বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে একটি অনিশ্চয়তার পরিবেশ বিরাজমান। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ চরমে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বিরোধ রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে জটিলতা।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন, নির্বাচনি জোট এবং সামগ্রিক বিষয় নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁনের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক হাসান আলী।
জাগো নিউজ: শুভেচ্ছা, কেমন আছেন?রাশেদ: জ্বি, আমি ভালো আছি।
আরও পড়ুনচার ক্যাম্পাসে শিবিরের ভূমিধস জয় রহস্যজনক: নুরএনসিপি বুঝে না বুঝে আরেকটি মওদুদীবাদি প্রক্সি দল হয়ে উঠছেউপদেষ্টাদের নির্বাচনে অংশ না নেওয়াসহ গণঅধিকার পরিষদের ৯ প্রস্তাবএনসিপির নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদের জোট করার সংবাদটি মিথ্যা
জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাশেদ খাঁন: সাম্প্রতিক সময়ে যে পরিস্থিতি এটা আসলে জটিল পরিস্থিতি। গণঅভ্যুত্থানের পরে গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে যে ধরনের বিভাজন তৈরি হয়েছে, এটি কোনোভাবে কাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা সব দলের প্রতি আহ্বান রাখতে চাই যে আমাদের মতপার্থক্য থাকবে, আমাদের মতের অমিল থাকবে কিন্তু দেশ এবং জনগণের কল্যাণে অবশ্যই আমাদের একটা জায়গায় থাকতে হবে। ভারত এবং আওয়ামী লীগের প্রশ্নে যদি আমরা এক থাকতে না পারি, তাহলে এদেশে আবারও কিন্তু আওয়ামী লীগ ফিরবে।
জাগো নিউজ: গণভোট ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে একধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে দেশজুড়ে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কি কোনো শঙ্কা অনুভব করেন?
রাশেদ খাঁন: ফেব্রুয়ারি মাসে যে নির্বাচন হওয়ার কথা সেই নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ধরনের দাবি-দাওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের আগে গণভোট, নাকি পরে গণভোট, নাকি একই দিনে- এ ধরনের বিভাজন আমরা লক্ষ্য করছি। দেখেন, পৃথিবীর ইতিহাসে গণভোট সবসময় কিন্তু নির্বাচনের পরই হয়। এটা বাস্তবসম্মত, এটাই হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের দু-একটি দল যারা গণভোট আগে চাচ্ছে তারা মূলত আমার কাছে মনে হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনটা পেছাতে চায়। জাতীয় নির্বাচন পেছানোর জন্য তো একটা অজুহাত দরকার। এখন তারা যদি ফ্লেক্সিবল থাকতো যে সরকার সিদ্ধান্ত নিক যে আগে বা একই সময়ে বা পরে তাহলে সমস্যা ছিল না। তাদের কথা হলো আগে হতেই হবে, অন্যথায় তারা জাতীয় নির্বাচন হতে দেবে না। এটা তো গণতন্ত্রের কোনো ভাষা নয়। এটা আমি মনে করি ফ্যাসিবাদের ভাষা।
জাগো নিউজ: রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী বলে আপনি মনে করেন? এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
রাশেদ খাঁন: রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় কি না সেটাই। একইসঙ্গে নির্বাচনের আগে যে জুলাই জাতীয় সনদ, সে ব্যাপারে যে ভিন্নমত এ ভিন্নমতটা কীভাবে ঐকমত্যে আনা যায়? সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত ওইভাবে আসলে ফাংশন করছে না। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে সহযোগিতার মাধ্যমে যদি এটা নিয়ন্ত্রিত না হয় সেক্ষেত্রে তো নির্বাচনটা আসলে সুষ্ঠু হওয়া কঠিন। আর বাংলাদেশে যদি এবার নির্বাচন সুষ্ঠু না হয় ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে, এর কারণে আসলে দলগুলোকেও এক ধরনের খেসারত দেওয়া লাগবে। আমরা সবাই মিলে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য সবাই যদি এ সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারি তাহলে চ্যালেঞ্জ এলে মোকাবিলা করা যাবে।
আরও পড়ুনগোপালগঞ্জে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতিসহ ৪৯ নেতার একযোগে পদত্যাগহাসিনা দিল্লিতে বসে নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করছেন: রাশেদ খাঁননির্বাচনী নয়, নীতিনির্ভর জোট গঠনের পথে এনসিপিগণঅধিকারের সঙ্গে একীভূত হওয়ার আলোচনা ইতিবাচক: সারজিস
জাগো নিউজ: নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়কের আদলে সরকার পরিচালনার দাবির বিষয়ে বেশ জোরেসোরে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে গণঅধিকার পরিষদের অবস্থান কী?
