অগভীরে ‘গভীর’ নলকূপ, জলে ৫৮ লাখ

প্রদীপ দাস
প্রদীপ দাস প্রদীপ দাস , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১৩ পিএম, ২৫ মে ২০১৯

নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট– এ অঞ্চলের পানির স্তর অনেক উপরে। প্রয়োজন অগভীর নলকূপ। কিন্তু সরকারের একটি প্রকল্পে অগভীর নলকূপের জায়গায় এখানে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে গভীর নলকূপ!

প্রকল্পটিতে ৩২৫টি ডেভ হেড গভীর নলকূপের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু গভীর নলকূপের পরিবর্তে ২২ হাজার টাকা মূল্যের ৬ নম্বর অগভীর নলকূপ ওই অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য। ফলে সরকারের বাড়তি খরচ হচ্ছে ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা!

আরও পড়ুন >> ভালো নয় রংপুর বিভাগের ৭২% প্রকল্পের অগ্রগতি

এছাড়া প্রকল্পের আওতায় ল্যাট্রিনের জন্য দেয়া টিনেও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে।

প্রকল্পটির নাম ‘সাবেক ছিটমহল এলাকাসমূহকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদানপূর্বক লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন’। এ চার জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর।

শুধু তা-ই নয়, বরাদ্দের এক কোটি ৩০ লাখ টাকা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। সম্প্রতি রংপুরে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের উপস্থিতিতে এ প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, নীলফামারী জেলার জন্য ডেভ হেড গভীর নলকূপ প্রযোজ্য নয়। কিন্তু আলোচ্য প্রকল্পে এ অঙ্গের সংস্থান রয়েছে। ফলে এ অঙ্গের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া এক কোটি ৩০ লাখ টাকা অব্যয়িত থাকবে। অর্থাৎ প্রযোজ্য না হওয়ায় এ টাকা ব্যয় হবে না।

এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক মো. বাহার উদ্দিন মৃধা জাগো নিউজকে জানান, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট– এ চার জেলাতে পানির স্তর অনেক উপরে। এখানে ডেভ হেডের মতো গভীর নলকূপের প্রয়োজন নেই। তবে অনেক আগেই ডেভ হেড টিউবওয়েলের দরপত্র দেয়া হয়েছে। টাকা কমে যাবে দেখে ঠিকাদাররা গভীর ডেভ হেডের পরিবর্তে অগভীর নলকূপ বসাতে চাইছেন না।

আরও পড়ুন >> এক ভুলে গচ্চা ৩০০ কোটি!

অর্থাৎ, ঠিকাদাররা ডেভ হেড নলকূপ বসিয়ে ফেললে সেই টাকা দিতে হবে সরকারকে।

অথচ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাজ চলছে। ডেভ হেড হলে আরও ভালো। আরও ভালো পানি পাওয়া যাবে। ক্ষতি তো নাই কোনো।’

ঢাকায় থাকা প্রধান প্রকৌশলী ‘ক্ষতি নাই’ দাবি করলেও রংপুরের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে সুপারিনটেনডেন্ট প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বাহার উদ্দিনের জানালেন বেশকিছু সমস্যার কথা। অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা বাহার উদ্দিন মৃধা বলেন, ‘ডেভ হেড টিউবওয়েলের আরেকটা সমস্যা আছে। এ ধরনের টিউবওয়েল অত্র এলাকার মানুষ অপারেশন করতে অভ্যস্ত নন। এর ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা) একটু জটিল। যেহেতু এ এলাকায় এ ধরনের টিউবওয়েল হয়-ই না, একদমই হয় না, তাই তারা অজ্ঞ। অতএব এটা যদি একবার নষ্ট হয়, তাহলে এর মেরামত একটু জটিল। রিপেয়ারিং পার্টস পাওয়া যায় না, ঢাকা থেকে আনতে হয়। এ কারণে আমি অনীহা জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, দেখেন যদি এ টিউবওয়েল একবার নষ্ট হয়, তাহলে তারা ফেলায় রাখবে। জানাবেও না। কয়েকটা জানালেও পরে ঢাকা থেকে গিয়ে …।’

তিনি বলেন, ‘এ এলাকায় পানির লেয়ার অনেক উপরে, ছয় নম্বর অগভীর নলকূপেই হয়। ডেভ হেডটা বসানো হয় সাধারণত যেখানে পানির স্তর অনেক নিচে। সে জায়গায় এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ এলাকার পানির লেয়ার অনেক উপরে। প্রযোজ্য নয়, সেটাও নয়। লাগায় দিলে পানি পাবে, কোনো সমস্যা না। যেটা না হলেও হতো, কিন্তু প্রকল্পের মধ্যে ধরা আছে, আমি তো ওভাবে কিছু বলতে পারি না, কারণ এটা তো একনেকে পাস করা। তারপরও একটা রিস্ক নিয়েছিলাম যে করেই হোক, আমি এটা ঢাকা থেকে অনুমোদন করিয়ে আনব।’

