নওগাঁয় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে কৃষি জাদুঘর
কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য দিন দিন নতুন নতুন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হচ্ছে। আর যান্ত্রিক যুগে কৃষির পুরনো সেই হাতিয়ারগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। আর সেই হাতিয়ারগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে কৃষি লাইব্রেরির পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে কৃষি জাদুঘর। সেই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো।
নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রাম গ্রামে নিজ চেষ্টায় কৃষি জাদুঘর করেছেন শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ। তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। পরিবারসহ রাজশাহীতে বসবাস করলেও প্রতি সপ্তাহে গ্রামে আসেন। কৃষি বিষয়ে নতুন কিছু উদ্ভাবন হলে কৃষকদের সে বিষয়ে ধারণা প্রদান করেন।
তিন বিঘা জমির উপর নির্মিত কৃষি জাদুঘর ও কৃষি লাইব্রেরি এবং রোপণ করা হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক বিভিন্ন ওষধি ও ১২০ প্রজাতির ফলজ গাছ। ৯টি ঘরের মধ্যে জাদুঘর, লাইব্রেরি, গোলাঘর, খাবার ঘর, হেসেল ঘর একটি করে ও অতিথিদের শোবার ঘর আছে ৪টি। কৃষি লাইব্রেরিতে কৃষি বিষয়ের উপর বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষিত বই পড়ে কৃষকরা তাদের সমস্যার সমাধান পেতে পারেন। কৃষি জাদুঘর দেখভাল এবং বাগান পরিচর্যার জন্য রয়েছে আজাহার হোসেন ও হযরত আলী নামে দুইজন কর্মী। 
কৃষি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে নাঙ্গল, জোয়াল, মই, গরুর গাড়ি, গরুর গোমাই, মাথাল, ঢেঁকি, বাঁশের তৈরি টোপা, মাছ ধরার যন্ত্র, পানি সেচের যাত, ধান রাখার মাটির তৈরি বড় বড় হাড়ি (মটকি), ধান মাড়াই মেশিন, কীটনাশক স্প্রে মেশিন, পালকি, নৌকা, কোদাল, কাস্তে, ঝাড়ু, দাউল, দিদা, শ্যালো মেশিন, গোলাঘরসহ আরো অনেক কিছু। কৃষি জাদুঘরে এ কৃষি উপকরণগুলো অনেকে স্বেচ্ছায় দান করেছেন।
জেলার পত্নীতলা থেকে কালীগ্রামে নানার বাড়িতে বেড়াতে আসা সামিয়াত মাহবুব অর্থি জানান, আমি এক সঙ্গে কখনো এগুলো দেখিনি। কৃষি জাদুঘরে প্রাচীনকালের অনেক সুন্দর যন্ত্রপাতি দেখতে পেলাম। আর লাইব্রেরিতে বইয়ের সুন্দর সুন্দর গল্প পড়তে ভাল লাগে।
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মুনিকা কালীগ্রামে স্কুলে পড়ে। এখানে প্রায়ই বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে আসে এবং লাইব্রেরিতে গল্পের বইগুলো পড়ে। কৃষি যন্ত্রপাতি দেখতে ও গল্প, ছড়ার বই পড়তে তার ভাল লাগে।
পশু চিকিৎসক মফিজ উদ্দিন জানান, কৃষকদের সুবিধার জন্য ফ্রি পশু চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। কোন গরু অসুস্থ হলে তাদের টিকা দিয়ে থাকেন। এলাকার স্বেচ্ছায় তিনি সেবা প্রদান করছেন।
ফ্রিল্যান্স অ্যানথারপোলোজিস্ট সাজ্জাদ লিওন জানান, কৃষি জাদুঘর ও কৃষি লাইব্রেরিতে ৪০ দিনের জন্য বারসিক ইনস্টিটিউট অব এ্যাপলাই স্টাডিজ হয়ে নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এসেছেন।
পরিচালক শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ জানান, ছোট থেকেই কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কৃষি বিষয়ে আমার যত অভাব আছে তা পূরণ করার চেষ্টা করছি। মানুষের মনে অনেক কিছুর পরিকল্পনা থাকে। সবাই তো বস্তবায়ন করতে পারে না। আমি স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি এটাই বড় কথা। তবে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছি।
তিনি জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে কৃষকদের নিয়মিত ফ্রি চিকিৎসাসেবা ও হার্ট, কিডনি, চোখ ক্যাম্প করা হয়। ডায়াবেটিস হাসপাতালে যেভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় এখানে ঠিক সেভাবেই চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। কৃষকদের কারো রক্তের প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। ভাল চিন্তাভাবনা, ধ্যান ধারণা করার জন্য এখনো বহু মানুষ আছেন। আমরা তাদের খুঁজে পাই না। একটু খুঁজলে বা যোগাযোগ করলে তাদের পাওয়া যাবে। আমি কোন আর্থিক সহযোগিতা চাই না, আমি আইডিয়া সহযোগিতা চাই।
কৃষিতে অবদানের জন্য ২০১১ সালে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল থেকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের হাত থেকে এক লাখ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলাম। সে টাকার সঙ্গে আরও কিছু দিয়ে কৃষকদের সুবিধার জন্য মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর কেনা হয়েছে। এছাড়া ২০১৫ সালে ধান গবেষণা ইন্সটিস্টিউটের পক্ষ থেকে ব্রি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলাম।
তিনি আরও জানান, মানুষের প্রয়োজনে রাস্তা ঘাট, বাড়ি তৈরিতে অনেক ওষধি গাছপালা নষ্ট ও হারিয়ে গেছে। আমার স্বল্প জায়গায় কিছুটা হলেও তা সংরক্ষণ করতে পেরেছি। কৃষকদের সুবিধার জন্য কৃষি পুঞ্জিকা প্রকাশ ও প্রতি মাসে কৃষি বিষয়ে সেমিনার করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সত্যব্রত সাহা জানান, কৃষি অফিস থেকে তথ্য এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। কৃষি লাইব্রেরি থেকে কৃষকরা বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকেন। কৃষি জাদুঘরে অনেক কৃষি যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ করা হয়েছে।
আব্বাস আলী/এসএস/এমএস