সংসদে শামীম হায়দার পাটোয়ারীর বক্তৃতা ভাইরাল

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৩৪ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২২
সংসদে বক্তৃতারত ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী

জাতীয় সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনে জাতীয় পার্টির এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীর দেওয়া বক্তৃতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা তৈরি হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা, দেশের ভবিষ্যৎসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। এই বক্তৃতার প্রশংসা করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারী অনেকে।

র‌্যাব-পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ টেনে শামীম হায়দার পাটোয়ারী তার বক্তৃতায় বলেন, ‘স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ থাকতো না, যদি আমাদের জাতিগতভাবে ঐকমত্য থাকতো। দুঃখের বিষয়, আমরা জাতিগতগতভাবে ঐকমত্যে ব্যর্থ-ব্যর্থ-ব্যর্থ-ব্যর্থ। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি পাকিস্তানের ওপর। ১৯৭৫ সালে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। এখন কেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে? বিষয়গুলো অবশ্যই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’

অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন সংকটে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। যতই হম্বি-তম্বি করি না কেন, যতই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে আমাদের তুলনা করি না কেন, তথাকথিত লবিস্ট তত্ত্ব কিংবা পিআর নিয়ে আলোচনা করি- সমস্যার সমাধান আসবে না। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির সমাধান করার জন্য অবশ্যই আমাদের জাতীয় ঐকমত্য লাগবে।’

‘ভুলে গেলে হবে না ভেনিজুয়েলা একটা সময় পৃথিবীর বড় অর্থনীতির দেশ ছিল। আজকে ৯৭ শতাংশ মানুষ সেখানে দরিদ্রম যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে। ভুলে গেলে হবে না আফগানিস্তান-ইরাক-সিরিয়া-মিয়ানমারে কী হয়েছে? বাংলাদেশে শান্তি বজায় রাখতে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে। এটি করা সরকারি দলের মুখ্য দায়িত্ব। পাশাপাশি অবশ্যই বিরোধী দলের দায়িত্ব আছে। দেশ, মানুষ ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে কোনো প্রকার বিরোধ আমরা চাচ্ছি না।’

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার বলেন, ‘কাশ্মীর ইস্যুতে যখন জেনেভাতে ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, তখন বিরোধী দলীয় নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীকে পাঠিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও। এজন্যই ভারত এখনো টিকে আছে। ১৯৬৫ সালে যখন (পাকিস্তানের সঙ্গে) যুদ্ধ হলো তখন যুক্তরাষ্ট্র বললো, যুদ্ধবিরতি না করলে খাদ্যশস্য দেবো না ভারতকে। তখন (ভারতের প্রধানমন্ত্রী) লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তার জনগণকে বললেন, আমরা যদি সবাই সপ্তাহে একবেলা খাদ্য কম খাই, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সহায়তা লাগবে না। তাদের সেই ঐক্যের ডাকে সবাই সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ঐকমত্যের ডাকে সবাই সাড়া দেবে না, এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা।’

তিনি বলেন, ‘খুব দুঃখের সঙ্গে বলবো এই বিশাল অত্যাসন্ন এবং অবিশ্যম্ভাবী সংকটে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা আমার ব্যক্তিগত মতে অর্বাচনীন ও বালখিল্যসুলভ আচরণ করছেন। লবিস্ট ও পিআর নিয়ে যা বলেছেন তা সত্যিই হাস্যকর। পিআর-লবিস্ট আলোচনা নিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। অবশ্যই আমরা এই ব্যাপারে প্রফেশনালিজম চাই। রাষ্ট্রীয় নির্বুদ্ধিতা, রাষ্ট্রীয় অহমিকা চাই না।’

শামীম হায়দার পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে। কারণ তারা অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রজেক্ট করেছে। তারা দেউলিয়া হয়ে গেছে, কারণ তারা হঠাৎ করে অর্গানিক খাবারে চলে গেছে। সেখানে মাত্র ২৫ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় পারিবারিক একনায়কতন্ত্র ছিল বলে তাদের আজ এই অবস্থা।’

