পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে অনন্য ভূমিকায় ‘আঁচল’

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:৫৫ পিএম, ০৩ মার্চ ২০২২
শিশুদের নিয়ে গান-আড্ডায় একজন আঁচল মা

**বিশ্বে বছরে তিন লাখ ৫৯ হাজার মানুষের মৃত্যু পানিতে ডুবে
**বাংলাদেশে দিনে গড়ে ৪০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়
**আঁচল কেন্দ্র থাকা এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু কমছে
**৬ জেলায় আছে ৩২০০টি আঁচল কেন্দ্র

**‘আঁচল’ অনুসরণে নেওয়া হয়েছে প্রায় ২৭২ কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প

নাড়িছেড়া ধন হারানোর শোকে বিহ্বল মোছাম্মাৎ ফারজানা বেগম। এই শোকের সান্ত্বনা নেই। তার কান্না ক্ষণিকের জন্য উপস্থিত সবাইকে আবেগাপ্লুত করলেও সন্তান হারানোর বেদনা কাউকে ছুঁয়ে যায় না।

ফারজানার এক বছর তিন মাস বয়সী মেয়ে আলিয়া আফরিন রিতু গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর পানিতে ডুবে মারা গেছে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার একপর্যায়ে গুমরে কেঁদে ওঠেন ফারজানা।

এর মধ্যে আর প্রশ্ন চলে না। পাশেই দাঁড়ানো ফারজানার প্রতিবেশী আশরাফুল ইসলাম বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে ঢালু ধানক্ষেতে একটি অংশের দিকে নির্দেশ করে বললেন, ‘এইহানেই মাইয়াডারে মরা পাইছে।’

শেরপুর সদর থেকে ১২-১৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কামারিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রাম এটি। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের মধ্য দিয়ে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার একেবারে উত্তর ঘেঁষে ফারজানাদের বাড়ি। রাস্তার দক্ষিণ পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। ক্ষেত থেকে রাস্তা বেশ উঁচু। স্থানীয়রা জানান, বৃষ্টির দিনে পানি রাস্তা ছুঁই ছুঁই করে। তখন বয়স্ক মানুষও সাঁতার না জানলে এখানে ডুবে যাবে।

রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের তালেবুল ইসলামের বাড়ির উঠানে কথা হয় ফারজানার সঙ্গে। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ফারজানা বলেন, ‘আমি এক জায়গায় কাজে গেছিলাম, বাচ্চাটারে ভাসুরের মাইয়্যার কাছে রাইখ্যা। হেয় পরে খেলতে গেছিল। আমার মাইয়্যাডা আটতে আটতে (হাঁটতে হাঁটতে) আইস্যা পানিতে পইরা গেছে। আমি সতর্ক থাকলে এইডা হইতো না।’

পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুতে দেশে প্রতিদিন এভাবে ফারজানার মতো বহু মায়ের বুক খালি হচ্ছে। ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআরবি পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৪০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ৩০ জনই পাঁচ বছরের কম বয়সী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর পৃথিবীতে তিন লাখ ৫৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর ৯০ শতাংশই মারা যায় নিম্ন ও মধ্যমআয়ের দেশগুলোতে।

বাংলাদেশে এক থেকে চার বছরের শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশই মারা যায় পানিতে ডুবে। ডব্লিউএইচও’র গ্লোবাল রিপোর্ট অন ড্রাউনিংয়ে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে ২০০৫ থেকে বাংলাদেশে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি)। দিনের ঝুঁকিপূর্ণ চার ঘণ্টা একটি নির্দিষ্ট স্থানে শিশুদের রাখা ও একইসঙ্গে শিক্ষামূলক নানা কাজে অন্তর্ভুক্ত করার কর্মসূচি ‘আঁচল’ রয়েছে সিআইপিআরবির। সিআইপিআরবির ‘ক্রেচে ফর চাইল্ড হেলথ অ্যান্ড সেফটি’ ও ‘ভাসা’ প্রকল্পের আওতায় ‘আঁচল’ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

সিআইপিআরবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআর,বির সম্মিলিত গবেষণার ফাইন্ডিংসের (প্রাপ্তি) ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে ‘আঁচল’ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। শুরু হওয়ার পর পরবর্তী কয়েক বছরে আঁচল সেন্টারের সংখ্যা তিন হাজার ২০০টিতে উন্নীত হয়।

সিআইপিআরবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আল-আমিন ভুঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুটি প্রকল্পের অধীনে এখন দেশের ছয়টি জেলায় তিন হাজার ২০০টি আঁচল সেন্টার বা কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্রে শিশুর সংখ্যা ৫৬ হাজার। পটুয়াখালী, বরগুনা, চাঁদপুর, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ ও শেরপুরে আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রে ৯ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ২০ থেকে ২৫ জন শিশু রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কেন্দ্রে একজন প্রশিক্ষিত আঁচল মা ও একজন সহকারী থাকেন। আঁচল মা ও সহকারীকে পাঁচদিনের একটি ইনক্লুসিভ ট্রেনিং দেওয়া হয়। একটি প্রকল্পের আঁচল মা তিন হাজার টাকা ও সহকারী এক হাজার টাকা এবং অন্য প্রকল্পে আঁচল মা দুই হাজার ২০০ টাকা ও সহকারী ৭৫০ টাকা পান। আঁচল মাকে কমপক্ষে দশম শ্রেণি ও সহকারীকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানতে হয়।’

আল-আমিন ভুঁইয়া আরও বলেন, ‘গ্রামের মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা যে সময়টা কাজে ব্যস্ত থাকেন, সেই সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আঁচল সেন্টারে শিশুরা অবস্থান করে। তাই শিশুর পানির কাছে যাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। সেন্টারে থাকার সময় শিশুর মানসিক বিকাশে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন আঁচল মা। মূলত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা তারা এখান থেকে পান। এজন্য শিশুর পরিবারকে কোনো টাকা দিতে হয় না।’

আঁচল সেন্টারের ঘরটির ব্যবস্থা আঁচল মাকেই করতে হয়। তবে ঘর সাজাতে প্রকল্প থেকে সহায়তা দেওয়া হয়। মূলত ৫০ থেকে ১০০টি বাড়ি ঘিরে একটি আঁচল কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আঁচল ঘিরে প্রতি মাসে হয় অভিভাবক সভা।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে ভিয়েতনামে ‘আঁচল’ মডেলটি সরকারিভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এছাড়া ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডেও এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিআইপিআরবির কর্মকর্তারা। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে ‘আঁচল’ মডেল অনুসরণে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের কার্যক্রমও পরিচালিত হবে।

শেরপুর সদর উপজেলা সিআইপিআরবি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শেরপুরের সাতটি উপজেলায় ৫৩২টি আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে সাত উপজেলায় পাঁচ বছরের কম বয়সী ১২টি শিশু পানিতে ডুবে এবং অন্যান্য কারণে মারা গেছে। আঁচলের কারণে এসব এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকটাই কমে গেছে।

রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের তালেবুল ইসলামের বাড়িতে রয়েছে একটি আঁচল কেন্দ্র। গত সেপ্টেম্বরে যখন শিশু রিতু পানিতে ডুবে মারা যায়, তখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কেন্দ্রটি বন্ধ ছিল। এ কেন্দ্রের আঁচল মায়ের নাম ইফানা আক্তার, বয়স ৩৬ বছর। তার সহকারীর নাম শাপলা খাতুন। ইফানা আক্তারের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ১১ বছর আগে স্বামী ওমর ফারুক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

ইফানা আক্তার বলেন, ‘আমি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন আঁচল মা। আমার একজন সহকারী আছে। এখানে ২২টি শিশু রয়েছে। দুজন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৯ থেকে ৫৯ মাসের শিশুদের নিরাপদ রাখার চেষ্টা করি। এছাড়া শিশুদের আমরা ছড়াগানসহ প্রারম্ভিক বিকাশ ঘটাতে নানা কর্মকাণ্ড করি। যদি কোনো বাচ্চা না আসে, তবে আমার সহকারী বা আমি গিয়ে আনার চেষ্টা করি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে এই সেন্টারটি চলছে। এর মধ্যে আশপাশে একটি ছাড়া আর কোনো শিশু মারা যায়নি। যে শিশুটি মারা গেছে, করোনার কারণে তখন আঁচল সেন্টার বন্ধ ছিল। আঁচল হওয়ার আগে বছরে দু-চারটি শিশু মারা যেতো।’

‘স্বামী নেই, তার ওপর আমার উপার্জনের কোনো পথ ছিল না। খুবই কষ্টে জীবন চালাচ্ছিলাম। আঁচল মা হওয়ার পর আমার সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আমি আমার উপার্জনের টাকা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করাই। আঁচলে বাচ্চাদের আমরা দেখে রাখি, সঙ্গে কিছু শেখাতেও পারছি। তাই অভিভাবকরা আমাদের অনেক সম্মান করেন।’