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতারের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমানও বিষয়টা জানেন বলে প্রকল্প পরিচালক জানান। বাহার উদ্দিন মৃধা বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে উনি আমাকে একটা অনুমোদনও দিয়েছিলেন। যে ডেভ হেডের পরিবর্তে ৬ নম্বর টিউবওয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে।’

বাহার উদ্দিন মৃধা জানান, প্রতিটি ডেভ হেড নলকূপের দাম ৪০ হাজার টাকা করে। আর ৬ নম্বর অগভীর নলকূপের দাম একেকটা ২২ হাজার টাকা। ডেভ হেডের পরিবর্তে ৬ নম্বর অগভীর নলকূপ দিলে প্রতিটিতে ১৮ হাজার, অর্থাৎ ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিল কম পাবেন ঠিকাদাররা। চার জেলায় চারজন ঠিকাদার রয়েছেন।

‘কিন্তু টাকা কমে আসে বলে ঠিকাদাররা ওটাতে রাজি নন। ধরন পরিবর্তন হলে তাদের খরচ কমবে, টাকাও কমে আসবে। সেই প্রস্তাবে তারা এখন পর্যন্ত রাজি হয় নাই’- যোগ করেন বাহার উদ্দিন মৃধা।

আরও পড়ুন >> মূল পরিকল্পনায় ব্রডগেজ, নির্মাণ ডুয়েলগেজ!

তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্পে নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাট– এ চার জেলার ছিটমহলগুলোর ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ছিটমহল এলাকায় পানির সমস্যা আছে। টিউবওয়েল অপ্রতুল। সেগুলো সাম্য অবস্থায় আনার জন্য প্রকল্পটা নেয়া হয়।’

প্রকল্প পরিচালকের তথ্য মতে, এ প্রকল্পের আওতায় ৬ নম্বর অগভীর নলকূপ দেয়া হবে তিন হাজার ৩৭৫টি। ওগুলোর কাজ শেষের দিকে। প্রায় ৮৫ ভাগ কাজ হয়ে গেছে। ওই চার জেলাতে গভীর নলকূপ বরাদ্দ আছে ৩২৫টি। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে প্রায় ১০০টি, লালমনিরহাটেও ১০০টির মতো, নীলফামারীতে ৭৫টি এবং বাকিগুলো পঞ্চগড়ে। তবে জটিলতার কারণে ডেভ হেডগুলো এখনও বসানো শুরু হয়নি।

ল্যাট্রিনের টিনে দুর্নীতি

এ প্রকল্পের আওতায় দেয়া ল্যাট্রিনের বেড়ার টিনেও অনিয়ম পেয়েছে আইএমইডি। তাদের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফুলবাড়ি উপজেলার দাশিয়াছড়া ছিটমহলের আব্দুস সামাদ মিয়ার বাড়িতে নির্মিত ল্যাট্রিনের বেড়ার টিনের পুরুত্ব ০.১৫ মিলিমিটার পাওয়া গেছে। অথচ থাকার কথা ০.১৮ মিলিমিটার।

তবে বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন প্রকল্পটির পরিচালক মো. বাহার উদ্দিন মৃধা। তিনি বলেন, ‘দু-একটা হতে পারে। একেবারে ফ্রেশ আছে, আমি সেটা বলব না। কম-বেশি একটু হবে বা ঠিকাদাররা করে, এটা তো স্বাভাবিক। আপনারা তো ঠিকাদারদের মানসিকতা জানেন, কমায়-ঠমায় আর কী!’

বাহার উদ্দিন মৃধা আরও বলেন, ‘আইএমইডির এক ভদ্রলোক আসছিলেন। মাঝেমধ্যে ইন্সপেকশন হচ্ছে। শুধু আবদুস সালাম নন, আরও কয়েকটা বাড়িতে পাওয়া গেছিল। ওই জায়গায় ০.১৮ হওয়ার কথা, ওরা পাইছিল ০.১৫। এটা আমার নলেজে আছে। তবে যে কয়জনের পাওয়া গেছিল, সেগুলোর টিন আমরা চেঞ্জ করায় দিছি।’

এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেবেন কি-না, জানতে চাইলে প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেন, ‘অবশ্যই নেব। নেব না কেন? আমি আগে আইএমইডির রিপোর্টটা পাই, তারপরে দেখব।’

আরও পড়ুন >> জাপানি হাতেই ফের কেরামতি

আইএমইডির পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় কুড়িগ্রাম জেলায় ২৪০০ বর্গফুটের ডাক বাংলো নির্মাণের সংস্থান রয়েছে। কিন্তু ঘন ঘন ডিজাইন পরিবর্তন করায় নির্মাণকাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে।

মোট ২৮ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। তবে আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পটি ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

পিডি/এনডিএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।