাদের সম্পর্কে আগের আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘আল্লাহ্‌ জান্নাতের বিনিময়ে তাদের জান-মাল খরিদ করে নিয়েছেন’। আল্লাহর রাহে জেহাদকারী সবাই এ আয়াতের মর্মভুক্ত। তবে এখানে যেসব গুণাবলীর উল্লেখ হয়েছে, তা শর্তরূপে নয়। কারণ, আল্লাহর রাহে কেবল জেহাদের বিনিময়েই জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে এ গুণাবলী উল্লেখের উদ্দেশ্য এই যে, যারা জান্নাতের উপযুক্ত, তারা এ সব গুণের অধিকারী হয়। (কুরতুবি)

অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, আয়াতে উল্লেখিত السَّائِحُونَ দ্বারা উদ্দেশ্য সাওম পালনকারীগণ।’ (কুরতুবি, ইবন কাসির) হজরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ ও আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কোরআন মাজিদে ব্যবহৃত سائحين শব্দের অর্থ রোজাদার।’ (বাগভি; কুরতুবি)

তাছাড়া سائح বলে জেহাদকারীদেরকেও বুঝায়। তবে মূল শব্দটি سياحة যার অর্থ দেশ ভ্রমণ। বিভিন্ন ধর্মের লোক দেশ ভ্রমণকে ইবাদাত মনে করতো। অর্থাৎ মানুষ পরিবার পরিজন ও ঘর-বাড়ী ত্যাগ করে ধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়াত। ইসলাম একে বৈরাগ্যবাদ বলে অভিহিত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। (ইবন কাসির) এর পরিবর্তে সিয়াম পালনের ইবাদতকে এর স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। আবার কতিপয় বর্ণনায় জিহাদকেও দেশ ভ্রমনের অনুরূপ বলা হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের দেশভ্রমণ হলো ‘জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’। (আবু দাউদ ২৪৮৬)

আল্লাহ তাআলা ঈমানদার বান্দাদের নির্দেশ দিচ্ছেন তাকে ভয় করার জন্য এবং দুনিয়াতে সত্যবাদীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। আল্লাহ বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ کُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ

'হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।' (সুরা তওবা: আয়াত ১১৯)

সত্যবাদিতার কারণে আল্লাহ তাআলা সেই তিনজন সাহাবি রাদিয়াল্লাহু আনহুমের শুধু অপরাধই ক্ষমা করে দেননি; বরং তাঁদের তওবার কথা কোরআনের আয়াতরূপে অবতীর্ণ করেছেন। ফলে মুমিনদের আল্লাহ-ভীতি অবলম্বন করার ও সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ এই যে, যে ব্যক্তির মাঝে আল্লাহ-ভীতি থাকবে সে সত্যবাদীও হবে। আর যে মিথ্যুক হবে, জেনে রাখুন যে, তার অন্তর আল্লাহ-ভীতি থেকে খালি হবে। এই জন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, মিথ্যা বলা মুনাফিকের একটি লক্ষণ।

আগের আয়াতসমূহে জেহাদ থেকে বিরত থাকায় যে ত্রুটি কতিপয় নিষ্ঠাবান সাহাবীর দ্বারাও হয়ে গেল এবং পরে তাঁদের তওবাহ কবুল হলো, এ ছিল তাঁদের তাকওয়ারই ফলশ্রুতি। তাই এ আয়াতের মাধ্যমে সমস্ত মুসলিমকে তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর ‘তোমরা সবাই সত্যবাদীদের সঙ্গী হও’ বাক্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সত্যবাদীদের সাহচর্য এবং তাদের অনুরূপ আমলের মাধ্যমেই তাকওয়া লাভ হয়। আর এভাবেই কেউ ধ্বংস থেকে মুক্তি পেতে পারে। প্রতিটি বিপদ থেকে উদ্ধার হতে পারে। (ইবন কাসির)

হাদিসেও সত্যবাদিতার গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন কর; কেননা সত্যবাদিতা সৎকাজের দিকে নিয়ে যায়, আর সৎকাজ জান্নাতের পথনির্দেশ করে। মানুষ সত্য বলতে থাকে এবং সত্য বলতে চেষ্টা করতে থাকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে তাকে সত্যবাদী হিসেবে লেখা হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক; কেননা মিথ্যা পাপের পথ দেখায়, আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, আর একজন মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যা বলার চেষ্টায় থাকে শেষ পর্যন্ত তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে লেখা হয়।’ (বুখারি ৬০৯৪, মুসলিম ২৬০৭)

জাকাত

জাকাত কোনো সরকারি কর বা অনুদান নয় বরং তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সম্পদশালীর ওপর ফরজ ইবাদাত। জাকাতের অর্থ আদায় এবং তা যথাযথ খাতে ব্যয় করার দায়িত্ব ইসলামি রাষ্ট্রের। জাকাত বণ্টনে দায়িত্বশীলের কাজসহ যাবতীয় বিষয়ের তেলাওয়াতও হেব আজকের তারাবিতে।

