রাতের ডিস্কো ঢাকার ডিস্কো

বাইরে থেকে হঠাৎ কক্ষে ঢুকলে চোখ ধাঁধানো আলোয় গোল বেঁধে যাবে। ধাঁধায় পড়ে থমকে যাবে আগন্তুকরা। পুরনোরা অবশ্য সহসাই অন্দরমহলে প্রবেশ করে।
দুই স্তরের দরজা। কলাপসিবল গেটও থাকে। দরজার ভেতর-বাহির পিঠঘেঁষে রক্ষী দাঁড়ানো। রক্ষী থাকে কক্ষের ভিতর-বাহিরেও। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাও থাকে কোনো কোনোটিতে। কড়া নিরাপত্তা সর্বত্রই। ভবনের সদর গেট থেকে শুরু করে রাস্তার মোড় পর্যন্তও তীক্ষ্ণ নজর। তবে অভ্যর্থনা মেলে গাড়ি বা রিকশা থেকে পা নামানোর পরই।
ডিস্কো। ঢাকার ডিস্কো, রাতের ডিস্কো। যার বাংলা রূপ টাকাওয়ালাদের আনন্দ কুঞ্জ। বাংলামোটরের মোড়ের উপরেই বহুতল ভবনের দোতলায় আধুনিক মানের মদের বার ‘শেল’। রাত ১০টার পরই বন্ধ হয়ে যায় বারের দরজা। এর একতলা উপরেই ডিস্কো। এটি রাসেলের প্যাড নামে পরিচিত। প্রবেশে ফি লাগে না। তবে পুলিশকে জানিয়েই চালাতে হয় ডিস্কো।
সম্প্রতি রাসেলের ডিস্কোতে দেখা মিলল রাতের ঢাকার রঙ্গরূপ। ছোট্ট একটি কক্ষ। তাতে শোফা বসানো চারদিকে। শব্দ নিয়ন্ত্রণে পুরো দেয়াল আরও পুরো করা হয়েছে বিভিন্ন স্তরের সংযোজনে। দুই কোণায় সাউন্ড বক্স। যন্ত্রীদের কি-বোর্ড, প্যাড রাখা আছে কাপড়ে ঢেকে। একঘেয়েমি কাটাতে ড্যান্সের মাঝে মাঝে গানের তালে বাজানো হয় সেগুলো।
শোফায় বসে থাকা অতিথিরা ‘বাবু’ নামেই বেশি পরিচিত। আর নর্তকীরা ‘ড্যান্সার’। বাবু আর ড্যান্সাররা মিলেমিশেই বসে শোফায়, যার অনেকটাই অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে। সামনে টি-টেবিল। তবে সেখানে চা মেলানো ভার। চা না মিললেও মদ মেলে খুব সহজেই। একই মদের পেয়ালায় বাবু আর ড্যান্সার মিলে চুমুকে চুমুকে ঝড় তোলে।
বাবুদের ভিড় যখন বাড়ে তখন কক্ষে আর আগের রূপ থাকে না। সিগারেটের ধোঁয়া আর রঙিন আলো মিলে ভিন্ন রঙ তৈরি হয়। খানিক থাকলেই দম বন্ধের উপক্রম। বদ্ধ ঘরে প্রায় সবার হাতে থাকা সিগারেটের ধোঁয়ার জ্বালা-পোড়ায় মুহূর্তেই চোখ রক্তিম হয়ে ওঠে। খানিক ফূর্তি করে বাবুরা চলে গেলেও ড্যান্সারদের যাওয়ার উপায় নেই। টাকার নেশায় নরকসম কক্ষটিতে তাদের থাকতে হয় রাতভর।
রাত গভীর হয়, বাবুদের সংখ্যাও বাড়ে। ডিস্কোর ঝাঁপি খোলার আগেই বাবুরা আমন্ত্রণ পায় ড্যান্সারদের কাছ থেকে। ড্যান্সাদের কেউ কেউ একা এলেও অধিকাংশের সঙ্গে মায়েরা আসেন। তবে মায়েরা থাকেন আলাদা ঘরে, প্রায় বন্দি অবস্থায়। তাদের সামনে আসতে মানা।
চটুল বাংলা গান দু-একটি মিললেও বেশিরভাগ ড্যান্সই হয় হিন্দিগানের তালে। উচ্চস্বরে বাজানো হিন্দি গানে আর পশ্চিমা পোশাকে ড্যান্সাররা যখন দেহ নাচায়, তখন বাবুদের কেউ কেউ মাতাল বনে যান। এক হাতে মদের পেয়ালা, অন্য হাতে টাকা। ড্যান্সের তালে মদ গিলে আর উড়ায় টাকা। কেউ আবার নারী শরীরের নাচে নিজেকেও নাচায়।
কথা হয় ড্যান্সার মারিয়ার সঙ্গে। ছোট বোনসহ ডিস্কোতে ড্যান্স করেন চার বছর ধরে। থাকেন মালিবাগে। বলেন, ‘আমাদের সংসার এখন ড্যান্সের টাকায়ই চালাতে হয়। ছোট বোন কলেজে পড়ে। আমার কলেজে পড়া হয়নি।’
এমন পেশায় ঝুঁকি আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘ঝুঁকি তো সব সময়ই। রাতে যখন ঘর থেকে বের হই, তখন থেকেই ঝুঁকি। মাতাল, অসভ্য মানুষদের সামনেও ড্যান্স করতে হয়। শখে তো আসি না। এরই নাম বেঁচে থাকা।’
রাজধানীতে নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে এখন প্রায় ৭০’র বেশি ডিস্কো রয়েছে বলেও জানান মারিয়া।
জেরিন নামের অপর এক ড্যান্সার বলেন, এ লাইনে প্রায় সাত বছর কাটছে। ভক্তদের মন জোগাতেই এমন বদ্ধঘরে রাতের পর রাত কাটে আমাদের। বলতে পারেন দিনের আলো আমাদের দেখতে মানা। ডিস্কোর লাল-নীল আলোর সঙ্গেই আমাদের জীবনের মিতালী।
এএসএস/এএইচ/ওআর/আরআইপি