নয়নাভিরাম চন্দ্রনাথ পাহাড়

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:১৫ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
ফাইল ছবি

মুহিবুল হাসান রাফি

পর্যটকদের জন্য রোমাঞ্চকর দর্শনীয় স্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়। এটি চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ঐতিহাসিক স্থান। পাহাড়ের চূড়ায় শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ মন্দির (চন্দ্রনাথ ধাম)। পাদদেশে সীতাকুণ্ড ইকো পার্ক এবং আশেপাশে অনেক মন্দির ও দর্শনীয় স্থান আছে। যা ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তোলে। বছরজুড়েই থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন ভ্রমণপ্রেমীরা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকেও চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণ করতে দেখা যায়। তবে চন্দ্রনাথ ধাম ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময় হলো হেমন্ত ও শীত মৌসুম। পাহাড়ের ওপরে হাজারো প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছপালা প্রকৃতিপ্রেমীদের বিমোহিত করে।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে শুধু ভ্রমণের উদ্দেশেই মানুষ আসে না বরং কিছু লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েও ভ্রমণ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়া, যা প্রায় ১০১৭ ফুট (৩১০ মিটার)। যেখানে উঠলে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ নয় বরং পাহাড়ে ওঠার রেকর্ড অর্জন করা যায়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় আছে চন্দ্রনাথ ধাম বা শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ মন্দির। এখানে দেবী সতীর ডানহাত পড়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। মন্দিরটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। দেশ-বিদেশের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসেন। তারা পূজা দেন এবং প্রার্থনা করেন। সবমিলিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড় পর্যটকদের জন্য চমৎকার স্থান। তবে এ স্থান জয় করা মোটেও সহজ নয়। পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছতে পাড়ি দিতে হয় দুর্গম পথ-সিঁড়ি। যেখানে ২ হাজার ২০০টির বেশি সিঁড়ি আছে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সামান্য ভুল করলেই হতে পারে বিপদ। তাই ভ্রমণ করতে যাওয়ার আগেই জেনে নিতে হয় কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়।

সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। তাই সীতাকুণ্ড বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যেতে হয়। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতেই দেখা মেলে কয়েকটি দোকানের। দোকানে পাহাড়ে ওঠার লাঠি পাওয়া যাবে। দোকান থেকে লাঠি কিনে নিতে হবে। লাঠি দেখতে খুব সুন্দর। লাঠিতে ভর দিয়ে উঠতে শুরু করবেন পাহাড়ে। বাজার থেকে এ পথে আছে শংকর মঠ, শ্মশান, গিরিশ ধর্মশালা, ননী গোপাল তীর্থ মন্দির, ভৈরব ধর্মশালা, শ্রী শ্রী সীতা মন্দিরসহ (সীতাকুণ্ড) আরও অনেক দেবালয়। আরও কিছুটা পথ ওঠার পর দেখা যাবে ভবানী মন্দির। ভবানী মন্দির ছেড়ে আরেকটু পথ এগোলেই শম্ভুনাথ মন্দির, ছোট্ট একটি পাহাড়ি ঝরনা। এখান থেকেই চন্দ্রনাথ মন্দিরের দিকে উঠতে হয়।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার জন্য আছে দুটি পথ। একটি পথ বামদিকে, অপরটি ডানদিকে। ডানদিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি আর বামদিকের রাস্তাটি পুরোটাই পাহাড়ি পথ। বামদিকের পথ দিয়ে ওঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁড়ির পথ দিয়ে নামা সহজ। তবে দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর। গা শিউরে ওঠে। উঁচু-নিচু ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে চূড়ায় উঠতে ন্যূনতম দুই ঘণ্টা লাগে। চন্দ্রনাথ পাহাড় জয় করতে হলে অবশ্যই শুরু থেকে ধীরে ধীরে উঠতে হবে। তাড়াহুড়া করা মোটেও ঠিক হবে না। খুবই সতর্কতার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। দোকান থেকে নেওয়া লাটি ভারসাম্য রক্ষায় সহযোগিতা করবে। সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি নিতে হবে। কারণ কিছুক্ষণ পরপরই শরীরে পানির প্রয়োজন হবে। পাহাড়ের পথ ঝুঁকিপূর্ণ, সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে ইট-পাথরের সরু সিঁড়ি। কোথাও মেঠোপথ। দুর্গম। সিঁড়ি ও পথ ভাঙা। সিঁড়িগুলোয় উঠতে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ক্লান্ত হয়ে গেলে মাঝপথে বিশ্রাম নিতে হবে। কিছু দূর পর পর দোকান আছে, বসার জায়গা আছে।