সর্বোপরি বিশ্বনবি ছিলেন উম্মতের জন্য দরদি। তার সে গুণের কথা ওঠে এসেছে এ সুরার শেষাংশে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَقَدۡ جَآءَکُمۡ رَسُوۡلٌ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ عَزِیۡزٌ عَلَیۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِیۡصٌ عَلَیۡکُمۡ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ

'তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসুল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।' (সুরা তওবা : আয়াত ১২৮)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর তার ইহসানের কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি তাদের মধ্যে তাদেরই সমগোত্রীয় এবং তাদেরই সমভাষার লোককে প্রেরণ করেছেন। (ইবন কাসির) একথাটিই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে হজরত জাফর ইবন আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নাজ্জাসির দরবারে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'আল্লাহ আমাদের মধ্যে আমাদেরই একজনকে রাসুলরুপে পাঠিয়েছেন যাকে আমরা চিনি, তার বংশ ও গুণাগুণ সম্পর্কেও আমরা অবহিত। তার ভিতর ও বাহির সম্পর্কে, সত্যবাদিতা, আমানতদারী সম্পর্কেও আমরা জ্ঞাত।’ (মুসনাদে আহমাদ ১/২০১) তিনি আরও বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল সৃষ্টির উপর, বিশেষত মুমিনদের উপর বড় দয়াবান ও স্নেহশীল।

সুরা ইউনুস

সুরা ইউনুস মক্কায় নাজিল হয়। এর রুকু সংখ্যা ১১। আয়াত সংখ্যা ১০৯। এ সুরার ৯৮নং আয়াতে প্রসঙ্গ ক্রমে হজরত ইউনুছ আলাইহি সালামের কথা আসলেও এ সুরার আলোচ্য বিষয় হজরত ইউনুছ আলাইহিস সালামের ঘটনা নয়।

সুরা তওবার আগে মক্কায় নাজিল হওয়া এ সুরাটি অবতীর্ণ হয়। আর এ কারণেই সুরাটিতে আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহিদ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত প্রাপ্তি তথা রেসালাত এবং পরকালীন জীবনের বিবরণসমূহ চিত্রিত হয়েছে। যার মূল উদ্দেশ্যই ছিল- মানুষকে মহান আল্লাহর পথে আহ্বান করা।

কোরআন আল্লাহর কালাম, কাফেররা সে কথা মানত না। তারা বলত, ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ থেকে তা বানিয়ে বলছেন’। উত্তরে বলা হয়েছে, চল্লিশ বছর যিনি পৃথিবীর কোনো সৃষ্টির ব্যাপারেই কোনো ধরনের মিথ্যা বলেননি, তিনি এ বয়সে এসে মহান স্রষ্টা আল্লাহর ব্যাপারে কেন মিথ্যা বলতে যাবেন? তাছাড়া তিনি তো দুনিয়ায় কারও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেননি। কাব্য চর্চাও করেননি। এ সত্ত্বেও তিনি এমন অলৌকিক ও অলংকারপূর্ণ কথা নিজ থেকে কীভাবে বলতে পারেন?

وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡهِمۡ اٰیَاتُنَا بَیِّنٰتٍ ۙ قَالَ الَّذِیۡنَ لَا یَرۡجُوۡنَ لِقَآءَنَا ائۡتِ بِقُرۡاٰنٍ غَیۡرِ هٰذَاۤ اَوۡ بَدِّلۡهُ ؕ قُلۡ مَا یَکُوۡنُ لِیۡۤ اَنۡ اُبَدِّلَهٗ مِنۡ تِلۡقَآیِٔ نَفۡسِیۡ ۚ اِنۡ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا یُوۡحٰۤی اِلَیَّ ۚ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ

'আর যখন তাদের কাছে আমার প্রকৃষ্ট আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে সমস্ত লোক বলে, যাদের আশা নেই আমার সাক্ষাতের, নিয়ে এসো কোন কোরআন এটি ছাড়া, অথবা একে পরিবর্তিত করে দাও। তাহলে বলে দাও, একে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তিত করা আমার কাজ নয়। আমি সে নির্দেশেরই আনুগত্য করি, যা আমার কাছে আসে। আমি যদি স্বীয় পরওয়ারদেগারের নাফরমানী করি, তবে কঠিন দিবসের আযাবের ভয় করি।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ১৫)

قُلۡ لَّوۡ شَآءَ اللّٰهُ مَا تَلَوۡتُهٗ عَلَیۡکُمۡ وَ لَاۤ اَدۡرٰىکُمۡ بِهٖ  فَقَدۡ لَبِثۡتُ فِیۡکُمۡ عُمُرًا مِّنۡ قَبۡلِهٖ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ

'বলে দাও, যদি আল্লাহ চাইতেন, তবে আমি এটি তোমাদের সামনে পড়তাম না, আর নাইবা তিনি তোমাদেরেকে অবহিত করতেন এ সম্পর্কে। কারণ আমি তোমাদের মাঝে ইতিপূর্বেও একটা বয়স অতিবাহিত করেছি। তারপরেও কি তোমরা চিন্তা করবে না? (সুরা ইউনুস : আয়াত ১৬)

فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِاٰیٰتِهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الۡمُجۡرِمُوۡنَ

