সম্ভাবনার কুমির চাষে ‘বাধা’ আইনি জটিলতা!

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ভালুকা (ময়মনসিংহ) ঘুরে
প্রকাশিত: ০৩:৫৬ পিএম, ০৬ ডিসেম্বর ২০২১

ভালুকার প্রত্যন্ত এক গ্রাম। চারদিকে ক্ষেত, ফসলি জমি, পুকুর। কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার ভিতরে বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে একটি রেপটাইলস ফার্ম। ইটের প্রাচীরে স্যাঁতলা। মরচে ধরা গেট বলে দিচ্ছিল জৌলুসে ভাটা পড়েছে। ভিতরে ঢুকেও দেখা গেলো সেই ছাপ স্পষ্ট। অথচ বাংলাদেশে কুমির চাষে আশার আলো দেখিয়েছে ভালুকার এই রেপটাইলস ফার্ম। বাণিজ্যিকভাবে চাষ ও রপ্তানি করে আয়ের পথও দেখিয়েছে তারা।

১৫ একর জায়গায় ২০০৪ সালে মাত্র ৭৪টি কুমির নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন খামারে ২৫শ কুমির। এরই মধ্যে প্রায় ১৬শ রপ্তানিও করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের দেখানো পথে রপ্তানিতে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক এ ব্যবসায় ২০০৯ সালে নামে আকিজ ওয়াইল্ড লাইফ লিমিটেড। ৫০টি নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন তাদের খামারেও আছে দুই হাজার কুমির।

কুমির ব্যবসা ও চাষের সেই পথিকৃত রেপটাইলস ফার্ম এখন নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। সমস্যার কারণে পর্যাপ্ত খাবারও পাচ্ছে না ফার্মের কুমিরগুলো। অথচ ৪/৫শ রপ্তানি উপযোগী কুমির রয়েছে খামারে।

jagonews24

ভালুকার রেপটাইল ফার্ম ঘুরে দেখা যায়, ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের ৪১টি চৌবাচ্চা। ইট দিয়ে ঘেরা চৌবাচ্চার মধ্যে কিছু পানি, উঁচু মাটির ঢিবি, আবার লম্বা ঘাসও রয়েছে। বয়স ও সাইজ অনুযায়ী রাখা হয়েছে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চায়। আওয়াজ না পেলে খুব বেশি নড়ে না এরা। বুক আঁকড়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। প্রখর রোদে কিছু কুমিরকে দেখা গেলো পানিতে শরীর ডুবিয়ে বসে থাকতে। কিছু কুমির বেশ বড় সাইজের। পাশে থাকা কয়েকজন কর্মী সাবধান করছিলেন। কখন না আবার লাফিয়ে উঠে আক্রমণ করে! খামারের নিরিবিলি পরিবেশের সুযোগে আশপাশের গাছে বাসা বেঁধে অসংখ্য বক। তাদের কিচিরমিচির আওয়াজ লেগেই থাকে সারাদিন।

খামারের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু সাইম আরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, ২০০৪ সালে যাত্রা শুরু করে এই ফার্ম। ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজার পাঁচশ কুমির আছে বর্তমানে। ডিম থেকে ফোটার পর কুমির ছয় মাসে পরিপক্ব হয়। এরপর থেকে ডিম দেয়। সাধারণত ডিম দেয় বর্ষাকালে। প্রজনন থেকে রপ্তানি পর্যন্ত সব প্রক্রিয়া খামারেই হয়।

তিনি বলেন, ২০১০ সালে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬৭টি হিমায়িত কুমির রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক রপ্তানি শুরু করে রেপটাইলস। ২০১৯ পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচবারে জাপানে রপ্তানি করা হয়েছে ১৫০৭টি চামড়া।

jagonews24

ডা. আরিফ জানান, জাপান, ইতালি, ফ্রান্স ও সিঙ্গাপুরে চামড়ার চাহিদা ব্যাপক। কুমিরের চামড়া দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ, ওয়ালেট, বেল্টসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয়। একেকটি চামড়ার রপ্তানিমূল্য চার থেকে পাঁচশ ডলার।

‘ডিম থেকে ফুটে রপ্তানিযোগ্য হওয়া পর্যন্ত এদের পেছনে খরচ আড়াইশ ডলার। লাভ হয় দেড় থেকে দুইশ ডলার। এটা ছিল প্রাথমিক হিসাব। বেশি রপ্তানি করা গেলে লাভের পরিমাণও বাড়বে।’

কুমিরের মাংসেরও রপ্তানি চাহিদা আছে বলে জানান আরিফ। তিনি বলেন, আমরা এখন মাংস ডাম্প (মাটিচাপা দিয়ে নষ্ট) করি। মাংস বেশি পরিমাণ হলে রপ্তানি করার সুযোগ আছে, চাহিদাও আছে। কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনে মাংসের চাহিদা বেশি। এসব দেশের মানুষ কুমিরের মাংস খায়।

jagonews24

জানা যায়, এখন খামারে চার-পাঁচশ রপ্তানি উপযোগী কুমির আছে। কোম্পানির ঋণ সংক্রান্ত আইনি জটিলতায় রপ্তানি বন্ধ। এখন শুধু খরচই হচ্ছে, আয় নেই। যে কারণে কুমিরগুলোকে খাবার দেওয়া হচ্ছে স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এতে একসময় ডিম দেওয়া, প্রজনন ক্ষমতা ও শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে সব কুমির।

২০২০ সালের অক্টোবরে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ (জব্দ) করার পর থেকে খাবারের স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কে কোথায়, তারও হদিস নেই। আইনি জটিলতা তৈরি হয়েছে। কোম্পানির বিকল্প আয়ও নেই। এখন আশপাশে চাষাবাদের (কৃষি) আয় থেকে ম্যানেজ করে খাবার সরবরাহ করছেন বলে জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক আরিফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ২১/২২জন লোক শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। সব মিলিয়ে খামারের মাসিক খরচ আট-নয় লাখ টাকা। সেখানে কোনো আয় নেই। চলবে কীভাবে?

সমাধান কী হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, পুরো ফার্ম সেল হতে পারে। অথবা রপ্তানির অনুমোদন দিয়ে সেটার আয় দিয়ে কুমিরের খাবারের যোগান দেওয়া যেতে পারে।

jagonews24

জানা যায়, এই খামারে কুমিরের খাবারে মাসে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হতো। এখন সেটা লাখেরও নিচে করা হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশপাশের খামারগুলোর মরা মুরগি সংগ্রহ করে দেওয়া হয় খাবার হিসেবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বাইরে এমন জটিলতা হলে চ্যারিটি ফান্ড করে চালু রাখতো। এই প্রাণীগুলো বাঁচাতো। কিন্তু আমাদের দেশে এই প্রাণীগুলোর ধুঁকে ধুঁকে মরার উপক্রম। আরও খামারের অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন। এই ব্যবসা প্রসারের সুযোগ দিলে একজন ক্ষতিগ্রস্ত হলে আরেকজন রিকভার করতে পারবে। অন্তত কিনে নিতে পারবে।

এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণী সম্পদক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ভালুকার বাথুরায় একটা ফার্ম আছে জানি। তারা ভালো করছে। খাবার সংক্রান্ত কোনো জটিলতা আমার জানা নেই। আমি দু-একদিনের মধ্যে ভিজিট করে ব্যবস্থা নেবো।

এ বিষয়ে কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। অফিসের কর্মচারীরা বলছেন, ‘প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ভালো বলতে পারবেন।’ তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায় পিকে হালদার দেশের বাইরে পলাতক।

এসইউজে/এএ/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।