আরও পড়ুন
পাহাড় ও সমুদ্রের খোঁজে আমরা 
হামহাম মায়াবী এক জলপ্রপাত 

পাহাড়ে উঠে সামান্য পথ গেলেই দেখা মেলে একটি গাছ। সেখানে বানরের আনাগোনা চোখে পড়বে। গাছজুড়ে আছে বানরের কোলাহল। পর্যটকরা সেখানে পৌঁছালে ছুটে আসে বানর। বানরকে নিয়ে ভ্রমণকারীরা মেতে ওঠেন। কেউ বানরকে কলা খাওয়ান, কেউ খাওয়ান কেক-বিস্কুট। তবে এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বানরকে কিছু খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে উত্তেজিত করা যাবে না। তাহলে হিতে বিপরীত হবে। বানরের দৃশ্য ভুলতে না ভুলতেই মিলবে চমৎকার ঝরনা। যেখানে গিয়ে তৃষ্ণার্ত মন ভিজিয়ে নেওয়া যাবে। এরপর কিছু পথ পেরোলেই মেঘের আনাগোনা। সেই সুন্দরতম দৃশ্য দেখে রীতিমতো অবাক হতে হবে। মনে হবে যেন মেঘের সঙ্গে খেলা করছেন। এভাবেই একের পর এক দৃশ্য চোখে পড়বে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে গিয়ে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর ৯০০ ফুট ওপরে পাহাড়টির অন্যতম আকর্ষণ শ্রী শ্রী বিরূপাক্ষ মন্দিরের দেখা মেলে। মন্দিরের সামনে হাজারো মানুষের আবেগ-অনুভূতি চিঠির আকারে ঝুলে আছে গাছের ডালে। এখানে প্রতি বছর শিবরাত্রিতে বিশেষ পূজা-অর্চনা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন। ছুটে আসেন ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের সাধু-ভক্তরাও। এমনকি সাধারণ ভ্রমণবিলাসীরাও অংশ নেন। পূজাকে কেন্দ্র করে সীতাকুণ্ডে মেলার আয়োজন করা হয়। বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে ১৫০ ফুট দূরেই শ্রী শ্রী চন্দ্রনাথ মন্দির। এটি চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। মন্দির থেকে ১৫০ ফুট রাস্তার প্রায় ১০০ ফুট খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয়। ফলে সাবধানতার মার নেই! ধামে পৌঁছালে প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। মন্দিরে ঢুকলে শীতল হয়ে যায় মন। এখানে পুরোহিত আছেন। ভক্তরা মানস কামনায় সব সময় পূজা দিতে পারেন। তবে পূজার্থী ছাড়া মন্দিরে ঢোকায় বিধি-নিষেধ আছে।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়া বেশি পরিসরের নয়। তবে এখানে দাঁড়িয়ে একদিকে সমুদ্র আর অন্যদিকে পাহাড়ি নির্জনতা বেশ উপভোগ্য। উঁচু-নিচু পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুগ্ধতায় প্রশান্তিতে মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। ভ্রমণে দর্শনার্থীদের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে পাহাড়ের ওপর রয়েছে কয়েকটি টং দোকান। ভ্রমণপিপাসুদের তৃষ্ণা মেটাতে এগুলোর জুড়ি মেলা ভার। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেই মনে হবে যেন, শুভ্র মেঘের ভেলায় ভাসা নীল আকাশ পাহাড়ের সঙ্গে খেলা করছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হবে মন। এতে ভুলিয়ে দেবে জীবনের দুঃখ-বেদনা।

অনেকেই সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার আত্মবিশ্বাস নিয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করেন। কিন্তু কিছু কাজ তাদের সফলতার সেই জায়গায় যেতে দেয় না। পাহাড়ে উঠতে পুরো পথটাই আকর্ষণীয়। পাশাপাশি অত্যন্ত কঠিনও বটে। এই আকর্ষণীয়-কঠিন পথে ওপরে উঠতে গিয়ে ভুল করেও পেছনে ফিরে তাকাবেন না। পেছন ফিরে তাকালেই মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক দর্শনার্থী আছেন; যারা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে কিছু দূর গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। চন্দ্রনাথ জয় করতে তারাই পারবেন; যাদের আত্মবিশ্বাস প্রবল ও লক্ষ্য দৃঢ়। যারা পরিশ্রমী, হার্ট ভালো, কঠিনতম পথ পাড়ি দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন, অনেক উঁচু থেকে নিচে তাকানোর অভ্যাস আছে এবং দীর্ঘতম পথ হেঁটে পাড়ি দিতে পারেন। আত্মবিশ্বাস এবং মনোবল নিয়ে এগিয়ে যান চন্দ্রনাথ পাহাড়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ।

এসইউ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।