'এরপর তার চেয়ে বড় জালেম, কে হবে, যে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করেছে কিংবা তাঁর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলে অভিহিত করছে? কস্মিনকালেও পাপীদের কোন কল্যাণ হয় না।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ১৭)

কোরআন চিরসত্য, মহান আল্লাহর কালাম- এ কথা বলে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া হয়েছে, যদি এটা মানুষের কথা হয়ে থাকে তাহলে তোমরাও এর অনুরূপ কোনো সুরা বানিয়ে দেখাও দেখি। এ কাজের জন্য তোমরা আরব-অনারব, মানব-দানব যাকে খুশি ডেকে নিতে পারো। আল্লাহ বলেন-

وَ مَا کَانَ هٰذَا الۡقُرۡاٰنُ اَنۡ یُّفۡتَرٰی مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ لٰکِنۡ تَصۡدِیۡقَ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ تَفۡصِیۡلَ الۡکِتٰبِ لَا رَیۡبَ فِیۡهِ مِنۡ رَّبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ

' আর কোরআন সে জিনিস নয় যে, আল্লাহ ব্যতিত কেউ তা বানিয়ে নেবে। অবশ্য এটি পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে এবং সে সমস্ত বিষয়ের বিশ্লেষণ দান করে যা তোমার প্রতি দেয়া হয়েছে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই-তোমার বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ৩৭)

اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ افۡتَرٰىهُ ؕ قُلۡ فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّثۡلِهٖ وَ ادۡعُوۡا مَنِ اسۡتَطَعۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

'মানুষ কি বলে যে, এটি বানিয়ে এনেছ? বলে দাও, তোমরা নিয়ে এসো একটিই সূরা, আর ডেকে নাও, যাদেরকে নিতে সক্ষম হও আল্লাহ ব্যতিত, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।' (সুরা ইউনুস : ৩৮)

সুরা ইউনুসে আল্লাহ তাআলা উপদেশ হিসেবে তিনটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তাহলো-

প্রথম ঘটনা

হজরত নুহ আলাইহিস সালামের। তিনি দীর্ঘকাল দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন জাতিকে। কিন্তু তার জাতি সে দাওয়াত শুনেনি। আল্লাহ বলেন-

وَ اتۡلُ عَلَیۡهِمۡ نَبَاَ نُوۡحٍ ۘ اِذۡ قَالَ لِقَوۡمِهٖ یٰقَوۡمِ اِنۡ کَانَ کَبُرَ عَلَیۡکُمۡ مَّقَامِیۡ وَ تَذۡکِیۡرِیۡ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ فَعَلَی اللّٰهِ تَوَکَّلۡتُ فَاَجۡمِعُوۡۤا اَمۡرَکُمۡ وَ شُرَکَآءَکُمۡ ثُمَّ لَا یَکُنۡ اَمۡرُکُمۡ عَلَیۡکُمۡ غُمَّۃً ثُمَّ اقۡضُوۡۤا اِلَیَّ وَ لَا تُنۡظِرُوۡنِ

' আর তাদেরকে শুনিয়ে দাও নুহের অবস্থা যখন সে স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়, যদি তোমাদের মাঝে আমার অবস্থিতি এবং আল্লাহর আয়াতসমূহের মাধ্যমে নসিহত করা ভারী বলে মনে হয়ে থাকে, তবে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করছি। এখন তোমরা সবাই মিলে নিজেরদের কর্ম সাব্যস্ত কর এবং এতে তোমাদের শরীকদেরকে সমবেত করে নাও, যাতে তোমাদের মাঝে নিজেদের কাজের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-সংশয় না থাকে। অতপর আমার সম্পর্কে যা কিছু করার করে ফেল এবং আমাকে অব্যাহতি দিও না।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭১)

এ পর্যন্ত যে আলোচনা হয়েছে তাতে এ লোকদের ন্যায়সঙ্গত যুক্তি ও হৃদয়গ্রাহী উপদেশের মাধ্যমে তাদের আকিদা-বিশ্বাসে কি কি ভুল-ভ্রান্তি আছে এবং সেগুলো ভুল কেন আর এর মোকাবিলায় সঠিক পথ কি এবং তা সঠিক কেন, একথা বুঝানো হয়েছিল। এখানে আল্লাহ তাঁর নবিকে হুকুম দিচ্ছেন, তাদের নূহের ঘটনা শুনিয়ে দিন, এ ঘটনা থেকেই তারা আপনার ও তাদের মধ্যকার ব্যাপারটির জবাব পেয়ে যাবে। যেখানে তারা দেখতে পাবে যে, যারা কুফরিতে নিপতিত ছিল তাদেরকে কীভাবে কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। (কুরতুবি) সুতরাং যারাই অনুরূপ কাজ করবে, আপনার উপর মিথ্যারোপ করবে, আপনার বিরোধিতা করবে তাদের পরিণতিও তা-ই হবে। (ইবন কাসির)

فَاِنۡ تَوَلَّیۡتُمۡ فَمَا سَاَلۡتُکُمۡ مِّنۡ اَجۡرٍ ؕ اِنۡ اَجۡرِیَ اِلَّا عَلَی اللّٰهِ ۙوَ اُمِرۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ

'তারপরও যদি বিমুখতা অবলম্বন কর, তবে আমি তোমাদের কাছে কোনো রকম বিনিময় কামনা করি না। আমার বিনিময় হল আল্লাহর দায়িত্বে। আর আমার প্রতি নির্দেশ রয়েছে যেন আমি আনুগত্য অবলম্বন করি।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭২)

আমাকে যে ইসলামের আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার আনুগত্য আমি করছি। এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, ইসলাম সব নবি-রাসুলদের দ্বীন। তাদের শরিয়ত বিভিন্ন ছিল কিন্তু দ্বীন একই ছিল। হজরত নূহ আলাইহিস সালামের দ্বীন যে ইসলাম ছিল তা এ আয়াতে তার কথা থেকে আমরা তা জানতে পারলাম। অনুরূপভাবে ইবরাহিম আলাইহিস সালামও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ‘আমি রাব্বুল আলামিনের জন্য আত্মসমৰ্পন তথা ইসলাম গ্রহণ করেছি।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১৩১)

তাছাড়া হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামও তার দ্বীনকে ইসলাম বলে ঘোষণা করেছিলেন। (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ১৩২) আর ইউসুফ ও মুসা আলাইহিমাস সালামও সেটা ঘোষণা করেছিলেন।’ (সুরা ইউসুফ: ১০১; সুরা ইউনুস: আয়াত ৮৪)

হজরত মুসা আলাইহিস সালামের উপর ঈমান গ্রহণকারী জাদুকরগণ, রাণী বিলকিস; হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের হাওয়ারীগণ এরা সবাই তাদের দ্বীনকে ইসলাম বলে জানিয়েছেন।’ (সুরা আল-আরাফ ১২৬; সুরা আন-নামল ৪৪; সুরা আল-মায়েদাহ ৪৪ ও ১১১)

এমনকি হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনের অনুসারী হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘বলুন, আমার নামাজ, আমার ইবাদাত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের রব আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোনো শরীক নেই এবং আমি এরই জন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।’ (সুরা আল-আনআম: আয়াত ১৬২, ১৬৩)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমরা নবীগোষ্ঠী বৈমাত্রেয় ভাই, আমাদের দ্বীন একই।’ (বুখারি ৩৪৪৩, মুসলিম ২৩৬৫)

দ্বিতীয় ঘটনা

হজরত মুসা ও হারুন আলাইসি সালামকে নিয়ে। প্রভু হওয়ার দাবিদার ফেরাউনের মোকাবিলায় পাঠানো হয়েছিল তাদের। এ দুই পয়গাম্বরের দাবি অস্বীকার করায় আল্লাহ ফেরাউনকে তার দলবলসহ পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করে দেন। আল্লাহ বলেন-

ثُمَّ بَعَثۡنَا مِنۡۢ بَعۡدِهِمۡ مُّوۡسٰی وَ هٰرُوۡنَ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِهٖ بِاٰیٰتِنَا فَاسۡتَکۡبَرُوۡا وَ کَانُوۡا قَوۡمًا مُّجۡرِمِیۡنَ

'অতঃপর তাদের পেছনে পাঠিয়েছি আমি মূসা ও হারুনকে, ফেরাউন ও তার সর্দারের প্রতি স্বীয় নির্দেশাবলী সহকারে। অথচ তারা অহংকার করতে আরম্ভ করেছে। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭৫)

فَلَمَّا جَآءَهُمُ الۡحَقُّ مِنۡ عِنۡدِنَا قَالُوۡۤا اِنَّ هٰذَا لَسِحۡرٌ مُّبِیۡنٌ

'বস্তুতঃ তারা ছিল গুনাহগার। তারপর আমার পক্ষ থেকে যখন তাদের কাছে সত্য বিষয় উপস্থিত হল, তখন বলতে লাগলো, এগুলো তো প্রকাশ্য যাদু। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭৬)

হজরত মুসা আলাইহিস সালামের বাণী শুনে তারা সেই একই কথা বলেছিল যা মক্কার ফাফেররা বলেছিল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা শুনে। কাফেররা বলেছিল, ‘এ ব্যক্তি তো পাক্কা জাদুকর’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ২; সুরা ছোয়াদ: আয়াত ৪)

হজরত মুসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামের দায়িত্ব তা-ই ছিল যা কুরআনের দৃষ্টিতে সকল নবির নবুওয়াতের উদ্দেশ্য ছিল এবং সুরা নাযিআতে যে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে বলে দেওয়া হয়েছেযে, ‘ফেরাউনের কাছে যান, কারণ সে সীমা অতিক্রম করে গেছে এবং তাকে বলেন, তুমি কি নিজেকে শুধরে নেবার জন্য তৈরী আছো? আমি তোমাকে তোমার রবের দিকে পথ দেখাবো তুমি কি তাঁকে ভয় করবে? কিন্তু ফিরআউন ও তার রাজ্যের প্রধানগণ এ দাওয়াত গ্রহণ করেনি।

قَالَ مُوۡسٰۤی اَتَقُوۡلُوۡنَ لِلۡحَقِّ لَمَّا جَآءَکُمۡ ؕ اَسِحۡرٌ هٰذَا ؕ وَ لَا یُفۡلِحُ السّٰحِرُوۡنَ

