প্রশ্ন তসলিমা নাসরিনের

আনন্দবাজার কেন মুসলমানদের নামের বানানে ‘আকার’ কেটে লেখে

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৩৯ পিএম, ১১ জানুয়ারি ২০২৪
তসলিমা নাসরিন/ ফাইল ছবি

ভারতের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা মুসলমানদের নামের বানানের ক্ষেত্রে ‘আকার’কেটে লিখে দীর্ঘদিন ধরে। যেমন সালমান খানকে লিখে সলমন খান। বিষয়টি নিয়ে নিজের বিরক্তির কথা জানিয়েছেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।

নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তসলিমা নাসরিন লেখেন, ‘আনন্দবাজার চিরকাল মুসলমান নামের বানান থেকে আকার কেটে দিয়েছে, আহমদকে অহমদ লিখেছে, মোহাম্মদকে মহম্মদ লিখেছে, মোজাফফরকে মোজফফর লিখেছে, সালমান এফ রহমানকে সলমন এফ রহমান লিখেছে। এইবার দেখলাম আকার কাটার বদলে আকার জুড়েছে। এতকাল রশীদ খান বলে যাকে ডেকেছে, তাকে দিব্যি রাশিদ বলে ডাকছে। আর সারা বাংলা যাকে রশীদ বলতো, তাকে হঠাৎ রাশিদ রাশিদ করছে। খুব সচেতনভাবে করছে, যেন আবার উচ্চারণে ভুল না হয়ে যায়। তাহলে তো ইজ্জত যাবে, হয়তো এমন দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে যে এ তো শাস্ত্রীয় সংগীতের কিচ্ছু জানে না। আনন্দবাজার যে বানান লেখে সে বানানই সঠিক বানান, এ রকম একটি ধারণা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে চালু আছে। আমিও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বানান ফলো করি। কিন্তু জীবনে যাকে রশীদ নামে ডেকেছি, মৃত্যুতে তাকে রাশিদ নামে ডাকবো না, এ আমার সিদ্ধান্ত।’

তিনি আরও লেখেন, ‘বহু বছর আগে একবার আনন্দবাজারের এক সাংবাদিককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাঙালি মুসলমানদের নামের বানান বদলে দিচ্ছে কেন আনন্দবাজার? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, যেহেতু নামগুলো আরবি, সেহেতু সঠিক আরবি উচ্চারণের মতো বানানটা রাখা হচ্ছে। আমি বলেছি, যার নাম, সে তার বানান যেভাবে লেখে সেভাবেই তো আপনাদের লেখা উচিত।’

‘আনন্দবাজারের সরকার আর পি সি সরকার তো ইংরেজিতে দুরকম বানান লেখেন। আমরা তো তাদের বানানই মেনে চলি। মুখার্জিরাও তাদের ইংরেজি বানান নানারকম লেখেন। তাদের নামের বানান তো আমরা পাল্টাই না! আরবি শব্দ বহু বিবর্তনের পর বাঙালিরা যে ব্যবহার করছে, তা একেবারে আরবি উচ্চারণের মতো আর নয়। ফেরদৌসের নাম যে আনন্দবাজার ফিরদাউস লিখছে, কেন লিখছে? ফেরদৌস বাঙালি, জন্মের পর থেকে সে তার নামের উচ্চারণ ফেরদৌস করছে, বাংলা বানানটাও ফেরদৌস। তার নামকে বদলে দেওয়ার অধিকার তো কারও থাকার কথা নয় ‘

‘বহু আরবি-ফার্সি শব্দ বাঙালিরা ব্যবহার করে, সেসব শব্দ আরবরা এবং ফার্সিভাষীরা যেভাবে বলে, বাঙালিরা সেভাবে বলে না। বাঙালিরা যেভাবে বলে, বানানটাও সেভাবে লেখে। ইংরেজি যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, সেসব ইংরেজি শব্দ ইংরেজরা যেভাবে বলে, সেভাবে বাঙালিরা বলে না। চেয়ার ইংরেজি শব্দ, ইংরেজরা চেয়ারকে চ্যার বলে, সে কারণে আমরা তো চেয়ারকে চ্যার লিখি না, টেবিলকে টেবল লিখি না। শব্দ এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে ভ্রমণ করতে করতে রূপ-গুণ কিছু পাল্টায়, সেটা তো মনে রাখতে হবে।’

