নাকুরু: কেনিয়ার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক রত্ন

তানভীর অপু
তানভীর অপু তানভীর অপু , বিশ্ব পর্যটক
প্রকাশিত: ০৬:০৮ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০২৫
কেনিয়ার নাকুরু অঞ্চলে লেখক, ছবি: লেখকের সৌজন্যে

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সকালে। যখন সূর্যের প্রথম কিরণ শহরের কোলঘেঁষে থাকা কংক্রিটের ভবনগুলোকে সোনালি আভায় ছেয়ে দিচ্ছিল। রাস্তা ধরে এগোতে গিয়ে চোখে পড়ছিল গ্রামীণ দৃশ্যপটের এক অপরূপ সমাহার। পথের ধারে দাঁড়িয়ে লোকেরা গরুর চামড়া মাথায় নিয়ে বাজারে যাচ্ছে। কারো হাতে ঝোলানো ঝাঁপি ঝাঁপি সবজি আর দূরে ছোট ছোট নদীর শান্ত জলরাশি যেন পথচারীর মনকে প্রশান্ত করছে। পথের ধারে ফুলের বাগান। লাল, হলুদ, গোলাপি রঙের যেন এক অনবদ্য ক্যানভাস গড়ে উঠেছে। সবকিছুর মাঝেই আমাদের প্রথম গন্তব্য নাকুরুর দিকে যাত্রা শুরু হলো। যা কেনিয়ার রিফট ভ্যালির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর।

নাকুরু শুধু একটি শহর নয়; এটি যেন প্রকৃতির, ইতিহাসের, সংস্কৃতির এবং জীববৈচিত্র্যের এক অনন্য মিলনকেন্দ্র। নাইরোবি থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এই শহর, গ্রেট রিফট ভ্যালি অঞ্চলের অন্তর্গত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১,৮৫৪ মিটার (৬,০৮৩ ফুট)। এই উচ্চতা এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নাকুরুতে আবহাওয়া সব সময় তুলনামূলক শীতল এবং আরামদায়ক। যা গ্রীষ্মে গড়ে ২৪° থেকে ২৬° সেলসিয়াস এবং শীতে ১০° থেকে ১২° সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকে। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এখানে বৃষ্টির মৌসুম। আবার অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ছোট বৃষ্টি হয়। যা শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও ঝকঝকে করে তোলে।

jagonews

নাকুরু কেনিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম শহর। নাইরোবি, মোম্বাসা এবং কিসুমুর পর এটি অন্যতম জনবহুল নগর। শহরটি শুধু অর্থনৈতিক ভাবে নয়; সাংস্কৃতিক দিক থেকেও সমৃদ্ধ। এখানে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে প্রধানত কিকুয়ু, কিসি, লুহিয়া, ক্যালেনজিন সম্প্রদায় এবং এশীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মিলনে নাকুরু হয়ে উঠেছে এক বহু-জাতিগত নগর। যেখানে ভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া প্রতিটি কোণে লক্ষ্য করা যায়। শহরের বাজারে ভারতীয় উপমহাদেশীয় বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের উপস্থিতি বিশেষভাবে চোখে পড়ে। যারা ঔপনিবেশিক যুগে রেলপথ নির্মাণে এসেছিলেন। এই ইতিহাসের ছোঁয়া আজও শহরের হৃৎস্পন্দনে শোনা যায়।

নাকুরু শহরের অর্থনীতি মূলত কৃষি এবং পর্যটন কেন্দ্রিক। গম, ভুট্টা, শাক-সবজি, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য এখানে প্রচুর উৎপাদিত হয়। তবে শহরটিকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে তার ফুল চাষ। লাল, গোলাপি, হলুদ রঙিন ফুলের খামারগুলো বিদেশে রপ্তানি হয় এবং শহরের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

