অনলাইনে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ কোটি টাকার প্রতারণা

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৫৬ এএম, ০৪ মে ২০২২
এভাবেই অনলাইনে কাজ করতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন তরুণরা-সংগৃহীত ছবি

ভারতীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের বিষয়ে তথ্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জেপিজি ফরমেট আকারে পাঠান। রোগীদের সে তথ্যগুলো সফটওয়্যারে এন্ট্রি করতে হবে। এই তথ্য পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর বিনিময়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত বিল প্রদান করে। এমন বিজ্ঞাপন দেখে যারা আগ্রহী হন; ডাটা এন্ট্রি করে অর্থ উপার্জন করবেন তাদের প্রথমে ১০ হাজার টাকা দিয়ে আইডি কিনে নিতে হয়।

প্রতিটি আইডিতে প্রতি মাসে ৩০০ জেপিজি ফরমেটের ডাটা সফটওয়্যারের লিংকে এন্ট্রি করতে হবে যার পারিশ্রমিক হিসাবে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়া হবে। এতে শর্ত দেওয়া হয়, পরবর্তীতে কাজ করতে না চাইলে আইডি বন্ধ করে বিনিয়োগকৃত ১০ হাজার টাকার মধ্যে ৮ হাজার টাকা ফেরত পাবে এবং বাকি ২ হাজার টাকা ক্লাইন্ট ও ব্যবস্থাপনা চার্জ হিসাবে কেটে রাখা হবে যা সম্পূর্ণই একটি লিখিত চুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ফাস্ট সিকিউরিটি ইনটিগ্রেটেড সলিউশন লিঃ নামের প্রতিষ্ঠান ওয়েব সাইট খুলে অনলাইনে এমনই চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়। এতে প্রলুব্ধ হয়ে অনেকেই খুলেন আইডি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মো. মাহামুদুল হাসান নামের এক ব্যক্তি প্রতিটি আইডির বিপরীতে ২ হাজার ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক পাবে এই শর্তে ১০ হাজার টাকা করে মোট ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ২৬টি আইডি কিনেন।

নিয়ম অনুযায়ী চলায় প্রায় এক বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রতি আইডিতে ৩ হাজার টাকা করে পারিশ্রমিকের আরও একটি অফার দিলে মাহামুদুল মিরপুর শাহআলী প্লাজায় প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে চুক্তিপত্র সম্পাদন করে স্ত্রী সুরাইয়া খাতুন এর নামেও ২৫০টি আইডি খুলেন। এতে প্রতি আইডিতে ১০ হাজার টাকা করে মোট ২৫ লাখ টাকা দেন ফাস্ট সিকিউরিটি ইনটিগ্রেটেড সলিউশন লিঃ কে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানের হঠাৎ একদিন মাহামুদুল দেখতে পান ওয়েব সাইটের সার্ভার কাজ করছে না। এতে প্রতিষ্ঠানটির সাথে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাদের কাউকে আর পাওয়া যায়নি, ফোন বন্ধ পান তিনি। প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে জানতে পারেন ওয়েব সাইটি বন্ধ করে আত্মগোপন করেছেন তার মালিকরা।

কেবল মাহামুদুল হাসানই নন, আরও হাজারো মানুষ প্রতিষ্ঠানটির প্রতারণার শিকার হয়েছেন ।

নিজেদের সফটওয়্যারে মোট ১৫ হাজার ৮৬টি আইডি করিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিটি আইডি খুলতে মানুষের কাছে নিয়েছে ১০ হাজার টাকা। এভাবেই প্রতারণার মাধ্যমে ১৫ কোটি ৮ লাখের বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা।

প্রতারণার শিকার মো. মাহামুদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, এই বিশাল অংকের টাকার প্রতারণার শিকার হয়ে অর্থনৈতিক বিশাল ক্ষতিতে পড়েছি। প্রথমে কাজের বিনিময়ে টাকা দিত। এতে বিশ্বাস তৈরি হয় যে এখানে টাকা বিনিয়োগ করলে সমস্যা হবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখি ওয়েবসাইট নাই। অফিসে গিয়েও তাদের পাওয়া যায় না।

অপর এক ভুক্তভোগী মো. আজিকুর রহমান লিমন জানান, আমার বন্ধু প্রথমে আইডি কিনে তারপর আমাকে নিয়ে যায়। প্রথমে আমাদের বলে টাকা বিনিয়োগ করলেই টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু পরে দেখলাম আমাদের কাজ দেয় সেটা শেষ করলে তারা আমাকে টাকা দেয়। আমি ১৫ লাখ টাকা দিয়েছি তবে কাগজে প্রমাণ আছে ৮ লাখ টাকা। প্রথমে ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। তারা ৬ মাস এভাবে কাজের বিনিময়ে টাকা পাওয়ায় একটা বিশ্বাস হয়ে যায় তারপর আমি ব্যাংক লোন নিয়ে তাদেরকে টাকা দেই। ব্যাংক লোনটা এখনও আমাকে টানতে হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির এমন প্রতারণায় তিন কর্ণধারের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে ভুক্তভোগী মো. মাহামুদুল হাসান। অভিযুক্ত দুই জনকে এরইমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি একজন রয়েছেন পলাতক। অথচ তদন্তে কোনো হাসপাতালের তথ্যই পায়নি পুলিশ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, মামলায় যে অভিযোগ করা হয়েছে আমরা বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে সেটা তদন্ত করেছি। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। সেই অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছি।

