দুর্গম পাহাড়ে উষ্ণতার পরশ

আবু আজাদ
আবু আজাদ আবু আজাদ , নিজস্ব প্রতিবেদক রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ১০:৩১ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

শীতের কাপড় নিতে এসেছিল আট-দশ বছরের এক বালক। সারা গা ধুলোয় মাখামাখি। জানাল তার নাম ‘থুম’। থুমের কোনো শীতের কাপড় নেই। এমনকি নিয়মিত পরার জন্য শুধু দুটো শার্ট আছে বাসায়। যা সে রাতে পরে।

থুম ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে, ‘এখানে কেউ কখনও এভাবে কাপড় নিয়ে আসেনি। আমার বাবা তো সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে, মা যা পায় তা সবাই মিলে খাই।’

এ কথা শুনে থুমের জন্য টি-শার্ট ও শীতবস্ত্রের পাশাপাশি তার মায়ের জন্য একটি জামা তুলে দিল সেবা সংঘের সদস্যরা। কাপড় হাতে পেতেই এক দৌড়ে নিজের নৌকায় উঠে বসে থুম। নৌকা ছেড়েই নিজের নতুন জামা পরে খুশিতে আত্মহারা ছোট্ট ছেলেটি। হাসতে হাসতে বাড়ির পথে চালাতে থাকে বৈঠা...

প্রতি বছর শীতে বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী তরুণদের শীতবস্ত্র বিতরণ করতে দেখা যায়। চলে পুরনো কাপড় সংগ্রহের জন্য মাইকিং আর সাঁটানো হয় পোস্টার। যার অধিকাংশই প্রচারনির্ভর ও শহরকেন্দ্রিক। চট্টগ্রামের কিছু যুবক সেই ধারার বাইরে থেকে ছুটে গেছেন রাঙ্গামাটির দুর্গম পাহাড়ে। সভ্যতা থেকে দূরের জনপদে এই শীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন উষ্ণতার পরশ।

Rangamati-sm

রাঙ্গামাটি শহর থেকে নৌপথে প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি পথ পাড়ি দিলে, নীল জলরাশির ওপারে দেখা যায় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা গবঘোণা। বিশাল বিশাল পাহাড়ের ভাঁজে একটি-দুটি ঘর। পঞ্চাশটিরও বেশি পাহাড়ি টিলায় হাজার তিন পাহাড়ি ও বাঙ্গালির বসবাস। নেই ইলেকট্রিসিটি, রাস্তাঘাট বা সুপেয় পানির সুবিধা। এমনকি এ জনপদের একমাত্র বিদ্যালয়টিও গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সব ধরনের জরুরি প্রয়োজনে তাদের বিশাল কাপ্তাই হ্রদ পাড়ি দিতে হয়।

গত শুক্রবার (১৮ জানুয়ারি) রাঙ্গামাটির দুর্গম সেই পাহাড়ি এলাকা গবঘোণা, মগবান ও রিজার্ভবাজার এলাকায় শীতবস্ত্র ও কাপড় বিতরণ করে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের সেচ্ছাসেবী সংগঠন সেবাসংঘ। সেবাসংঘের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে রাঙ্গামাটির মানবাধিকার সংগঠন ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস।

সংগঠনের পরিচালক ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সৌরভ বড়ুয়া বলেন, আমরা তেলে মাথায় তেল দিতে চাই না। চাই না শীতবস্ত্র বিতরণের নামে ফটো সেশন বা মিডিয়াবাজি। তাই নিজের কষ্টের টাকা আর শ্রমে সংগৃহীত কাপড়গুলো তাদের প্রকৃত দাবিদারদের হাতে তুলে দিতে রাঙ্গামাটির এই দুর্গম পাহাড়ে এসেছি। এখানে না আসলে বুঝতেই পারতাম না মানুষ কতটা অসহায়।’

Rangamati-sm

কথা হয় দুর্গম পাহাড়ি এলাকা গবঘোণার বাসিন্দা রবাধন চাকমার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, শীতের কাপড় বিতরণের কথা বিভিন্ন সময় শুনেছেন, কিন্তু কখনও দেখেননি। ‘এই মানুষগুলোকেই প্রথম দেখলাম কাপড় নিয়ে আমাদের গ্রামে আসতে। এটি অনেক বড় কাজ। আমাদের অনেক পরিবারের নারী ও শিশুদের প্রয়োজনীয় শীতের কাপড় নেই। কেনাও সম্ভব হয় না। অথচ পাহাড়ে শীতের তীব্রতা বেশি। শীতের কষ্টে গ্রামের অনেকেই রোগে ভুগছেন। অনেক শিশু-বৃদ্ধা মারাও গেছেন।’