jagonews

নাকুরু যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব রত্নখনি। এখানে পাহাড়, হ্রদ, আগ্নেয়গিরি এবং বন্যপ্রাণীর এক অদ্বিতীয় সমাহার দেখা যায়। এর মধ্যে প্রধান আকর্ষণ হলো লেক নাকুরু। একসময় লাখো ফ্লেমিঙ্গো পাখি হ্রদের পৃষ্ঠে গোলাপি আভা তৈরি করতো, যা দূর থেকে দেখতে গেলে যেন রঙিন মেঘের ছায়া হ্রদে ভাসছে। আজও লেক নাকুরুতে পাওয়া যায় সাদা গণ্ডার, কালো গণ্ডার, জলহস্তী, মহিষ, জিরাফ এবং নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী। হ্রদের লোনা পানি আর চারপাশের ঘন বন এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে রহস্যময় এবং সুরম্য করে তুলেছে।

আরও পড়ুন

সমুদ্রতীরের নৈঃশব্দ্য ও স্মৃতির শহর 
পথের শেষে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখতে চাই 

লেক নাকুরু ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত। যা ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং প্রায় ১৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি বিশেষভাবে গণ্ডার সংরক্ষণের জন্য খ্যাত। এখানে হেঁটে বা গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে পর্যটকরা প্রকৃতির নীরবতা, পশুপাখির কূটচালনা এবং বনাঞ্চলের সৌন্দর্য একসাথে অনুভব করতে পারে।

jagonews

নাকুরুর কাছাকাছি রয়েছে হায়েনা হিলস ও মেনেঙ্গাই ক্রেটার। এটি একটি বিশাল আগ্নেয়গিরির গহ্বর, যা পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ক্রেটার। ক্রেটারের শীর্ষ থেকে পুরো রিফট ভ্যালি অঞ্চলের দৃশ্য দেখা যায়। যেখানে পাহাড়ের ঢালু, সবুজ বনভূমি, কৃষিক্ষেত্র এবং দূরে লেক নাকুরুর নীরব জলে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক চিত্র ফুটে ওঠে।

নাকুরু শুধু প্রাকৃতিক দিক থেকে নয়, ইতিহাসের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশরা নাকুরু অঞ্চলকে শিকার ও কৃষির জন্য ব্যবহার করতো। শহরের রেলপথ নির্মাণের সময় ভারতীয় উপমহাদেশীয় মানুষেরা এখানে বসতি স্থাপন করে। যা শহরের বর্ণময় সাংস্কৃতিক আবহকে সমৃদ্ধ করেছে। শহরে কিছু প্রাচীন গির্জা, মন্দির এবং মসজিদ আজও বিদ্যমান, যা নাকুরুর বহুজাতিক ও বহু-সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করে।

jagonews

নাকুরু আমাদের যাত্রাপথের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। পথে চোখে পড়া গ্রামীণ দৃশ্য, চামড়া ও সবজির বাজার, ছোট নদী ও ফুলের বাগান সব মিলিয়ে এক আলাদা অভিজ্ঞতা তৈরি করে। শহরে পা রাখলেই বোঝা যায় এখানে প্রকৃতির নীরবতা, মানুষের কোলাহল, ইতিহাসের গভীর ছোঁয়া সবকিছুই একসাথে মিলেমিশে আছে। নাকুরুতে লেক নাকুরু, ন্যাশনাল পার্ক, মেনেঙ্গাই ক্রেটার ও পাহাড়ের দৃশ্য যেন ভ্রমণপিপাসু মনকে অবশেষে শান্তি দেয়।

সংক্ষেপে বলা যায়, নাকুরু কেনিয়ার প্রকৃতির, সংস্কৃতির ও ইতিহাসের এক অনন্য মিলনকেন্দ্র। যেখানে একসঙ্গে পাহাড়, হ্রদ, আগ্নেয়গিরি ও বন্যপ্রাণীর এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। নাইরোবি থেকে সহজেই পৌঁছানো যায় এবং এখানে প্রতিটি মুহূর্ত ভ্রমণপিপাসুকে নতুন রোমাঞ্চ ও আনন্দের অভিজ্ঞতা দেয়।

এসইউ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।