অনলাইনে দিন দিন বাড়ছে কাজ। কাজের পরিধির সঙ্গে বেড়েছে অপরাধও। আর এসব অপরাধের মধ্যে অধিকাংশই প্রতারণার এবং সেটি আবার বেশির ভাগই অর্থ সংক্রান্ত প্রতারণার। ফলে অনলাইনে কোনো কাজের ক্ষেত্রে যাচাই করা জরুরি। যাতে করে প্রতারণার শিকার হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়।

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ কোটি টাকার প্রতারণা

প্রতারকদের কারণে ঋণের বোঝাও বাড়ছে ফ্রিল্যান্সারদের-প্রতীকী ছবি

অনলাইনে এমন প্রতারণার বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের ডিবি প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, অনলাইনে প্রতারণার ফলে কোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে আমরা সেটা নিয়ে কাজ করি। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বা সংস্থা যদি কোনো প্রতারণা করে তবে আমরা নিজেরাই বাদী হয়ে কাজ করি। অনলাইনের ক্ষেত্রটা বেশ বড়। বর্তমানে অপরাধের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা বলা যায় মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রতারণা। আর এক্ষেত্রে অর্থ সংক্রান্ত প্রতারণাটাই বেশি। মানুষের সামাজিক মর্যাদা হেয় করে, গুজব ছড়িয়েও অনলাইনে প্রতারণা করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ডাটা এন্ট্রির মাধ্যমে টাকা কামানোর বিষয়টি তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক হারে চলে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তারা। এটি তরুণদের জন্য বেশ জনপ্রিয় মাধ্যম। চাকরি করে যে বেতনটা পায় তার চেয়ে বেশি টাকা তারা ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে আয় করতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন অনলাইনে কাজ এনে একাজগুলো অন্যজনকে দেয় এবং এর মাধ্যমে প্রতারণা করে তখন সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে। আমরা এক্ষেত্রে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

অনলাইনে প্রতারণার মূল কারণটি হলো কোনো যাচাই-বাছাই না করে কোনো সুযোগকে সহজে বিশ্বাস করে লাভের আশায় সুযোগটিকে গ্রহণ করা। অনেক ক্ষেত্রে অর্থ আয়ের বাসনা থেকে যাচাই ছাড়াই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। একটা সময় দেখা যায় প্রতারণার শিকার হয়ে বিনিয়োগের সকল অর্থই হাতছাড়া হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সুযোগ দেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে অর্থ বিনিয়োগের কথা বলছেন বিশ্লেষকরা।

অনলাইনে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ১৫ কোটি টাকার প্রতারণা

অনেকসময় ভাবনার সঙ্গে মেলে না কিছুই-প্রতীকী ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন খন্দকার ফারজানা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এখন সবকিছুই অনলাইনে হচ্ছে। কাজের পরিধি বেড়েছে যেহেতু এক্ষেত্রে অনলাইনে অপরাধও স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। তাই কোনো ধরনের লেনদেন বা অর্থনৈতিক লেনদেন করার আগে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া।

তিনি আরও বলেন, সচেতনতার একটি বিরাট ঘাটতি রয়েছে আমাদের। অনলাইনে কেউ আমাকে একটা কাজ দিচ্ছে বা আমাকে একটু সুযোগ দিচ্ছে সেটা কতটুকু যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে কি-না তা নিয়ে আগে ভাবতে হবে। সুযোগ পেলেই সেটি গ্রহণ করলে সেটাতে ক্ষতির সম্ভাবনাও থেকে যায়। তাই যাচাইয়ের কোনো বিকল্প নেই।

আরএসএম/এসএইচএস/জেআইএম

এই বিশাল অংকের টাকার প্রতারণার শিকার হয়ে অর্থনৈতিক বিরাট ক্ষতিতে পড়েছি। প্রথমে কাজের বিনিময়ে টাকা দিত। এতে বিশ্বাস তৈরি হয় যে এখানে টাকা বিনিয়োগ করলে সমস্যা হবে না। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখি ওয়েব সাইট নাই। তাদের অফিসে গিয়েও পাওয়া যায় না।

তরুণরা চাকরি করে যে বেতনটা পায় তার চেয়ে বেশি টাকা তারা ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে আয় করতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন অনলাইনে কাজ এনে একাজগুলো অন্যজনকে দেয় এবং এর মাধ্যমে প্রতারণা করে তখন সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে। আমরা এক্ষেত্রে অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করি।

সচেতনতার একটি বিরাট ঘাটতি রয়েছে আমাদের। অনলাইনে কেউ আমাকে একটা কাজ দিচ্ছে বা আমাকে একটু সুযোগ দিচ্ছে সেটা কতটুকু যাচাই করে নিশ্চিত হয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে কি-না তা নিয়ে আগে ভাবতে হবে। সুযোগ পেলেই সেটি গ্রহণ করলে সেটাতে ক্ষতির সম্ভাবনাও থেকে যায়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।