পাশের বাড়ির গৃহিণী রাবেয়া বলেন, ‘আমরা তিনডা বাচ্চা। ছোট দুইডারে আঁচলে রাইখ্যা নিশ্চিন্তে কাজ করি। ওহানে গিয়ে ল্যাহাপড়াও শিখে। আমাগোর অনেক উপকার হয়।’

আরেক গৃহিণী ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘আমার বাচ্চার নাম মানসুরা আক্তার। তারা বলছে, বাচ্চার নিরাপত্তা থাকবো, আগুন-পানিত যাইবো না। হাত-পা কাটবো না। অনেক সুবিধার কথা বলছে। পরে ভর্তি করে দিছি, ওরা সকালে যাইয়া নিয়ে আসতো, আবার একটা বাজে ছুটি হইতো। বাচ্চা ওইহানে দিয়া আমি বাড়িত কাজ-কাম করতাম। চিন্তা আছিল না। করোনায় এহন তো বন্ধ।’

পাশের বাড়ির আরেক গৃহিণী শাবনূর বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী কৃষিকাজ করে আমি গৃহস্থালির কাজ করি। আমার পাঁচ বছরের একটা মাইয়া আছে। আমি তারে আঁচলে রাইখ্যা কাম-কাজ করি। ওহানে রাখলে কোনো চিন্তা লাগে না।’

শিশুদের উপযোগী করে সাজানো আঁচল কেন্দ্র

একটি আঁচল কেন্দ্রে প্রাণবন্ত সময় কাটছে শিশুদের

এই গ্রামের কৃষক হাসমত আলী বলেন, ‘আঁচল পোলাপান দেখাশোনা করে। ওখানে আদরেই থাহে, নিরাপত্তা আছে, পানিপুনিতে যাইতে পারে না পোলাপান। আবার লেহাপড়াও শিখে, বাড়িতে থাকলে তো কিছু অয় না।’

শেরপুর সদরের কামারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের (রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রাম) সদস্য (মেম্বার) মো. আব্দুল করিম মিয়া জগো নিউজকে বলেন, ‘আঁচল থাকায় আশপাশে মানুষের অনেক উপকার হচ্ছে। মায়েরা যখন কাজ করে তখন ওখানে বাচ্চাদের রাখা হয়। এতে বাচ্চারা নিরাপদে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘বর্ষার সময় সব জায়গায় পানি থাকে। এই সেন্টারটি হওয়ার পর বাচ্চাদের পানিতে পড়ার ঝুঁকি কমে গেছে। বাবা সেখানে তার বাচ্চাটা রেখে নিশ্চিতে কাজ করতে পারেন। দেখা গেলো মা রান্না করছেন, বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে পুকুরে বা ডোবায় পড়ে গেলো। এখন সেই ঘটনা ঘটছে না।’

রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের হাজীপাড়ার ইজ্জত সরদারের বাড়ির সামনে রয়েছে আরেকটি আঁচল কেন্দ্র। দুপুর ১২টার দিকে সেখানে যাওয়ার পথে কিছুটা দূর থেকেই কানে ভেসে আসে শিশুদের কোলাহল। এই সেন্টারের আঁচল মা নিপা বেগম।

শিশুদের নিয়ে আড্ডায় একজন আঁচল মা

শিশুদের উপযোগী করে সাজানো আঁচল কেন্দ্র

ঘরটি লম্বা, চারপাশে টিনের বেড়া, চালাও টিনের। মাটির মেঝেতে পাটি বিছানো। সুন্দর করে সাজানো ঘর। ঝুলছে রঙিন কাগজের ফুল। দেওয়ালে ব্যঞ্জন ও স্বরবর্ণের সরণি, সংখ্যা এবং মাছ, পাখি, প্রাণী, ফলের ছবিসহ নাম লেখা চার্ট, বাচ্চাদের আঁকা ছবি। এসবের ফাঁকে দেওয়ালেও শোভা পাচ্ছে কাগজের ফুল।

