ফিরে দেখা ২০২৫
হকিতে বিশ্বকাপ আর আমিরুলের বাজিমাত
হকির আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের জন্য ২০২৫ ছিল অনন্য এক বছর— ইতিহাস গড়ারও বটে। দেশের তিন প্রধান খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও হকির মধ্যে বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল কেবল ক্রিকেটের। ফুটবল ও হকিতে কখনোই কোনো পর্যায়ের বিশ্বকাপে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না। বিদায়ী বছরে সেই অপূর্ণতা দূর করেছে হকি। সিনিয়র বিশ্বকাপে না হলেও জুনিয়র বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে দেশের হকি নতুন এক অধ্যায় রচনা করেছে।
গত ২৮ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর ভারতের চেন্নাই ও মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় ২৪ দেশের অংশগ্রহণে জুনিয়র হকি বিশ্বকাপ। বিশ্বের সেরা ২৪ দলের সেই লড়াইয়ে ছিল বাংলাদেশও। গৌরবের প্রথম জায়গাটা সেখানেই। বাংলাদেশ যেদিন বিশ্বকাপে খেলার টিকিট পায়, সেদিন ফল নিয়ে কারও তেমন প্রত্যাশা ছিল না। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে সবাই কেবল লড়াকু পারফরম্যান্সই আশা করেছিলেন। বাস্তবে সেই প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গেছেন আমিরুল ইসলাম ও সামিনরা।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ শেষ করেছে ২৪ দলের মধ্যে ১৭তম হয়ে। এর ফলে লাল-সবুজ জার্সিধারী যুবারা জিতে নেয় চ্যালেঞ্জার ট্রফি। সতেরোতম স্থান নির্ধারণী ম্যাচে বাংলাদেশ ইউরোপের দেশ অস্ট্রিয়াকে হারিয়েছে ৫–৪ গোলে।
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে সাতটি দেশের ওপরে থাকা—বাংলাদেশ হকির জন্য এটি বিশাল অর্জন। এই দলীয় সাফল্যের পেছনে বড় অবদান রেখেছেন ডিফেন্ডার আমিরুল ইসলাম। বিকেএসপি ও মোহামেডানের এই খেলোয়াড় ছয় ম্যাচে করেছেন পাঁচটি হ্যাটট্রিক—যা জুনিয়র বিশ্বকাপের ইতিহাসে একেবারেই অনন্য। আমিরুল গোল করেছেন ১৮টি।

শুধু এই বিশ্বকাপ নয়, একটি আসরে এত গোল করার নজিরও নেই আগে। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে এমন পারফরম্যান্সে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ফরিদপুরের এই তরুণ। দল জিতেছে চ্যালেঞ্জার ট্রফি, আর আমিরুল হয়েছেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
আমিরুলের পাঁচ হ্যাটট্রিক শুধু সংখ্যার দিক থেকেই নয়, এর গুরুত্ব আরও গভীরে। কারণ, হ্যাটট্রিকগুলো এসেছে শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ তিন ম্যাচের দুটিতে হেরেছে এবং একটি ম্যাচ ড্র করেছে। অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও দক্ষিণ কোরিয়া ছিল গ্রুপের প্রতিপক্ষ। ভালো কিছুর সম্ভাবনা খুব একটা ছিল না। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫–৩ গোলে হারলেও বাংলাদেশের লড়াকু পারফরম্যান্স চোখে পড়ার মতো ছিল। ওই ম্যাচের পরই আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ওঠে আমিরুলদের।
