বিশ্বকাপ আমাদের পেসারদের পরীক্ষার বড় মঞ্চ: সারোয়ার ইমরান

আরিফুর রহমান বাবু
আরিফুর রহমান বাবু আরিফুর রহমান বাবু , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৮:৪১ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৩

বিশ্বকাপ শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশের। আফগানিস্তানকে হারিয়ে দারুণ সূচনা করেছে টাইগাররা। তবে, এটা মাত্র শুরু। আরও আটটি ম্যাচ বাকি। অন্য ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশকে কাঙ্খিত সাফল্য পেতে হলে পেসারদের ভূমিকা রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু আফগানিস্তানের বিপক্ষে শুরুতেই পেসাররা ভালো করতে না পারায় কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে বৈ কি।

বাংলাদেশের পেসারদের জন্য যে এই বিশ্বকাপ বড় একটা পরীক্ষাগার, তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন কোচ সারোয়ার ইমরান। জাগো নিউজের সঙ্গে কোচ সারোয়ার ইমরানের সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।

জাগো নিউজ: আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশ খুব ভাল মত তৈরি হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গেছে?

সারোয়ার ইমরান: আপনি যদি প্র্যাকটিস সেশন আর ম্যাচ খেলার সংখ্যাকে নিয়ামক ধরে বিচার করেন, তাহলে মনে হবে প্রস্তুতি বেশ ভাল হয়েছে। তৈরি হয়েই বিশ্বকাপ খেলতে গেছে টিম বাংলাদেশ; কিন্তু আমার তা মনে হয় না। সত্যিকার প্রস্তুতি খুব ভাল হয়নি। বরং বেশ কিছু জায়গায় ফাঁক-ফোকর থেকে গেছে।

জাগো নিউজ: সেটা কেমন?

সারোয়ার ইমরান: বেশি কিছু বলার দরকার নেই। আমরা বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার আগেও ওপেনিং জুটিটা তৈরি করতে পারিনি। কখনো মিরাজকে মেকশিফট ওপেনার হিসেবে খেলিয়েছি। আবার ভেতরে ভেতরে সৌম্যকেও খেলানোর চিন্তা করেছি। যা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা দীর্ঘ দিন ধরে একটা সেটেল্ড ওপেনিং পেয়ার তৈরি করতে পারিনি। বিশ্বকাপের মত আসরে কোন দলের ওপেনিং জুটি কারা? সবার জানা; কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে কে বা কারা ব্যাট হাতে ওপেন করবেন, সেটা এখনো চূড়ান্ত নয়, বিশ্বকাপে মিরাজকে আবার মেকশিফট ওপেনার হিসেবে খেলতে দেখা গেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এটা হতে পারে; কিন্তু ওয়ানডেতে হয় না। এটা টিম ম্যানেজমেন্টের অনেক বড় ব্যর্থতা আর অনেক অদূরদর্শিতা যে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগেও আমাদের কোন ফিক্সড ওপেনিং জুটি নেই।

জাগো নিউজ: এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কতটা? সাকিবের দল কতদূর যেতে পারে?

সারোয়ার ইমরান: এটা প্রেডিক্ট করা খুব কঠিন। যেহেতু গত বছর ম্যাচ জেতায় আমরা টপ থ্রি’তে ছিলাম, তাই কারো কারো ধারণা, আশা যে বাংলাদেশ সেরা চারে থাকবে মানে সেমিফাইনাল খেলবে।

যদিও আমরা ১০ দলের মধ্যে রেটিংয়ে ৭ নম্বর ছিলাম, তারপরও ম্যাচ জেতার হিসেবে আমরা শেষ এক বছরে শীর্ষ তিনে ছিলাম দেখে কারো কারো মনে হয় বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলবে। তবে সেই হিসেব নিয়ে বিশ্বকাপে টিম বাংলাদেশের সম্ভাবনা বিচার করা ঠিক হবে না।

জাগো নিউজ: সেটা কেন?

সারোয়ার ইমরান: ভুলে গেলে চলবে না যে সময়ের হিসেব নিকেশ এর আলোকে অমন ভাবা হচ্ছে ওই সময়ে বাংলাদেশ বেশির ভাগ ম্যাচ খেলেছে দেশের মাটিতে শেরে বাংলায়। যে পিচের সাথে ভারতের বিশ্বকাপ ভেন্যুগুলোর উইকেটের চরিত্র ও আচরণগত পার্থক্য অনেক।

মিরপুরের উইকেটে বোলারদের বিশেষ করে স্পিনারদের অনেক হেল্প থাকে। আর বিশ্বকাপের উইকেটগুলো হবে মূলত ব্যাটিং সহায়ক। ব্যাটিং বান্ধব। সেখানে স্পিনারদের বল নিচুও হবে না। একটু আধটু টার্নও করবে না। কাজেই উইকেটের ফায়দা নিয়ে জেতা কঠিন। বিশ্বকাপের মাঠে জিততে হবে সামর্থ্যের সেরাটা উপহার দিয়ে। মাঠের লড়াইয়ে সেরা চারে থাকতে অবশ্যই সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে এবং সেরা ক্রিকেটটাই খেলতে হবে।

জাগে নিউজ: সেরা ক্রিকেট বলতে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন? আপনার মনে হয় কি করতে পারলে বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলতে পারবে?