‘রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হলে প্রফেশনালি করতে হবে। এই ক্রাইসিসে আমি মনে করি সরকারের নতুন কিছু চিন্তা করার সুযোগ আছে। আমি সরকারকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবো। ক্রাইসিস মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। অভ্যন্তরীণ সংকট অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান করতে হবে। নইলে স্বাভাবিকভাবেই বহিঃশত্রু এখানে ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করার সুযোগ পাবে।’

ব্যারিস্টার শামীম বলেন, ‘১৩ বছরে তিনটি শীর্ষ বিরোধী দলের প্রধান একসঙ্গে বসে চা খাননি। আমরা বসি না। আলোচনা করতে পারি না। এভাবে চললে বহিঃশত্রু আসবেই। আমরা দেশ ও মানুষের স্বার্থে একসঙ্গে আলোচনা করতে পারি। ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্য এখন প্রয়োজন। অন্যথায় পৌনঃপুনিক সমস্যার সম্মুখীন বাংলাদেশ হবেই। সমস্যার সমাধান বাইরে চলে যাবে।’

‘আজকে একটি বাংলাদেশ ডকট্রিন প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সব দলকে একমত হতে হবে। এই ডকট্রিন ফলো করবো আমরা। ২০ বছর এই ডকট্রিন মতে ফরেন পলিসি (পররাষ্ট্রনীতি) ফলো করতে হবে। সেই পলিসি অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে।’

‘আমরা ক্রাইসিসে আছি। আমাদের বহিঃশত্রু আছে, আবার বাইরের বন্ধুও আছে। আজকে আমাদের সমস্ত বিদেশি বন্ধুদের অ্যাক্টিভেট (সক্রিয়) করার প্রয়োজন। জাপান-ভারতকে অ্যাক্টিভেট করতে হবে। ইউরোপ আমাদের আদি অকৃত্রিম বন্ধু, তাদের অ্যাক্টিভেট করার প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যকে অ্যাক্টিভেট করা প্রয়োজন। যেন আমাদের ক্রাইসিস নিয়ে এগুতে না হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের কী হবে। যদি সৌদি আরব নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে রেমিট্যান্সের কী হবে। গার্মেন্টস আর রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না।’

গণন্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেভ ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র রক্ষা)। সারা পৃথিবীর সংকট। দেশকে বাঁচাতে হবে। এ কথা সত্য এদেশে ২১ আগস্ট হয়েছে, ১৫ আগস্ট হয়েছে। তারপরও দেশের স্বার্থে জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। সহমর্মিতা প্রয়োজন। বিরোধী দল থাকবেই। সরকারি দল থাকবে। বিরোধী মত থাকবেই। এটা মেনে নিয়েই রাজনীতি করতে হবে।’

‘যিনি ক্ষমতায় থাকবেন, মন্ত্রী হবেন, প্রধানমন্ত্রী হবেন, এমপি হবেন, তাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাত দেওয়া যাবে না। আমাদের জুডিশিয়ারি (বিচার বিভাগ) ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কোনো জুডিশিয়ারি নেই ন্যায়বিচার করার মতো। আমাদের পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বিরোধী দলের সদস্যকে সভাপতি করা প্রয়োজন। যেন মন্ত্রী ও সরকার দায়বদ্ধ হন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ভালো নারী, কিন্তু তার তো দাঁত নেই (ক্ষমতাহীন)। তিনি যদি র‌্যাবের বিরুদ্ধে তদন্ত করতেন, ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে হয়তো এই নিষেধাজ্ঞার অবস্থা তৈরি হতো না। কমিশনগুলো আজ সরকারের অনুগত অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পুনর্বাসনের কেন্দ্র হয়েছে।’

র‌্যাবের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশে জঙ্গি দমনে অবশ্যই র‌্যাবের অসাধারণ ভূমিকা আছে। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে র‌্যাব পুরোপুরি ব্যর্থ। এই সরকার ব্যর্থ, দেশ ব্যর্থ, রাষ্ট্র ব্যর্থ, পুলিশ ব্যর্থ। ৮০ লাখ মাদকসেবীর দেশ বাংলাদেশ। বিশাল একটা মার্কেট তৈরি হয়ে গেছে।’

শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আজকে আমরা দেখছি রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা নেই। রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা সরিয়ে আমলাদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। ডিসি সম্মেলন হয়েছে। সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ডিসিদের) খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জনপ্রতিনিধিদের বিষয়গুলো সহানুভূতির সঙ্গে দেখবেন। তাহলে ডিসি সাহেবদের সহানুভূতি নিয়ে আমাদের রাজনীতি করতে হবে? আমাদের তাদের অনুকরণ করতে হবে? আমরা জনপ্রতিনিধি। এদেশে ১৯৭১ সালে যদি যুদ্ধ না হতো, যদি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন না হতো, কেউ সচিব হতে পারতেন না। আমরা যদি এদেশ থেকে ব্রিটিশদের সরাতে না পারতাম, তাহলে আমলারা সর্বোচ্চ সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি করতেন। অথচ রাজনীতিবিদদেরই কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে।’

‘২০ কোটি টাকার প্রকল্প আমাদের দেওয়া হয়েছে তিন বছর আগে, অথচ পাঁচ কোটি টাকার কাজও হয়নি। জনগণের কাজ যদি করতে না পারি, ভোট চাইবো কীভাবে? রাস্তাঘাট-সেতু, স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি তৈরি করতে না পারি, একটা তিন কাঠার জমি আর একটা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ির জন্য আমরা কেউ রাজনীতি করতে আসিনি।’

সংসদকে সব সমস্যার সমাধানের জায়গা বানানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানেও আমরা ব্যর্থ। আমরা বলে যাই সরকার শুনে যায়। আমাদের বুঝতে হবে, একজন সংসদ সদস্য সংসদের কাছে দায়বদ্ধ নন। কিন্তু একজন মন্ত্রী সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। এ কথাও আমরা ভুলে গেছি। সংসদ যদি সমাধানের জায়গা হতো তাহলে আজকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসতো না।’

তারুণ্যনির্ভর রাজনীতিকে উদ্বুদ্ধ করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তরুণদের রাজনীতি করার উৎসাহ দিতে হবে। রাজনীতিতে তারুণ্যকে নিয়ে আসেন, দায়িত্ব দেন। তারাই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবে। প্রৌঢ়ের প্রজ্ঞা আর তারুণ্যের তারুণ্য এগিয়ে নিতে পারে দেশকে।’

‘প্রধানমন্ত্রীকে এখন দেখা যায় না। যিনি হেড অব স্টেট হবেন, জনগণ তাকে দেখতে চাইবে। রাজনীতিবিদ তাকে দেখতে চাইবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে করোনা কিংবা নিরাপত্তাজনিত কারণে দেখতে পাচ্ছি না। এর একটা সমাধান করতে হবে। জনগণ-রাজনীতিবিদদের সঙ্গে যদি প্রধানমন্ত্রীর সংযোগ হারিয়ে যায়, তাহলে সেদেশ কখনোই ভালো চলতে পারে না। এই সংযোগটা স্থাপন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে তথ্য দিতে হবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে নিয়ে। কোনো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের উপজেলাগুলোতে সম্পূর্ণ হাসপাতাল করতে হবে। উপজেলা কোর্ট করতে হবে। পাশাপাশি উপজেলাতে বিভিন্ন সেন্টার করতে হবে। যেন দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়। ছোটখাট কাজের জন্য আমাদের যেন জেলা পর্যায়ে যেতে না হয়। ঢাকামুখি যেন না হতে হয়। এ বিষয়ে অবশ্যই আমাদের সতর্ক হতে হবে।’

‘ধর্মীয় সহনশীলতা। পূজামন্ডপে আঘাত হানা হলো। কাওয়ালীর মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কী আশ্চর্য! এটা কী বাংলাদেশ! এই বাংলাদেশতো আমরা ছোটবেলায় দেখিনি। এমন বাংলাদেশের কথাতো আগে শুনিনি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই মণ্ডপগুলো যখন ভাঙা হলো তখন স্থানীয় জনগণ ও রাজনীতিবিদরা কেন এগিয়ে আসলেন না। এই এগিয়ে না আসার ব্যর্থতা রাষ্ট্রের।’

(বক্তৃতা সংক্ষেপিত)

এমআরএম/এইচএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।