পরের ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে তিন গোল খেয়ে আবার সমতা ফেরায় বাংলাদেশ। আমিরুলের বীরত্বে সেই ড্র-ই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ অভিযানের টার্নিং পয়েন্ট। সেখান থেকেই খেলোয়াড়দের মধ্যে জন্ম নেয় অদম্য সাহস। শেষ ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষেও লড়াই করলেও হার এড়ানো সম্ভব হয়নি।

স্থান নির্ধারণী ম্যাচগুলোতে এসে বাংলাদেশ পৌঁছে যায় পারফরম্যান্সের চূড়ায়। গ্রুপে তৃতীয় হওয়ায় বাংলাদেশ পড়ে র্যাংকিংয়ের তৃতীয় স্তরের দলে। ফলে খেলতে হয় ১৭ থেকে ২৪তম স্থান নির্ধারণী ম্যাচে। শুরুতেই প্রতিপক্ষ হয় ওমান। আমিরুলের পাঁচ গোল ও রকিবুল হাসান রকির হ্যাটট্রিক মিলিয়ে ওমানকে ১৩–০ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ।
এই জয়ে পরের ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হয় দক্ষিণ কোরিয়া। গ্রুপ পর্বে পিছিয়ে পড়েও কোরিয়ার বিপক্ষে ড্র করেছিল বাংলাদেশ, তাই প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলেও ভীত ছিল না দলটি। গ্রুপ পর্বের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স স্থান নির্ধারণী ম্যাচেও ধরে রাখে বাংলাদেশ। এবার আর ড্র নয়—এবার বিস্ময়কর জয়।
ওমানের বিপক্ষে বড় জয়ে বাংলাদেশ উঠে যায় ১৭ থেকে ২০ নম্বর স্থান নির্ধারণী পর্বে। সেখানেও প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়া। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন বাংলাদেশ হয়তো ২০তম হয়েই বিশ্বকাপ শেষ করবে। কিন্তু সব চমক যেন তখনও বাকি ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সেই ম্যাচেও আমিরুল ইসলাম করেন হ্যাটট্রিক। ৫–৩ গোলে জয়ের পর বাংলাদেশের ১৮তম হওয়া নিশ্চিত হয়।
এরপর চোখ থাকে চ্যালেঞ্জার ট্রফির দিকে। সতেরোতম হতে পারলেই ট্রফি নিশ্চিত। প্রতিপক্ষ অস্ট্রিয়া। লড়াই হবে বলেই ধারণা ছিল। বাংলাদেশ তীব্র এক লড়াইয়ে ৫–৪ গোলে জয় পায়। শেষ ম্যাচেও জ্বলে ওঠে আমিরুলের স্টিক। করেন নিজের পঞ্চম হ্যাটট্রিক। এই জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নিশ্চিত করে চ্যালেঞ্জার ট্রফি।
ছয় ম্যাচে বাংলাদেশ করেছে মোট ৩১ গোল। এর মধ্যে প্রথম তিন ম্যাচে ৮ গোল এবং শেষ তিন ম্যাচে ২৩ গোল। বাংলাদেশের ৩১ গোলের ১৮টিই এসেছে আমিরুল ইসলামের স্টিক থেকে। বাকি ১৩ গোলের মধ্যে রকিবুল হাসান রকি করেছেন ৫টি, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ৩টি, আর দুটি করে গোল করেছেন ওবায়দুল জয় ও মোহাম্মদ সাজু।
বাংলাদেশ জুনিয়র বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিল গত বছর ওমানে অনুষ্ঠিত জুনিয়র এশিয়া কাপে পঞ্চম হয়ে। সেই আসরেও আমিরুল ইসলাম পাঁচ গোল করে বাংলাদেশকে বিশ্বকাপের টিকিট এনে দিতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
জুনিয়র ছেলেদের দলের বিশ্বকাপে চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের বছরেই অনূর্ধ্ব–১৮ নারী এশিয়া কাপেও বাংলাদেশ প্রথম অংশ নিয়েই পদক জিতে ফিরেছে। চীনে অনুষ্ঠিত ওই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জিতেছে ব্রোঞ্জ পদক। ব্রোঞ্জ নির্ধারণী ম্যাচে বাংলাদেশ ৬–২ গোলে হারায় কাজাখস্তানকে। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ ৩–০ গোলে হারায় উজবেকিস্তান ও হংকংকে। তবে শক্তিশালী চীনের কাছে হার মানতে হয় ৯–০ গোলে।
আরআই/আইএইচএস