অ্যারাবিয়ান ডিশ-রুটিতে ছড়ানো মাংসের ‘হারিস’ থাকে ইফতারে

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৪৯ এএম, ৩১ মার্চ ২০২৩

সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববাসীর কাছে স্বপ্নপুরীসম এক দেশ। মরুর অঞ্চলে বিলাসিতা ও আভিজাত্যে অতুলনীয় দেশ এটি। রমজান মাস এলেই উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয় রোজা। আরব বিশ্বের ইউরোপ আরব আমিরাতের রমজান সংস্কৃতি কেমন?

শিশুদের অনুষ্ঠান ‘হক আল লায়লা’

রমজান শুরুর আগেই আমিরাতে রমজান উদযাপনের ধুম লেগে যায়। বেশ উল্লাসের সঙ্গে পালন করা হয় ‘হক আল লায়লা’। পবিত্র রমজান শুরুর আগে ১৫ শাবান আসন্ন রমজানকে উদযাপন করতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানটি অনেকটা হ্যালুইনের ট্রিক অর ট্রিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হতে পারে। কারণ, এখানেও বাচ্চাদের হাতে দেওয়া হয় খেজুর ও চকলেট। তবে এ উৎসবের পেছনের উদ্দেশ্যটা একটু আলাদা। মূলত রমজানের মাহাত্ম্য ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে শিশুদের সামনে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে তুলে ধরার প্রয়াসই হলো ‘হক আল লায়লা’। বহু বছর ধরে পালিত হয়ে আসা এ উৎসব এখন আমিরাতের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

খারিতা পালন

শাবান মাসের ১৫ তারিখ থেকে শুরু খারিতা অনুষ্ঠান। এতে শিশুদের দেখা যায়, তারা উজ্জ্বল কাপড় পরে দলবেঁধে প্রতিবেশীদের বাড়ি যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে থাকে ঝোলা। তারা প্রতিবেশীদের দরোজায় কড়া নাড়ে। সুর করে বলে, ‘তোমরা আমাদের দাও, আল্লাহ তোমাদের দেবেন। মক্কায় আল্লাহ তাঁর ঘর পরিদর্শন করাবেন।’ তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি, বাদাম ও অন্যান্য খাবার সংগ্রহ করে। এটি ‘খারিতা’ নামে পরিচিত। বাচ্চারা খাবার সংগ্রহ করে। উৎসাহের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় এ গান গেয়ে বেড়ায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ উদযাপন আমিরাতের জাতীয় পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত। আজকের আধুনিক সমাজে মানুষ যখন একে অপরের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপন করে, তখন এ প্রথা আগেকার সেই সহজ সরল জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে সামাজিক বন্ধন এবং পারিবারিক মূল্যবোধের গুরুত্বের ওপরও আলোকপাত করে।

রমজানে বাড়তি আমেজ

রোজা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় দেশটির চিত্র। রমজান মাসজুড়ে বন্ধ থাকে নাইট ক্লাব ও মদের বার। প্রকাশ্যে পানাহার ও ধূমপান, দণ্ডনীয় অপরাধ। বছরজুড়ে সড়কগুলো পরিচ্ছন্ন থাকলেও এ সময় হয় আরও ঝকঝকে। জাঁকালো আলোক সজ্জায় সাজে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশটি।

দুবাইয়ের আবহ

দুবাইয়ে রমজান শুরুর ঘোষণা দেয় ‘দি ইউনাইটেড আরব আমিরাত মুন সাইটিং কমিটি’। রমজান উপলক্ষে সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংস্কৃতি বেশ পুরোনো। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে দেশব্যাপী রমজান সংশ্লিষ্ট সামগ্রী বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া মাহে রমজানে আন্তর্জাতিকভাবে এখানে কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। রমজান এলেই যেনো পুরো দুবাই নতুন উদ্যমে সেজে ওঠে।

কর্মঘণ্টায় হয় রদবদল

রমজান এলেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের অফিসিয়াল সময়ে পরিবর্তন আসে। যেন তারা নির্বিঘ্নে এ মাসে ইবাদত-বন্দেগি করতে পারে। বরকতময় রমজান মাসজুড়ে সপ্তাহে তিনদিন ছুটি উপভোগ করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের একাধিক শহরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। শুধু তা-ই নয়, বাকি চার কর্মদিবসেও কমানো হয় কাজের সময়। রমজান মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসগুলো সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে। আর শুক্রবার কাজ চলে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের কর্মীদের জন্যও দৈনিক কাজের সময় দুই ঘণ্টা কমানো হয়।

বুর্জ খলিফার ইফতার

বিশ্বের উচ্চতম বিল্ডিং বুর্জ খলিফার ৮০ তলার ওপরে যারা বাস করেন, তাদের রমজানের সময় অতিরিক্ত ২-৩ মিনিট অপেক্ষা করতে হয় ইফতারের জন্য। কারণ, উঁচুতে সূর্যকে বেশ কিছুক্ষণ দেখতে পান তারা।

সেহরি-ইফতার

আরব বিশ্বের ইউরোপ হিসেবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাতে রমজানের চাঁদ দেখার পর একে অন্যকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু হয় রোজা। আর ইফতার ও সেহরি শুরু হয় কামান দাগিয়ে। একই দিনে রমজান শুরু হলেও সেহরি ও ইফতারে আলাদা সময়সূচি অনুসরণ করে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়। তবে সব মুসলিমই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকে।