- মুসা বলল, সত্যের ব্যাপারে একথা বলছ, তা তোমাদের কাছে পৌঁছার পর? একি যাদু? অথচ যারা যাদুকর, তারা সফল হতে পারে না। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭৭)

যখন মুসা আলাইহিস সালাম বললেন, তোমরা একটু চিন্তা করে দেখ, সত্যের দাওয়াত ও সঠিক কথাকে তোমরা যাদু বলছ! এটা কি যাদু হতে পারে? যাদুকর তো কখনো কৃতকার্যই হতে পারে না। অর্থাৎ ইচ্ছা আনুযায়ী চাহিদা পূরণ এবং অবাঞ্ছিত পরিণতি থেকে বাঁচতে সে অকৃতকার্যই থেকে যায়। আর আমি তো আল্লাহর রাসুল, আমি আল্লাহর সাহায্য পাই এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে মুজেজা ও স্পষ্ট নিদর্শন প্রদান করা হয়েছে। যাদু ও যাদুবিদ্যার আমার প্রয়োজনই বা কি আছে? তাছাড়া আল্লাহ তাআলার প্রদর্শিত মুজেজার তুলনায় তার মূল্যই বা কতটুকু?

قَالُوۡۤا اَجِئۡتَنَا لِتَلۡفِتَنَا عَمَّا وَجَدۡنَا عَلَیۡهِ اٰبَآءَنَا وَ تَکُوۡنَ لَکُمَا الۡکِبۡرِیَآءُ فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ مَا نَحۡنُ لَکُمَا بِمُؤۡمِنِیۡنَ

‘তারা বলল, তুমি কি আমাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে দিতে এসেছ যাতে আমরা পেয়েছি আমাদের বাপ-দাদাদের কে? আর যাতে তোমরা দুইজন এদেশের সর্দারী পেয়ে যেতে পার? আমরা তোমাদেরকে কিছুতেই মানব না। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭৮)

وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ ائۡتُوۡنِیۡ بِکُلِّ سٰحِرٍ عَلِیۡمٍ

আর ফেরাউন বলল, আমার কাছে নিয়ে এস সুদক্ষ যাদুকরদিগকে। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৭৯)

فَلَمَّا جَآءَ السَّحَرَۃُ قَالَ لَهُمۡ مُّوۡسٰۤی اَلۡقُوۡا مَاۤ اَنۡتُمۡ مُّلۡقُوۡنَ

‘তারপর যখন যাদুকররা এল, মূসা তাদেরকে বলল, নিক্ষেপ কর, তোমরা যা কিছু নিক্ষেপ করে থাক। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৮০)

فَلَمَّاۤ اَلۡقَوۡا قَالَ مُوۡسٰی مَا جِئۡتُمۡ بِهِ ۙ السِّحۡرُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ سَیُبۡطِلُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُصۡلِحُ عَمَلَ الۡمُفۡسِدِیۡنَ

‘এরপর যখন তারা নিক্ষেপ করল, মূসা বলল, যা কিছু তোমরা এনেছ তা সবই যাদু-এবার আল্লাহ এসব ভন্ডুল করে দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ দুস্কর্মীদের কর্মকে সুষ্ঠুতা দান করেন না। (সুরা ইউনুস : আয়াত ৮১)

সুতরাং এমনই হল, মিথ্যা কি আর সত্যের মুকাবিলায় জয়ী হতে পারে? যাদুকররা তাদের যাদু-বিদ্যায় যতই দক্ষতা অর্জন করে থাকুক, তারা যা কিছু পেশ করেছিল, তা যাদু ও ইন্দ্রজাল (চোখের ভেলকিই) ছিল। কিন্তু মুসা আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর আদেশে তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলেন, তখন সে সকল ইন্দ্রজালকে এক পলকে শেষ করে দিল।

আর এই সব যাদুকররাও অশান্তি সৃষ্টিকারী ছিল। তারা শুধু পার্থিব সুখ অর্জনের জন্য যাদু শিক্ষা করেছিল আর যাদুর ভেলকি দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানাতো। আল্লাহ তাআলা তাদের এই দুষ্কর্মকে কীভাবে সার্থকতা দান করবেন?

তৃতীয় ঘটনা

ইউনুস আলাইহিস সালাম। তাঁর নামেই এই সুরার নামকরণ করা হয়েছে। নিজ কওমের ঈমান আনার বিষয়ে আশাহত হয়ে এবং আল্লাহর আজাব আপতিত হওয়ার নিশ্চিত অবস্থা দেখে তিনি ‘নিনাওয়া’ নামক স্থান ছেড়ে চলে আসেন। ইউনুস আলাইহিস সালাম চলে যাওয়ার পর তার কওমের লোকেরা ভুল বুঝতে পেরে তওবা, ইস্তেগফার করে। ফলে তাদের থেকে আল্লাহ তায়ালা আজাব সরিয়ে নেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

فَلَوۡ لَا کَانَتۡ قَرۡیَۃٌ اٰمَنَتۡ فَنَفَعَهَاۤ اِیۡمَانُهَاۤ اِلَّا قَوۡمَ یُوۡنُسَ ؕ لَمَّاۤ اٰمَنُوۡا کَشَفۡنَا عَنۡهُمۡ عَذَابَ الۡخِزۡیِ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ مَتَّعۡنٰهُمۡ اِلٰی حِیۡنٍ