আনন্দবাজার কেন মুসলমানদের নামের বানানে ‘আকার’ কেটে লেখে

তসলিমা নাসরিন আরও লেখেন, ‘অনেকে বলছে ওস্তাদ রশীদ খান বলতেন তিনি রশীদ নন, তিনি রাশীদ। আমার হিন্দি পাবলিশার অরুণ মাহেশ্বরিকে আমি যখন অরুণ বলে ডাকতাম, তিনি বলতেন, আমি অরুণ নই, আমি আরুণ। তাই বলে বাংলায় তার নাম লিখলে আমি কি আরুণ লিখবো? লিখবো না। আমি অরুণই লিখবো। কারণ বাংলায় অরুণ শব্দটির একটি অর্থ আছে, আরুণ শব্দটির নেই। ইংরেজিতে আরুণ বানান এ আর ইউ এন লিখলেও কিন্তু এর বাংলা আমরা আরুণ করি না, অরুণ করি। আমি হিন্দিতে কথা বললে অরুণকে আরুণ বলি এখন, কিন্তু আমি যখন আমার বন্ধু অরুণ চক্রবর্তীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলি, আমি তাকে অরুণ বলে ডাকি।’

‘বাংলায় আমরা ও-কার উচ্চারণ বেশি করি, সে কারণে আরবিতে রাশীদ বললেও বাংলায় সেটি রশীদ হয়ে ওঠে। অমিতাভের উচ্চারণ তো বাংলার বাইরে আমিতাভ, তাই বলে আমরা তো আমিতাভ লিখি না, লিখি অমিতাভ। রশীদ খান তো বাংলায় বাস করতেন, বাংলায় কথা বলতেন। তার বাংলা বানান তো রশীদই হবে। রশীদের উচ্চারণ রাশীদ করুন যখন আরবিতে বা উর্দুতে বা হিন্দিতে কথা বলবেন। কিন্তু বাংলায় শব্দটি বহু আগেই বিবর্তিত হয়ে রশীদ হয়েছে। বাংলায় রশীদই লিখতে হবে এবং বলতে হবে। আফগানিস্তানের ক্রিকেটারের নাম কিন্তু আনন্দবাজার রশীদ খান বা রশিদ খানই লিখছে , রাশিদ খান লিখছে না। সেই ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করুন, ক্রিকেটার বলবেন, তিনি রশীদ নন, তিনি রাশীদ। তার নামের উচ্চারণ আফগান ভাষায় রাশীদ হলেও তিনি বাংলা ভাষায় রশীদ। বাংলায় আবদুর রশীদ শব্দটি গুগল করে দেখুন, কত লাখ আবদুর রশীদ বেরোয়। এই রশীদেরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে? এদের নামও তো আরবি শব্দ থেকে নেওয়া।’

অনেকে ভাবছে রশীদ আর রাশীদের অর্থে পার্থক্য আছে- এমন মন্তব্য করে এই লেখিকা লেখেন, ‘সে কারণে, রাশীদকে রশীদ ডাকা ঠিক হবে না। রাশীদ আর রশীদে কোনো পার্থক্য নেই। একই অর্থ দুটোর। রশীদ বা রাশীদ মানে সঠিক পথ প্রদর্শক। এই নামটি আল্লাহর নিরানব্বইটি নামের একটি। কোনো মানুষই নিজের জন্য আল্লাহর নাম রাখতে পারে না। রাখলে নামের আগে আবদুল বা আবদুর যোগ করতে হবে। আবদুল বা আবদুর মানে দাস। তাহলে পুরো নামের অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর দাস। শুধু রশীদ খান কোনো মুসলমানের নাম হতে পারে না, হতে হবে আদবুল বা আবদুর রশীদ খান।’

আনন্দবাজারকে শুধু আরবি নামের বানান বিশারদ হলে চলবে না, আরবি ভাষার অর্থ বিশারদও কিছু হতে হবে বৈকি- এমন মন্তব্যও করেন তসলিমা নাসরিন।

কেএসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।