এক, দুই, তিন-ঘুম। এক, দুই, তিন-স্যরি। এক, দুই, তিন-বউ। এক, দুই তিন-জামাই। সংখ্যার সঙ্গে ‘আঁচল’ মা নিপা একটি শব্দ বলে তা অভিনয় করে দেখান। আলফি, নাজিয়া, কাওসার, মিনহাজ, তন্ময়, জুনাইদসহ অন্য শিশুরাও তার সঙ্গে কোরাস করে বলে, অভিনয় করে।

আবার শিশুরা নিপার সঙ্গে অভিনয় করে ছড়া বলে- ‘সিংহ মামা, সিংহ মামা/করছো তুমি কী?/এই দেখো না কেমন তোমার/ছবি এঁকেছি।’ ‘লালশাক, কচুশাক/ফুলকপি খাই/লাউ খেয়ে, শিম খেয়ে/বড় মজা পাই।’ কোনো কোনো শিশু এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে।

কাওসার ও জুনাইদের বাবা বাজারে তরকারি বিক্রি করেন। মা গরু-ছাগল লালনপালন ছাড়াও মানুষের বাড়িতে কাজ করেন। ইতোমধ্যে জুনাইদ ঘুমিয়ে পড়েছে। দুপুর ১টার দিকে আঁচল মায়ের সহকারী সোনেকা বেগম ঘুমন্ত জুনাইদকে কোলে করে খানিক দূরে তাদের বাড়ির দিকে রওনা করেন।

ঘরের কাজকর্মের ব্যস্ততায় অনেক মা তার শিশুকে আঁচল কেন্দ্রে রেখে আসেন

শিশুদের নিয়ে আড্ডায় একজন আঁচল মা

নিপা বেগম বলেন, ‘আমরা এই সেন্টারে শিশুদের নিরাপদে রাখি, আঘাতের ঝুঁকিমুক্ত পরিবেশে রেখে তাদের প্রারম্ভিক বিকাশ ঘটাই। শিশুদের ভাষা, বুদ্ধি, মানসিক, সামাজিক বিকাশ ঘটাতে নানা কার্যক্রম করি।’

তিনি বলেন, ‘সকালে বাচ্চারা এলে আমরা জাতীয় সংগীত গাই, শরীর চর্চা করি, বিভিন্ন খেলাধুলা করি, ছড়াগান করি, গল্পের বই পড়াই। আমি গল্প পড়ি বাচ্চারা তা শোনে। চার্ট আছে সেগুলো আমরা পড়াই। বাচ্চা টিফিন নিয়ে আসে, এখানে বসে খায়। কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়ে।’

‘বাইরে গেলে অভিভাবকরা আমাকে অনেক সম্মান করেন। বাচ্চারা খালামণি বলে জড়িয়ে ধরে। তাই আমার খুব ভালো লাগে’ —বলেন আঁচল মা নিপা।

তিনি আরও বলেন, ‘আঁচলের বাচ্চা স্কুলে ভর্তি করলে মায়েদের স্কুলে গিয়ে বসে থাকা লাগে না। সে নিজ থেকেই তৈরি হয়ে যায়।’

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে অনন্য ভূমিকায় ‘আঁচল’

ঘরের কাজকর্মের ব্যস্ততায় অনেক মা তার শিশুকে আঁচল কেন্দ্রে রেখে আসেন

গৃহিণী জোলেখা বেগম বলেন, ‘বাচ্চাটা আঁচলে রাইহ্যা আমরার ম্যালা সুবিধা। আমি বাড়ির সংসারের কাজ করার পারি, গরু-বাছুর পালি, ওডির কাজ করার পারি। বাচ্চাটা এহানে রাখলে আমরা কোনো টেনশন অয় না।’

শেরপুর সদর উপজেলা সিআইপিআরবি কার্যালয়ের সমন্বয়ক মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেখানে আঁচল সেন্টার রয়েছে, সেখানে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে। একই সঙ্গে মা-বাবাও অনেক সচেতন হয়ে গেছেন। আঁচলে যে শিশুরা আছে, তারা যখন স্কুলে ভর্তি হয়, তখন প্রাইমারির শিক্ষকরা জিজ্ঞাসা করেন, আগে এই শিশু কোথায় পড়েছে। বাবা-মা বলেন, কোনো স্কুলে যায়নি, আঁচলে গেছে। আমাদের সেন্টারে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা দেওয়া হয়। তাই তাদের ভীতিটা আর থাকে না। প্রাথমিকে ভর্তি হওয়া অন্য যে কোনো শিশুর চেয়ে আঁচলের শিশু বেশি অ্যাডভান্স। অনেক কিছুই তারা আগে শিখে ফেলে।’