সারোয়ার ইমরান: সেমিফাইনালে খেলার পথে প্রথম করণীয় বলতে সেই সনাতন ফর্মুলা, ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং-ক্যাচিংয়ে সামর্থ্যের সর্বোত্তম প্রয়োগ ঘটাতে হবে। আর প্রথম করণীয় হবে ব্যাটিং ভাল করা।

জাগো নিউজ: ব্যাটিংয়ে আপনি কোন জায়গায় ভাল করার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দিতে চান?

সারোয়ার ইমরান: অবশ্যই টপ অর্ডার ব্যাটিং। বিশেষ করে ওপেনিং। আমাদের ওপেনিং জুটি বেশ নড়বড়ে। সেটা ভাল করতে হবে। শুরু ভাল হওয়া খুব জরুরি। আপনি বিশ্বকাপের মত বড় আসরে যদি শুরু ভাল করতে না পারেন, একদম প্রথমেই দুই তিন উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যান, তখন আর ফেরা কঠিন।

বিশেষ করে শক্তি ও সামর্থে যে দলগুলো বেশ সমৃদ্ধ, সেই দলগুলো আপনাকে একবার বেকায়দায় ফেলে দিলে সেখান থেকে ঘুরে ও উঠে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। তাই ওপেনিং ভাল করতেই হবে। প্রথম তিনজনের অন্তত দু’জনকে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে। রান করতে হবে। না হয় মিডল ও লেট অর্ডারের ওপর অনেক বেশি চাপ পড়বে। সেই চাপ সামলে দেখা যাবে দু’শোর আশপাশে ইনিংস থেমে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ডকাপে ২০০ রান দিয়ে ম্যাচ জেতা সম্ভব না।

জাগো নিউজ: আপনি টপ অর্ডারের ভাল খেলা অতি জরুরি বলছেন; কিন্তু সেখানে তো সবচেয়ে সিনিয়র ও এক্সপেরিয়েন্স ও কার্যকর পারফরমার তামিম ইকবাল নেই। তামিমকে ছাড়া টপ অর্ডার কতটা কি করতে পারবে? আপনি তামিমকে কতটা মিস করবেন?

সারোয়ার ইমরান: অবশ্যই। তামিমকে তো মিস করবোই। এত দীর্ঘ সময় অনেকগুলো বছর সে সার্ভিস দিয়েছে। দলের সাফল্যে অবদান রেখেছে। তার অনেক ভাল ইনিংস আছে। টিম বাংলাদেশের জন্য তামিমের সার্ভিসও মনে রাখার মত। টপ অর্ডারে আর কেউ অমন সার্ভিস দিতে পারেনি।

জাগো নিউজ: কিন্তু তামিমতো শেষ দিকে স্লো হয়ে গিয়েছিলেন। তার কার্যকরিতাও কি আগের মত আছে?

সারোয়ার ইমরান: তামিম কিছুটা স্লো খেললেও উইকেটে টিকে থাকতে পারতো। সেটাও অপর ব্যাটারদের জন্য হতো সাহস ও আত্মবিশ্বাসের বড়ি। তামিমকে বলা হচ্ছে- স্লো হয়ে গেছে। কিন্তু আস্থার জায়গাটা ঠিকই ছিল। যে কারণে তামিম ছিল ডিপেন্ডেবল। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তামিমকে সব প্রতিপক্ষ বোলাররাই সমীহ করেছে। কাজেই তামিমের অভাবতো অনুভুত হবেই। এখন তামিম ছাড়া টপ অর্ডারের জন্য কাজটা আরও কঠিন হবে বৈকি।

জাগো নিউজ: তরুণ তানজিদ তামিমতো প্র্যাকটিস ম্যাচে শ্রীলঙ্কা আর ইংল্যান্ডের সাথে ভাল খেলেছেন। রানও করেছেন তাকে নিয়ে কিছু বলবেন কি?

সারোয়ার ইমরান: আমি তাকে অল্প সময় দেখেছি। মোটামুটি ভালই খেললো দুটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচ। তবে আমি এখনই তরুণ তানজিদ তামিমকে নিয়ে কোন চরম মন্তব্য করতে রাজি না। সবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছে এ তরুণ। দুটি প্র্যাকটিস ম্যাচ ছাড়া এশিয়া কাপ আর নিউজিল্যান্ডের সাথে সিরিজে রান করতে পারেনি। কাজেই দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ দেখেই তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস ও উচ্ছাশা পোষণ করার পক্ষে নই আমি। এখনই বলার মত কিছু হয়নি। দেখা যাক। সামনের দিনগুলোয় কেমন খেলে তাকে সময় দেয়া উচিৎ।

জাগো নিউজ: দলের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

সারোয়ার ইমরান: আমরাতো আর অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড হয়ে যাইনি। আর আমাদের অমন একঝাঁক বিশ্ব তারকাও নেই। টিম স্পিরিট আর টিম পারফরমেন্সই হতে পারে আমাদের প্রধান শক্তি । মাঠে আমাদের দল হয়েই খেলতে হবে। টিম পারফরমেন্সটা খুব জরুরি। ব্যাটিংয়ে পার্টনারশিপ করতে হবে। আজকাল পার্টনারশিপ হচ্ছে না। গত ছয় মাসে আমাদের ব্যাটারদের মধ্যে বড় জুটি হয়েছে খুব কম। সেটা দরকার। স্কোরলাইন বড় করতে আর বিগ স্বোর তাড়া করতে দীর্ঘ জুটির বিকল্প নেই। এছাড়া ব্যাটিংয়ে শুরু ভাল হওয়াও খুব জরুরি।

জাগো নিউজ: আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওপেনিং ভাল হলেই ব্যাটিং ভাল হবে। বাংলাদেশের মিডল ও লেট অর্ডার কি তত ভাল?

সারোয়ার ইমরান: ওপেনিং ভাল হলে আমরা ভাল খেলতে পারবো, স্কোর মোটা তাজা হবে। কারণ আমাদের মিডল অর্ডারে তিনজন ভাল ও দক্ষ প্লেয়ার আছে। যাদের ওপর আস্থা রাখা যায়। সাকিব, হৃদয় আর মুশফিক ক্যাপাবল। ওপেনিং বা ওপরে শান্ত আর লিটন দাস শুরুটা ভাল করে দিলে সাকিব, মুশফিক আর হৃদয় সামনে এগিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। ওপরে লিটন-শান্তরা একটা মজবুত ভিত গড়ে দিলে ওরা তিনজন আরও অনেকদূর এগিয়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখে। ৩০০ রানের নীচেতো চিন্তাই করা যায় না।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ দলের বোলিংটা কেমন?

সারোয়ার ইমরান: আমার মনে হয় আমাদের পেসারদের সত্যিকার পরীক্ষা হবে বিশ্বকাপে। আমাদের পেসাররা আসলে কতটা উন্নতি করেছে, কোয়ালিটি ব্যাটারদের বিপক্ষে তাদের বোলিং কতটা কার্যকর? ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে কিভাবে বোলিং করতে হবে- এবারের বিশ্বকাপেই তা জানা হবে।

এখানে বোলিং করাটা সহজ হবে না মোটেই। বোলিংয়ে কারুকাজ আর বৈচিত্র্য ছাড়া ভারতের ব্যাটিং স্বর্গে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের হাত খুলে খেলা থেকে বিরত রাখা খুব কঠিন। আমাদের পেসারদের সেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। দেখা যাক তারা কি করে?

জাগো নিউজ: স্পিনারদের নিয়ে কিছু বললেন না? বাংলাদেশের স্পিনারদের প্রশংসা করেন অনেকেই। আপনি কি বলবেন?

সারোয়ার ইমরান: যে যাই বলুন না কেন, আমারতো মনে হয় আমাদের সে অর্থে ভাল ও হাই কোয়ালিটি স্পিনারই নেই। হ্যাঁ, সাকিব ঠিক আছে। মিরাজও বুদ্ধি খাটিয়ে বল করে। জোরের ওপর করে। বুদ্ধিটা আছে। ব্যাটারের গতি প্রকৃতি দেখে বল করতে জানে। কিন্তু কেউই বড় টার্নার না। আর বাকিদের বলতো আরও টার্ন করে না। তাই আমি আমাদের স্পিনারদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করি না। আপনি ভারত ও শ্রীলঙ্কার স্পিনারদের বল দেখেন, ন্যাচারাল টার্নার। ভেরিয়েশনও আছে প্রচুর। আমাদের সাকিব ও মিরাজ ছাড়া অন্যরা বিশ্বমানে তেমন কার্যকর না।

এআরবি/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।