ইফতারে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রভাব

আমিরাতের ইফতারে থাকে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রভাব। সুন্নত মেনে খেজুর দিয়ে রোজা ভাঙেন আমিরাতবাসী। ইফতারের প্রধান মেন্যুতে থাকে ঐতিহ্যবাহী থারিদ, বিরিয়ানি, কাতায়েফ, সালাদ, ইতালিয়ান পাস্তা, ফল। তবে নবিজির প্রিয় অ্যারাবিয়ান ডিশ-রুটিতে ছড়ানো মাংসের ‘হারিস’ তাদের ভীষণ পছন্দ।

ইফতার আতিথেয়তা

মহিমান্বিত এ মাসে রোজাদারদের প্রতি দেশটির জনগণের আতিথেয়তা সবাইকে মুগ্ধ করে। হাজার বছরের আরব আতিথেয়তার গুণটি এখনও ধরে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছেন পুরোদমে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে পাড়া-মহল্লা বা বড় বড় মসজিদের পাশে তাবু-প্যান্ডেল টানিয়ে ইফতার আয়োজনের পাশাপাশি রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ইফতার দেওয়াও আমিরাতের ঐতিহ্য।

মুক্ত হস্তে দান

পবিত্র রমজান মাসে আরব দেশগুলোর ধনী ব্যক্তিরা সাধারণত জাকাত দানে উৎসাহী হন। কিন্তু তেল সম্পদের প্রাচুর্যে ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোর স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে জাকাত নেওয়ার মতো কেউ নেই। তাই ধনকুবেরদের কাছ থেকে জাকাত গ্রহণের সুযোগটি নেন পৃথিবীর বিভিন্ন অনুন্নত দেশের মানুষ। রমজানে তারা উড়ে যান দুবাইসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে। দুবাইয়ের মতো জৌলুসময় নগরীগুলোতে ধনকুবেররা জাকাত গ্রহণের লোক পেয়ে অনেকটা স্বস্তির হাসি দিয়ে মুক্ত হস্তে দান করেন।

দ্রব্যমূল্য অর্ধেকে নামিয়ে আনা

‘অ্যারাবিয়ান বিজনেস’-এর দেওয়া তথ্যমতে, রমজানে সর্বোচ্চ চাহিদা রয়েছে, এমন পণ্যের দাম অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সংযমের মাসে শাক-সবজি ও ফলমূলের মতো জরুরি পণ্যগুলোর যেনো কোনো সংকট তৈরি না হয়, মূলত সে লক্ষ্যেই দ্রব্যমূল্য কমানোর সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা সুরক্ষাবিষয়ক পরিচালক ড. হাশিম আল নুয়াইমির বরাত দিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এ কথা জানিয়েছে।

ভোজ্যপণ্যের ওপর ছাড়

আরব আমিরাতে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ভোজ্যপণ্যের ওপর রমজানকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন ছাড় দিয়ে থাকে। কেউ বা দামে ছাড়, কেউ পরিমাণে বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের এ সুবিধা দিয়ে থাকে। পণ্যের মানের উৎকৃষ্টতা যেনো বজায় থাকে, সেদিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হয়। যাতে রোজা রেখে মানুষ কষ্ট না পায়। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও ও বড় বড় ব্যবসায়ী রমজানকে সামনে রেখে তাদের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়ে থাকে। যাতে মানুষ সুন্দরভাবে রমজানের এ মহান মাসটিতে নির্বিঘ্নে সিয়াম সাধনা করতে পারে।

প্রবাসীরা মালামাল পাঠায়

এ মাসে প্রতি বছর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাংলাদেশি মালিকানাধীন বিপণি বিতানগুলোতেও ছাড় দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বিক্রয়ে বেশ সাফল্যও পেয়েছেন বলে জানান বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা জানান, পণ্যে বিশেষ ছাড় ও মান বিবেচনায় সস্তা পেয়ে অনেক প্রবাসী আমিরাত থেকে মালামাল কিনে কার্গোর মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন নিজ নিজ দেশে। আরব আমিরাতের আবুধাবি ও দুবাইয়ের শপিংমলে আগত বাংলাদেশি ক্রেতারা জানান, দেশমাতৃকার মায়া ত্যাগ করে পরদেশে আসা প্রবাসীরা রমজানে এমন বিশেষ ছাড় পেয়ে খুবই খুশি। তারা আশা করেন, বাংলাদেশেও ব্যবসায়ীরা রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম মানুষের নাগালে রাখবেন।

বাণিজ্যিক হোটেল বন্ধ

বাণিজ্যিক হোটেলগুলো এ মাসে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শুধু ইফতারির আগে খাবারের দোকানগুলো হরেক রকমের ইফতারির পসরা সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়।

কারাবন্দিকে মুক্তি

রমজান উপলক্ষে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার বহু কারাবন্দিকে মুক্তি দেন। কারাবন্দিরা যেনো সংশোধন হয়ে পরিবারের মাঝে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে, সেজন্য এ সুযোগ দেওয়া হয় বলে সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানা যায়।

এমএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।