‘আঁচল’র বিষয়ে সিআইপিআরবির উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. আমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাচ্চারা যদি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সপ্তাহে ছয়দিন আঁচল সেন্টারে থাকে, তাহলে তাদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রায় ৮০ শতাংশের মতো কমে যায়। এটা গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য। এছাড়া যে শিশুরা সেন্টারে আসে, তাদের যেসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা হয়, এটা হচ্ছে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট ইস্টিমুলেশন্স (শৈশব বিকাশের উদ্দীপনা)। ফলে এ শিশুদের বিকাশ ভালো হয়। দেখা গেছে, তারা স্কুলে বেটার পারফরমার হয়, স্কুলের পড়াশোনায় তারা ভালো হয় অন্যদের তুলনায়।’

তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞান বলে, নৈতিকতা কিংবা কাজের উদ্যম, প্রথম পাঁচ বছরের জীবনে এসব ডেভেলপমেন্ট ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়। এসময় শিশুকে যত উদ্দীপনা দেবেন, সে তত ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। সেই চেষ্টাটা আমাদের আঁচলে করা হয়।’

jagonews

আঁচল কেন্দ্রে আছে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের নানা ব্যবস্থা

‘আঁচল মা ও তার সহকারীরও বেনিফিট রয়েছে। তারা ছিলেন মূলত গৃহিণী, ওনারা কোনো অর্থ উপার্জন করতেন না। সেজন্য পরিবারে তার মূল্যটা তেমন ছিল না। যখন তিনি আঁচল মায়ের ভূমিকা পালন করছেন, তখন সমাজ ও তার বাড়ি তাকে শিক্ষকের একটা মর্যাদা দেয়। সে যে সামান্য পারিশ্রমিক পায়, সেটাও তার সামাজিক অবস্থানকে আরও উন্নত করে।’

আমিনুর রহমান বলেন, ‘যে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুকে আঁচলে পাঠাচ্ছেন, তারা এ চার ঘণ্টা স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের কাজটা করতে পারছেন। সেটা একটা পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতিতে কাজ করছে। এর মাধ্যমে পুরো সমাজই কিন্তু উপকৃত হচ্ছে।’

সিআইপিআরবির উপ-নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘তবে এটা আমরা এখনো সারাদেশের জন্য করতে পারিনি। কারণ পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টিকে এখনো সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে যেভাবে দেখা হয়। এটার জন্য জাতীয় একটি কর্মকৌশল বা নীতিমালা চূড়ান্ত করা যায়নি। তাই এ বিষয়টি এখনো মূলধারায় ঢুকতে পারেনি। প্রতিরোধের বিষয়টি মূলধারায় না নিয়ে এলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু কমানো যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ডোনারের সংখ্যাও খুবই কম। এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। তবে স্থানীয় পর্যায়ে মানুষ এটি খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। কমিউনিটির যথেষ্ট আগ্রহ হয়েছে। কিন্তু তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা সেবাটা দিতে পারছি না।’

‘আঁচল’ অনুসরণে সরকারি প্রকল্প
ডুবে শিশুর মৃত্যু রোধ ও শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে ‘আঁচল’ অনুসরণে একটি প্রকল্প নিয়েছে সরকার। গত ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) ‘ইন্টিগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন অ্যান্ড সুইম-সেইফ ফ্যাসিলিটিজ’ নামে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। তিন বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। বেসরকারি সংস্থা ও সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শিশু একাডেমির মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।

এ প্রকল্পের আওতায় দেশের ১৬ জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার শিশু যত্নকেন্দ্র করা হবে। গবেষণা মোতাবেক পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিপূর্ণ সময় অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত শিশুরা এসব কেন্দ্রে থাকবে। কেন্দ্রে পাঁচ ঘণ্টা থাকার সময় শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের সহায়ক নানা শিক্ষা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এ ৪৫ উপজেলায় এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী দুই লাখ শিশু কার্যক্রমটির আওতায় আসবে।

একইসঙ্গে এ ৪৫ উপজেলায় ছয় থেকে ১০ বছর বয়সী তিন লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানো হবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতাভুক্ত অঞ্চলের দুই লাখ মা-বাবাকে সচেতন করা হবে, যেন তারা শিশুযত্ন, সুরক্ষা এবং বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারেন।

আরএমএম/এএএইচ/এইচএ/এমকেআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।