রবাধন চাকমা আরও বলেন, ‘আমরা সবাই কৃষিকাজ আর মাছ ধরে জীবন চালাই। শীতের কাপড় কেনার টাকা কোথায় পাব? এমনিতে বাচ্চাগুলো সারাদিন উদাম গায়ে থাকে, সন্ধ্যায় ঠান্ডা নামলে ঘরে থাকা দু-তিনটা জামা একসঙ্গে পরে নেয়, না হয় কাঁথা মুড়ি দেয়। আমাদের আলাদা কোনো শীতের কাপড় নেই। এর আগে কেউ এখানে আসেওনি।’

এই তো কিছুদিন আগে নির্বাচন গেছে, তখনও আসেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে রবাধন চাকমা বলেন, ‘না’। আঙ্গুল তুলে দূরের একটি পাহাড় দেখিয়ে বলেন, ‘দীপঙ্কর বাবু (বর্তমান সংসদ সদস্য) এসেছিলেন, ওই বাঙ্গালি পাড়ায়। আমাদের এখানে কেউ আসে না।’

Rangamati-sm

গবঘোণা থেকে আরও একটু দূরে মগবান এলাকা। নাম ভিন্ন হলেও পরিস্থিতির কোনো ভিন্নতা নেই। শীতবস্ত্র নিয়ে বিতরণকারীদের বোটটি ঘাটে ভিড়তেই ছুঁটে আসে কিছু বালক-বালিকা। যাদের অনেকের গায়ে কোনো কাপড় নেই। সেখানেই কথা হয় ছোট্ট শান্ত ত্রিপুরার সঙ্গে।

শান্ত ত্রিপুরা জানায়, সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে শহরের ‘শাহ সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে’। বাড়ির আশপাশে কোথাও স্কুল না থাকায় তাকে তার আত্মীয়র বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে হচ্ছে। মা-বাবার সঙ্গে থাকার সুযোগ হয় না তার।

শর্মিলী ত্রিপুরা নামে এক নারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ভোগে নারীরা। তাদের কথা কেউ ভাবে না। পুরুষদের অনেকে বাজারে যায়। তাই তারা নিজেদের প্রয়োজন মতো কিছু কেনাকাটা করে। কিন্তু নারীদের জন্য শীতে তেমন কোনো আলাদা ব্যবস্থা নেই। নিত্য কাপড় দিয়েই তাদের শীত নিবারণ করতে হয়। এই যে দাদারা আমাদের জন্য কাপড়-সোয়েটার এনেছে, এমন দিনের কথা আমরা কখনও কল্পনা করতে পারিনি।’

Rangamati-sm

কোনো এনজিও কি এখানে সহায়তা নিয়ে আসে না- এমন প্রশ্নের জবাবে শর্মিলী ত্রিপুরা বলেন, ‘এডিবি নামে একটি এনজিও মাঝেমধ্যে আমাদের কাছে আসে। বেশ কিছুদিন আগে দুটি পাওয়ার টিলার সহায়তা করেছে গ্রামের কৃষকদের। কিন্তু নগদ অর্থ, খাবার বা পোশাকের সহায়তা আমরা কখনও পাই না।’

‘আমাদের দেশে শীতবস্ত্র বিতরণ কার্যক্রম তখনই শুরু হয়, যখন অধিক শীত পড়ে, বয়োবৃদ্ধদের মৃত্যুর খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেতে শুরু করে। আবার শীতবস্ত্র বিতরণকারীদের মধ্যে দেখা যাবে শহরকেন্দ্রিক বস্তি ও ফুটপাতে বিতরণের প্রবণতাই বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠান আর সংগঠনকে পাওয়া যায়, যাদের বিতরণের তুলনায় ব্যানার ও প্রচারলাভের চেষ্টাই বেশি থাকে। আমরা সেই ধারাটা ভাঙতে চেয়েছি। সমাজ-সভ্যতা থেকে অনেক দূরের মানুষগুলোর দুয়ারে এসেছি তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিতে’- বলেন সংগঠনের সহ-পরিচালক অনিন্দ্র চক্রবর্তী।

Rangamati-sm

পাহাড়ে শীতবস্ত্র বিতরণে ইভেন্ট পার্টনার হিসেবে সহায়তা করেছে ‘ইভেন্ট৭১’। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিয়ান মাহমুদ রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমে পরিকল্পনাটি বেশ কঠিন মনে হয়েছিল। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে শীতবস্ত্র বিতরণের আইডিয়া ছিল চ্যালেঞ্জের। কিন্তু ছেলেরা কাপড় সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্যাকেটিং ও বিতরণ খুব দক্ষতার সঙ্গে করেছে। সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছি অসহায় মানুষগুলোর চোখে খুশির ঝিলিক দেখে।’

আবু আজাদ/এমএআর/আরএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।