'সুতরাং কোনো জনপদ কেন এমন হল না যা ঈমান এনেছে অতপর তার সে ঈমান গ্রহণ হয়েছে কল্যাণকর? অবশ্য ইউনুসের সম্প্রদায়ের কথা আলাদা। তারা যখন ঈমান আনে তখন আমি তুলে নেই তাদের উপর থেকে অপমানজনক আযাব-পার্থি ব জীবনে এবং তাদের কে কল্যাণ পৌছাই এক নিধারিত সময় পর্যন্ত।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ৯৮)

ইউনুস আলাইহিস সালামকে আসিরিয়ানদের হেদায়াতের জন্য ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। এ কারণে আসিরীয়দেরকে এখানে ইউনুসের কওম বলা হয়েছে। সে সময় এ কওমের কেন্দ্র ছিল ইতিহাস খ্যাত নিনোভা নগরী। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ আজো বিদ্যমান। দাজলা নদীর পূর্ব তীরে আজকের মুসেল শহরের ঠিক বিপরীত দিকে এ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ জাতির রাজধানী নগরী নিনোভা প্রায় ৬০ মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত ছিল। এ থেকে এদের জাতীয় উন্নতির বিষয়টি অনুমান করা যেতে পারে।

আয়াতের পরিষ্কার মর্ম এই যে, পৃথিবীর সাধারণ জনপদের অধিবাসীদের সম্পর্কে আফসোসের প্রকাশ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা কেনই বা এমন হলো না যে, এমন সময়ে ঈমান নিয়ে আসত যে সময় পর্যন্ত ঈমান আনলে তা লাভজনক হতো! অর্থাৎ আজাব কিংবা মৃত্যুতে পতিত হবার আগে যদি ঈমান নিয়ে আসতো, তবে তাদের ঈমান কবুল হয়ে যেত। কিন্তু ইউনুস আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় তা থেকে স্বতন্ত্র। কারণ তারা আজাবের লক্ষণাদি দেখে আজাবে পতিত হওয়ার আগেই যখন ঈমান নিয়ে আসে, তখন তাদের ঈমান ও তওবা কবুল হয়ে যায়। আয়াতের এই প্রকৃষ্ট মর্ম প্রতীয়মান করে যে, এখানে আল্লাহর চিরাচরিত নিয়মে কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি; বরং একান্তভাবে তার নিয়মানুযায়ীই তাদের ঈমান ও তওবা কবুল করে নেওয়া হয়েছে।

অধিকাংশ মুফাসসির আয়াতের এ মর্মই লিখেছেন যাতে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ে তওবা কবুল হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর সাধারণ রীতির আওতায়ই হয়েছে। তাবারি প্রমূখ তাফসীরকারও এ ঘটনাকে ইউনুস আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেছেন। সে সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ মনে তওবা করা ও আল্লাহর জ্ঞানে তার নিঃস্বার্থ হওয়া প্রভৃতিই আজাব না আসার কারণ। ঘটনা এই যে, ইউনুস আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তিন দিন পর আজাব আসার দুঃসংবাদ শুনিয়ে দেন। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, আজাব আসেনি, তখন ইউনুস আলাইহিস্ সালামের মনে এ ভাবনা চেপে বসলো যে, আমি সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরে গেলে তারা আমাকে মিথ্যুক বলে সাব্যস্ত করবে। অতএব, এ সময় দেশ থেকে হিজরত করে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু নবি-রাসুলগণের রীতি হলো এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো দিকে হিজরত করার নির্দেশ না আসা পর্যন্ত নিজের ইচ্ছামত তারা হিজরত করেন না।

ইউনুস আলাইহিস সালাম- আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদন আসার আগেই হিজরতের উদ্দেশ্যে নৌকায় আরোহণ করে বসেন। সূরা আস-সাফফাতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ) ‘স্মরণ করুন, যখন তিনি বোঝাই নৌযানের দিকে পালিয়ে গেলেন।’ (সুরা আস-সাফফাত: আয়াত ১৪০)

এতে হিজরতের উদ্দেশ্যে নৌকায় আরোহণ করাকে أَبَقَ শব্দে বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো স্বীয় মনিবের অনুমতি ছাড়া কোনো ক্রীতদাসের পালিয়ে যাওয়া। অন্য সুরায় এসেছে, ‘আর স্মরণ করুন, যুন-নূনের কথা, যখন তিনি ক্রোধ ভরে চলে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমরা তাকে পাকড়াও করব না।’(সুরা আল-আম্বিয়া: আয়াত ৮৭)