রাশেদ খাঁন: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কিন্তু সবার আগে জামায়াতে ইসলামী করেছে। জামায়াত বলেছে যে জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন হতে হবে। জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন মানে কী? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। কারণ জুলাই সনদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলা আছে।
এখন বিএনপি যখন বলল যে এই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকায় যেতে হবে, এই সরকার বদলে নতুন সরকার নয়। ভূমিকায় যেতে বলা মানে কী? তারা ওই নির্বাচনমুখী হবে। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। এটা তো ভালো প্রস্তাব। যখন এ বিষয়টি বিএনপি আনলো তখন জামায়াত দেখলাম ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেছে।
আপনার একটা ভালো দাবির প্রতি আমার সংহতি থাকতেই পারে। কিন্তু আপনার যে কোনো দাবির প্রতি আমি শুধু বিপরীত অবস্থান নিচ্ছি, এটা তো কোনো রাজনীতি নয়। বর্তমানে আমরা দেখছি যে, বিএনপি যে দাবি মেনে নিচ্ছে, জামায়াত সে দাবি মানছে না। মানে এখন তাহলে কী করা উচিত? বিএনপির কোনো দাবি মানাই উচিত নয়?
আরও পড়ুনপাহাড়ে বিশৃঙ্খলার পেছনে ভারতের ষড়যন্ত্র রয়েছে: রাশেদ খানগণঅধিকার পরিষদে যোগ দিলেন বৈষম্যবিরোধী-যুবশক্তির ৫০ নেতাকর্মীগণঅধিকার পরিষদ-এনসিপি একীভূত হবে, গড়বে তরুণদের সবচেয়ে বড় জোটগণঅধিকার পরিষদকে নিষিদ্ধের দাবি জাপা মহাসচিবের
জাগো নিউজ: বর্তমান যে নির্বাচন কমিশন আছে সেই কমিশনের ভূমিকা নিয়ে আপনাদের অবস্থান কী? এই কমিশনের প্রতি জনগণ আস্থা রাখতে পারে কি না?
রাশেদ খাঁন: বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর আমাদের আস্থা আছে। জনগণের আস্থা রাখা উচিত। যাদের আস্থা নেই এতদিন বলছিল, তারা আজ (২ নভেম্বর) গিয়ে শাপলা কলি প্রতীক নিয়ে এলো। তো এই যে নাটক, অভিনয় করা, এ ধরনের রাজনীতি এটা নতুন রাজনীতির উদ্দেশ্যের সঙ্গে যায় না।
নতুন বন্দোবস্তের নামে আজ পুরোনো বন্দোবস্ত থেকেও খারাপ রাজনীতি করা হচ্ছে। যারা এগুলো করছে আমি তাদের বলব যে এগুলো কোনো রাজনীতি নয়। যেভাবে আসলে সিনিয়র নেতাদের নিয়ে তারা মন্তব্য করছে, একের পর এক মিডিয়াবাজি করছে। আমার কাছে মনে হয়, এটা তো আসলে সেই আওয়ামী আমলের রাজনীতি থেকেও খারাপ অবস্থায় আমরা যাচ্ছি। একজন ছেলের বয়সী, সে তার বাবার বয়সী রাজনীতিবিদকে যেভাবে অপমান-অপদস্ত করছে এটা কোনো রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। পুরোনো আমলের রাজনীতি এর থেকে ভালো। আওয়ামী লীগের সময়ও তো আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যেভাবে কথা বলতো তার থেকে জঘন্য ভাষায় এখন এই এনসিপির কয়েকজন নেতা কথা বলছে, এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। তারাই কিন্তু সর্বপ্রথম নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না। তো ভাই নিরপেক্ষ না তো এই কমিশনের কাছে আবেদন করছিলেন কেন? নিরপেক্ষ না থাকলে তাদের কাছ থেকে আবার শাপলার কলি প্রতীক নিলেন কেন? এই ভাওতাবাজির রাজনীতিটা বন্ধ করা উচিত। আমরা যতটুকু জানি এই নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট স্বচ্ছ। এই নির্বাচন কমিশনে যারা নিয়োগ পেয়েছে তারা যথেষ্ট পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক। তাদের ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই।
