বর্ষাকালে পুকুরে লাভজনক মাছ চাষের উপায়
বর্ষায় আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুর-ডোবা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সময়টিতে প্রাকৃতিকভাবে মাছের প্রজনন এবং বৃদ্ধি সহজ হয়। তাই বলা যায়, বর্ষা মৌসুম মাছ চাষের জন্য প্রকৃতির উপহার। তবে এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে মাছ চাষ। বর্ষাকালে সঠিক প্রস্তুতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে মাছ চাষে উল্লেখযোগ্য মুনাফা অর্জন সম্ভব।
বর্ষার সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিল, ছড়া ও প্লাবন ভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। এসব এলাকায় ফসল উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। সেগুলো একপ্রকার অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। এমন জলাভূমি বা পুকুর সংস্কার করে মাছ চাষে ব্যবহার করা যায় খুব সহজে। তবে এ জমি বা পুকুর সাধারণত অনেক কৃষকের ভাগে ভাগে থাকে। তাই সমাজভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে চাষ শুরু করলে একদিকে যেমন চাষের সুযোগ বাড়ে, অন্যদিকে সমাজে গড়ে ওঠে সম্মিলিত উন্নয়ন ও সচেতনতা। এসব উদ্যোগে স্থানীয় মানুষ সরাসরি উপকৃত হয় এবং আর্থিকভাবেও লাভবান হয়।
মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। পুকুর থেকে রাক্ষুসে মাছ, আগাছা ও আবর্জনা পরিষ্কার করার পর নির্দিষ্ট হারে চুন ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হয়, যাতে পানিতে প্রাকৃতিক খাবারের সৃষ্টি হয়। এরপর ৮-১২ সেন্টিমিটার আকারের সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে ছাড়তে হয়। তবে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টি ও পানি জমে থাকার কারণে পানির গুণাগুণ দ্রুত পরিবর্তিত হয়। তাই নিয়মিতভাবে পানির পিএইচ, তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অ্যামোনিয়ার পরিমাণ পরীক্ষা করতে হয়। পানির গুণ ঠিক রাখার জন্য প্রয়োজনে চুন ও জিওলাইট সঠিক নিয়মে ব্যবহার করতে হয়।
পুকুরে খাবার দেওয়া, ময়লা পানি ঢোকা রোধ, মাছের পালানোর পথ বন্ধ করাসহ নানা বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় বর্ষাকালে। অতিরিক্ত বৃষ্টিতে মাছ যাতে পুকুর থেকে ভেসে না যায়, সেজন্য পুকুরের পাড় উঁচু করে শক্ত করে বাঁধতে হয়। পানি বের হওয়া বা ঢোকানোর পথের ছাঁকনির ব্যবস্থাও নির্ভরযোগ্য হতে হবে। বাইরে থেকে যাতে ময়লা বা দূষিত পানি পুকুরে না ঢোকে, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। পুকুরের চারপাশে বাঁশের ঘের বা মশারির জাল দিয়ে মাছ আটকে রাখার ব্যবস্থা করলে বন্যা বা অতিবৃষ্টির সময়েও ক্ষয়-ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এ মৌসুমে লাভজনক চাষের জন্য মিশ্রচাষ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, বিগহেড, সিলভার কার্প ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের মাছ একত্রে চাষ করে পুকুরের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। নিবিড় বা আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে কম জায়গায় অধিক উৎপাদন সম্ভব হয়, যদি সময়মতো সঠিক খাদ্য ও পরিচর্যা নিশ্চিত করা যায়। বর্ষাকালে পুকুরে ঝোঁপঝাড় তৈরি করে মাছের আশ্রয়স্থল দেওয়া ও দ্রুত আকৃষ্ট হওয়ার মতো খাবার যেমন- খৈল বা চিটাগুড় ব্যবহার করলেও মাছের বৃদ্ধিতে অগ্রগতি আসে।
বর্ষায় পোনা সরবরাহ ও নার্সিং ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। যেহেতু পোনা পরিবহনের সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই হাপানোর ব্যবস্থা করে বা ধীরে ধীরে তাপমাত্রা সমান করে পানিতে ছাড়তে হয়। নার্সারি পুকুরে কিছুদিন রেখে যত্ন নিয়ে বড় করে চাষ পুকুরে ছাড়লে পোনার বেঁচে থাকার হার অনেক বেশি হয়।
বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পুকুরে সার ও খাদ্য প্রয়োগে সাবধানতা জরুরি। অতিরিক্ত সার বা নিম্নমানের খাবার পানিকে দূষিত করে, যা মাছের বদহজম, রোগ কিংবা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় খাবার সীমিত পরিমাণে দিতে হবে এবং পানি বিশুদ্ধ রাখতে প্রয়োজন অনুযায়ী চুন বা অন্যান্য উপাদান প্রয়োগ করতে হবে।
বর্ষার শেষে মাছ ধরার সময় ড্রাম ও বরফের ব্যবস্থাসহ জীবিত মাছ পরিবহনেও সচেতন হতে হয়, যাতে মাছের ওজন ও গুণগত মান নষ্ট না হয়। রোগবালাই বর্ষাকালে কম হলেও পানির মানের অবনতি হলে রোগ-ব্যাধি দেখা দিতে পারে। তাই প্রয়োজন অনুসারে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। তবে তা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী হওয়া উত্তম।
বর্ষাকালে মাছ চাষ যেমন চ্যালেঞ্জিং; তেমনই এর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিপুল সম্ভাবনা। পরিকল্পিত উদ্যোগ, বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা ও সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে বর্ষার পানি শুধু সমস্যা নয় বরং হতে পারে অর্থনৈতিক সফলতার অনন্য উদাহরণ। এ সফলতার হাত ধরেই একদিকে যেমন পুষ্টির ঘাটতি দূর হবে; তেমনই গড়ে উঠবে আত্মনির্ভরশীল ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ সমাজ।
এসইউ/জিকেএস