এতে স্বভাবজাত ভীতির কারণে সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করে হিজরত করাকে ভর্ৎসনার সুরে ব্যক্ত করা হয়েছে। সুতরাং তার প্রতি ভর্ৎসনা আসার কারণ হলো, অনুমতির আগে হিজরত করা। মোটকথা আগের কোনো নবি-রাসুলের জনপদের সবাই ঈমান আনেনি। এর ব্যতিক্রম ছিল ইউনুসের কাওম। তারা ছিল নিনোভার অধিবাসী। তাদের ঈমানের কারণ ছিল, তারা তাদের রাসুলের মুখে যে আজাব আসার কথা শুনেছিল সেটার বিভিন্ন উপসর্গ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আর তারা দেখল যে, তাদের রাসুলও তাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছেন। তখন তারা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইল, তার কাছে উদ্ধার কামনা করল, কান্নাকাটি করল এবং বিনয়ী হল। আর তারা তাদের শিশু-সন্তান, জন্তু-জানোয়ারদের পর্যন্ত উপস্থিত করেছিল এবং আল্লাহর কাছে তাদের উপর থেকে আজাব উঠিয়ে নেওয়ার আহবান জানিয়েছিল। আর তখনই আল্লাহ তাদের উপর রহমত করেন এবং তাদের আজাব উঠিয়ে নেন, তাদেরকে কিছু দিনের জন্য দুনিয়াকে উপভোগ করার সুযোগ প্রদান করেন। (ইবন কাসির)

সুরার শেষ দিকে মোমিনদের সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন, ‘এটা আমার নিয়ম, সবশেষে আমি মোমিনদেরই মুক্তি দিই।’ অতপর সুরার সূচনায় যেভাবে কোরআন হাকিমের আলোচনা দিয়ে হয়েছিল, সমাপ্তিও হয়েছে এই সত্য কিতাবের অনুসরণের হুকুম প্রদানের মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন-

قُلۡ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَکُمُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکُمۡ ۚ فَمَنِ اهۡتَدٰی فَاِنَّمَا یَهۡتَدِیۡ لِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡهَا ۚ وَ مَاۤ اَنَا عَلَیۡکُمۡ بِوَکِیۡلٍ

'বলে দাও, হে মানবকুল! সত্য তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের তরফ থেকে। এমন যে কেউ পথে আসে সেপথ প্রাপ্ত হয় স্বীয় মঙ্গলের জন্য। আর যে বিভ্রান্ত ঘুরতে থাকে, সে স্বীয় অমঙ্গলের জন্য বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকবে। অনন্তর আমি তোমাদের উপর অধিকারী নই। (সুরা ইউনুস : আয়াত ১০৮)

وَ اتَّبِعۡ مَا یُوۡحٰۤی اِلَیۡکَ وَ اصۡبِرۡ حَتّٰی یَحۡکُمَ اللّٰهُ ۚۖ وَ هُوَ خَیۡرُ الۡحٰکِمِیۡنَ

'আর তুমি চল সে অনুযায়ী যেমন নির্দেশ আসে তোমার প্রতি এবং সবর কর, যতক্ষণ না ফয়সালা করেন আল্লাহ। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম ফয়সালাকারী।' (সুরা ইউনুস : আয়াত ১০৯)

সুরা হুদ

সুরা হুদ মক্কায় অবর্তীণ। এতে ১০ রুকু এবং ১২৩ আয়াত রয়েছে। আজকের তারাবিহতে প্রথম ৫ আয়াত তেলাওয়াতের মাধ্যমে শেষ হবে রমজানের অষ্টম তারাবিহ। এ সুরার আলোচ্য বিষয় সুরা ইউনুছের আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে মিল রয়েছে। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা কড়াকড়িভাবে মানুষকে সতর্ক করেছেন।

আয়াত ০১-৫

আল্লাহ তাআলঅ সুরা হুদের প্রথম পাঁচ আয়াতে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাতের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যারা আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগি করবে; শিরক ও কুফরমুক্ত জীবন-যাপন করবে; কোনো অন্যায় করলে তওবার মাধ্যমে আবার তাঁরই দিকে ফিরে আসবে; তাদের দুনিয়ার জীবন হবে উপভোগ্য আবার পরকালের মহা অনুগ্রহ দান করা হবে তাদেরকে। যারা তারপরও আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে তাদের জন্য রয়েছে পরকালের কঠিন শাস্তি।

১১ পারার শেষ আয়াতে আল্লাহ তাআলা সবাইকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেন যে, দুনিয়ার জীবনে মানুষ যেভাবেই জীবন-যাপন করুক না কেন? মৃত্যুর পর সবাইকেই আল্লাহর সম্মুখে তাঁর সান্নিধ্যে যেতে হবে। কারণ তাঁর কাছে যাওয়া ব্যতিত কেউ রেহাই পাবে না। তিনি পুনরায় সবাইকে তাঁর নিকট উপস্থিত করতে সক্ষম। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اَلَاۤ اِنَّهُمۡ یَثۡنُوۡنَ صُدُوۡرَهُمۡ لِیَسۡتَخۡفُوۡا مِنۡهُ ؕ اَلَا حِیۡنَ یَسۡتَغۡشُوۡنَ ثِیَابَهُمۡ ۙ یَعۡلَمُ مَا یُسِرُّوۡنَ وَ مَا یُعۡلِنُوۡنَ ۚ اِنَّهٗ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ

‘জেনে রেখ! তারা নিজ নিজ বুক কুঞ্চিত করে রাখে, যাতে তাঁর (আল্লাহর) দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে থাকতে পারে। জেনে রেখ! তারা যখন নিজেদের কাপড় (শরীরে) জড়ায়, তখনও তিনি সব জানেন, যা কিছু তারা গোপন করে এবং যা কিছু প্রকাশ করে। তিনি তো মনের ভেতরের কথাও জানেন।’ (সুরা হুদ : আয়াত ৫)

আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, কাফেরগণ সন্দেহ সংশয় করে মুখ লুকিয়ে থাকে আর মনে করে যে, এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আড়াল করতে পারবে। তারা মূলত আল্লাহ থেকে কখনো আড়াল করতে পারবে না। কেননা, আল্লাহ তাআলা থেকে কোন কিছুই আড়াল নেই। তাই যত চেষ্টাই করুক না কেন তারা নিজেদের আড়াল করতে পারবে না।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরাই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি।’ (সুরা কাফ: আয়াত ১৬)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর জেনে রাখ যে, তোমাদের অন্তরে যা গোপন আছে আল্লাহ তা জানেন সুতরাং তোমরা তাকে ভয় কর।’(সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২৩৫)

অন্য আয়াতে বলেন, ‘তারপর আমরা অবশ্যই জ্ঞানসহ তাদের কাছে তা ব্যক্ত করব, আর আমরা তো অনুপস্থিত ছিলাম না।’ (সুরা আল-আরাফ: আয়াত ৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘আপনি যে কোন অবস্থায় থাকেন এবং আপনি সে সম্পর্কে কোরআন থেকে যা তেলাওয়াত করেন এবং তোমরা যে কোনো কাজ কর, আমি তোমাদের পরিদর্শক—যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণও আপনার প্রতিপালকের দৃষ্টির বাইরে নয় এবং তার চেয়ে ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ৬১)

তবে তারা যে শুধু হক শোনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত তাই নয়। বরং তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর যে বাণী শোনাত তাও না শোনার ভান করত। আর মনে করত যে, এভাবে তারা আল্লাহ থেকে গোপন করছে। কারণ, মক্কায় যখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলো তখন সেখানে এমন বহু লোক যারা বিরোধিতায় প্রকাশ্যে তেমন একটা তৎপর ছিল না কিন্তু মনে মনে তার দাওয়াতের প্রতি ছিল চরমভাবে ক্ষুব্ধ ও বিরূপভাবাপন্ন। তারা তাঁকে পাশ কাটিয়ে চলতো। তাঁর কোনো কথা শুনতে চাইতো না। কোথাও তাঁকে বসে থাকতে দেখলে পেছন ফিরে চলে যেতো। দূর থেকে তাঁকে আসতে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নিতো অথবা কাপড়ের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলতো, যাতে তাঁর মুখোমুখি হতে না হয় এবং তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে কথা বলতে শুরু করে না দেন। এখানে এ ধরনের লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (তাবারি, বাগভি, ফাতহুল কাদির)

আয়াতের অপর অনুবাদ হচ্ছে, তারা আল্লাহর কাছ থেকে বা রাসুলের কাছ থেকে নিজেদের লুকানোর জন্য মাথা নীচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে কাপড় দিয়ে ঢেকে চলে যেত। অথচ যত কাপড় দিয়েই তারা নিজদেরকে ঢাকুক না কেন আল্লাহ তাআলা ঠিকই তাদের দেখছেন। (ইবন কাসির)

তাই আয়াতে বলা হয়েছে, এরা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায় এবং উটপাখির মত বালির মধ্যে মুখ গুঁজে রেখে মনে করে, যে সত্যকে দেখে তারা মুখ লুকিয়েছে তা অন্তর্হিত হয়ে গেছে। অথচ সত্য নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এবং এ তামাশাও দেখছে যে, এ নির্বোধরা তার থেকে বাঁচার জন্য মুখ লুকাচ্ছে। অথবা আয়াতের অর্থ, তারা তাদের কুফর তাদের অন্তরে গোপন করে রাখে আর মনে করে যে, আল্লাহ থেকে গোপন করছে। অথচ তারা যত কাপড় দিয়েই নিজেদেরকে আড়াল করুক না কেন আল্লাহ তো তাদের অবস্থা জানেন। (মুয়াসসার)

আবার তাদের মধ্যে এমন কতিপয় লোকও ছিল যারা তাদের প্রাত্যহিক গোপনীয় কাজসমূহ যেমন স্ত্রী-সহবাস, পায়খানা ব্যবহার করার সময়ও নিজেদের কাপড় খুলতে লজ্জাবোধ করত এবং তা আকাশের দিকে হয়ে যাওয়ার ভয় করত। কিন্তু অন্যান্য সময় আল্লাহর কোনো খেয়াল রাখত না। তাই আল্লাহ তাআলা তাদের এ অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে এ আয়াত নাজিল করেন।

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘তারা (কাফেরগণ) স্ত্রী-সহবাসের সময় বা পায়খানা ব্যবহার করার সময় আকাশের দিকে মুখ করতে লজ্জাবোধ করত এবং কাপড় দিয়ে নিজেদের মাথা ঢেকে রাখত। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করেন।’ (বুখারি ৪৬৮১, ৪৬৮২, ৪৬৮৩)

আল্লাহ তআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।