মুহুরী প্রজেক্টে কমছে পর্যটক

ফেনী রেলওয়েতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত মীর মোহাম্মদ ইমাম উদ্দিন। সম্প্রতি তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সোনাগাজীর মুহুরী প্রজেক্টে ঘুরতে যান। ভ্রমণের যে আনন্দ নিয়ে এসেছিলেন তা মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়। হঠাৎ সেখানে একদল লোক এসে তাদের জিম্মি করে টাকা, স্বর্ণালংকার ও মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়।
এরপর ইমাম উদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হয় সোনাপুর বাজারে। তার এটিএম কার্ড দিয়ে বুথ থেকে টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এসময় আশপাশের লোকজন বিষয়টি টের পেয়ে জড়ো হলে সটকে পড়ে ছিনতাইকারীরা।
শুধু এই প্রকৌশলীই যে বিপদে পড়েছেন তা কিন্তু নয়। তার মতো মুহুরী প্রজেক্টে ঘুরতে গিয়ে অনেকে ছিনতাই ও চাঁদাবাজদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত হওয়ায় ভ্রমণকারীদের কাছে মুহুরী প্রজেক্টের আকর্ষণ রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ছিনতাই ও চাঁদাবাজদের উপদ্রব বাড়ায় কমে গেছে পর্যটকের সংখ্যা। এছাড়া প্রতিদিন অতর্কিত হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে। এক কথায় অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রটি। ফলে এদের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান স্থানীয়রা।
নৌ-ভ্রমণের সময় খুব কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়
বিভিন্ন সূত্র ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুহুরী প্রজেক্টে তিনটি সংঘবদ্ধ চক্র অপরাধে জড়িত। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে এরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন আমিরাবাদের সাবেক ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম ও তার ছেলে বাবু। আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একই এলাকার শেখ আনোয়ার। এছাড়া অপর আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে কাবিল ভূঞা বাড়ির মাসুদ রয়েছেন। এরমধ্যে শেখ আনোয়ার ও মাসুদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান এলাকাবাসী।
আরও পড়ুন:
- সূর্যাস্ত উপভোগে মুহুরী প্রজেক্টে কীভাবে পৌঁছাবেন?
- মুহুরী প্রজেক্ট ভ্রমণের আগে যা জানা জরুরি
- দেদারসে বালু উত্তোলন, ফেনী নদীতে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি
সূত্রের দাবি, এদের মধ্যে শাহীন গ্রুপের লোকজন চুরি-ছিনতাই-চাঁদাবাজিসহ মৎস্য প্রকল্প দখল ও মাছ লুটের একাধিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এছাড়া মুহুরী প্রজেক্টের ছোট নদী উত্তর অংশে একাধিক স্থানে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনেও জড়িত তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মৎস্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে মুহুরী প্রজেক্টে লুটতরাজের মহোৎসব শুরু হয়েছে। গ্রুপগুলো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং সংঘবদ্ধ হওয়ায় ভয়ে তাদের নাম কেউ মুখে নেয় না। প্রতিবাদ করা তো অনেক পরের বিষয়। অনেক ব্যবসায়ীও চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন।
বন্যার প্রকোপ কমানো ও কৃষি জমিতে সেচ সুবিধা দিতেই নির্মিত হয়েছিল এটি
স্থানীয় আলামিন ইমন নামে এক যুবক বলেন, সন্ধ্যার পর মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের কারণে এখানে পর্যটকদের আসা কমে গেছে।
তবে এসব অপরাধের কথা অস্বীকার করে শেখ আনোয়ার ও মাসুদ জানান, দলের সুনাম নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ করেন না তারা। ভবিষ্যতেও করবেন না। এখন পর্যন্ত তাদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই।
অপরদিকে এনামুল হক শাহীন বলেন, গ্রুপিংয়ের কারণে আমার নামে অভিযোগ তুলছে একটি পক্ষ। এসব ভিত্তিহীন।
এদিকে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পলাতক রয়েছেন আমিরাবাদের সাবেক ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম ও তার ছেলে বাবু। ফলে তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বায়েজিদ আকন বলেন, পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তা বাড়ানো হবে। চেকপোস্ট বসিয়ে উন্নতি ঘটানো হবে আইনশৃঙ্খলার। চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীসহ নানা অপরাধে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পর্যটন এলাকায় নিরাপত্তার বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান বলেন, পুলিশ, আনসার এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিরাপত্তা জোরদার করতে বলা হয়েছে। আমি নিজেও চেষ্টা করবো নিয়মিত টহলে যেতে।
ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেচ প্রকল্প। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে শুরু হয় এর নির্মাণ কাজ। যা শেষ হয় ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে।
এর মাধ্যমে ফেনী নদী, মুহুরী নদী ও কালিদাস পাহালিয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণে ৪০ ফোক্ট বিশিষ্ট একটি কাঠামো তৈরি করা হয়।
মূলত ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজী, সোনাগাজী এবং চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার কিছু অংশে বন্যার প্রকোপ কমানো ও কৃষি জমিতে অতিরিক্ত সেচ সুবিধা দিতেই নির্মিত হয়েছিল এটি।
সিডা, ইইসি, বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তায় জাপানের সিমুজু কোম্পানি ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের করে। ফলে ২০ হাজার ১৯৪ হেক্টর এলাকা সেচ সুবিধা এবং ২৭ হাজার ১২৫ হেক্টর এলাকা সম্পূরক সেচ সুবিধার আওতায় আসে।
এরপর মুহুরী সেচ প্রকল্পকে ঘিরে গত আড়াই দশকে গড়ে ওঠে বিনোদন ও পিকনিক স্পট। শীত মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে যান সেখানে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মুহুরী রেগুলেটরের চারদিকে বাধ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম জলরাশি, বনায়ন, মাছের অভয়ারণ্য, পাখির কলকাকলি, বাধের দুপাশে নিচ থেকে পাথর দিয়ে বাঁধানো এবং ওপর দিকে দুর্বা ঘাসের পরিপাটি বিছানা মুগ্ধ করে পর্যটকদের। এখানে নৌভ্রমণের সময় খুব কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস এবং প্রায় ৫০ জাতের পাখি দেখা যায়।
আবদুল্লাহ আল-মামুন/জেডএইচ/এমএস