জাগো নিউজ: নির্বাচন ঘিরে গণঅধিকার পরিষদ বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছে- এমনটি শোনা যায়। আসলেই কি কোনো সমঝোতা হয়েছে?রাশেদ খাঁন: বিএনপির সঙ্গে আমরা ২০২২ সাল থেকে যুগপৎ আন্দোলন করেছি। বিএনপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়। যেহেতু একসঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, তো সেই জায়গায় একসঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রাম করার কারণে সংস্কারের ৩১ দফা আমরা তৈরি করেছিলাম বিএনপিসহ সবাই। এরপর সেখানে জাতীয় সরকারের কথা বলা আছে। সবাই মিলে একসঙ্গে নির্বাচন করার ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চলছে। বাট চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত হয়নি।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে: গণঅধিকার পরিষদ নেতাড. ইউনূসের সফরে রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন রাশেদেরহত্যার উদ্দেশ্যেই নুরকে আঘাত করা হয়েছিল: মির্জা ফখরুলনুরের ওপর হামলার বিচার না হলে সরকারের ভয়াবহ পরিণতি হবে
জাগো নিউজ: শোনা যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের বাইরে গিয়ে নয়টি রাজনৈতিক দল আলাদা একটি জোটের ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে। যেখানে গণঅধিকার পরিষদও আছে। এ ব্যাপারে জানতে চাই।
রাশেদ খাঁন: না, এই নয়টি রাজনৈতিক দলের জোট- এটা সঠিক নয়। আসলে জোটের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আসেন আমরা জোট করি। আমরা তাদের বলেছি যে কোনো অপরিপক্ব দলের নেতৃত্বে আমরা কোনো জোট করবো না। তোমরা এর আগে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিলে, আবার তোমরাই বললে আমরা তোমাদের দলে যোগদান করতে চাই। তো এ ধরনের অপরিপক্ব আচরণ বন্ধ করতে হবে। মানুষকে ছোট করার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। তুমি যদি আসলেই বড় হতে চাও তোমাকে উদার হতে হবে। তো যেদিন উদার হবা সেদিন জোট করার ব্যাপারে আলোচনা করবো।
জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত এবং কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পার্টির ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এটা কি জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে?
রাশেদ খাঁন: দেখেন যদি আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ১৪ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে নির্বাচনটা আর হবে না। আমরা সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচনের কথা বলছি। জাতীয় পার্টি এই সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য হুমকি। সুতরাং আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ফ্যাসিবাদের সব দোসর এবং তাদের যারা সহযোগিতাকারী এদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে হবে। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।
জাগো নিউজ: আপনার কাছে শেষ প্রশ্ন। আগামী ১০ বছর পরে গণঅধিকার পরিষদকে কোথায় দেখতে চান?রাশেদ খাঁন: আগামী ১০ বছর পরে গণঅধিকার পরিষদকে আমরা ক্ষমতায় নিয়ে যেতে চাই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি আমাদের সহায় হন অবশ্যই আমরা ক্ষমতায় যেতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
জাগো নিউজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।রাশেদ খাঁন: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।
এমএইচএ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম