লোকালয়ে আসবাব কারখানা, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ

খুলনার খালিশপুরের জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে কাঠ প্রক্রিয়াকরণ ও আসবাব কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে উৎপন্ন কাঠের গুড়া ও তুষ ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের ঘরের ভেতরে। এসব সূক্ষ্ম বর্জ্য নিঃশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসনালীতে গিয়ে নানা রকম রোগব্যাধি সৃষ্টি করছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশ ও শব্দদূষণ রোধে এ কারখানাগুলোয় নেই কোনো ব্যবস্থা। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, খালিশপুরের আলমনগর, বঙ্গবাসী স্কুল রোডসহ আরও বেশ কিছু আবাসিক এলাকায় কাঠ প্রক্রিয়াকরণ ও আসবাব কারখানা গড়ে উঠেছে। আসবাব চাঁছা ও প্রক্রিয়াকরণে কারখানাগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে কুন, রাউটার, জালি, বৈদ্যুতিক প্লেনারের মতো যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্র দিয়ে কাঠ প্রক্রিয়াকরণের সময় উৎপন্ন হচ্ছে বিপুল পরিমাণ তুষ ও গুড়ি। শব্দনিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় কারখানাগুলো থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিকট শব্দ, যা সেখানকার শ্রমিক ও এলাকাবাসীর শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপক ক্ষতি করছে।

আরও পড়ুন:

বঙ্গবাসী স্কুলসংলগ্ন রাস্তায় একে একে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কাঠ প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। কাঠ প্রক্রিয়াজাত করে আসবাব বানিয়ে নিজেরাই সেসব বিক্রি করেন দোকানিরা। শুরুতে হাতে গোনা কয়েকজন কাঠমিস্ত্রিকে এসব কারখানার জন্য দোকান ভাড়া দেওয়া হলে কালের বিবর্তনে সেখানে সারি সারি দোকান গড়ে ওঠে। এখন ওই এক সড়কেই রয়েছে প্রায় ২০টি কারখানা। অধিকাংশ কারখানায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাঠ প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলে, যা মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর পাশাপাশি পক্ষাঘাতগ্রস্থ নারী-পুরুষ ও শিশুদের স্বাস্থ্যহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঠের গুঁড়ি, তুষ ও শব্দদূষণ রোধে দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও রেহাই পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।

লোকালয়ে আসবাব কারখানা, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাঠের জিনিসপত্র আমরাই ব্যবহার করি। আমরা এসব ব্যবসা বন্ধ করতে বলছি না। তবে কারখানাগুলো লোকালয় থেকে একটু দূরে সরালে ভালো হয়। লোকালয়ে এ ধরনের কারখানা থাকায় একদিকে শব্দদূষণ হচ্ছে, অন্যদিকে হচ্ছে পরিবেশদূষণ। একসঙ্গে পাঁচ-ছয়টা ইলেকট্রিক মেশিন চালালে ভয়াবহ শব্দ হয়। গরমের সময় ঘরের জানালা খোলার উপায় থাকে না। এ ছাড়াও শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এই গুঁড়ি এলার্জি ও শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

কাঠ কারখানা ভাড়া দিয়েছেন এ রকম একজন বাড়িওয়ালার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে ফার্নিচার বিক্রি করতে ভাড়া দিয়েছি। দূর থেকে বানিয়ে এনে বিক্রি করুক তারা। ভাড়া দিয়ে এখন তুলে দিলেও কাজ হবে না। কারণ এখন অনেকগুলো দোকান হয়ে গেছে। এরা কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না।’

এসব বিষয়ে প্রতিকার পেতে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেছিলেন স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি বলে হতাশা ব্যক্ত করেন তারা।

সে প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পারভেজ আহমেদ বলেন, ‘কারখানাগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেশিন কারখানার ভেতরে নিয়ে কাজ করতে এবং পরিবেশের দূষণ প্রতিরোধে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’

এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক বঙ্গবাসী এলাকা পরিদর্শন করবেন বলে জানান পারভেজ আহমেদ।

আরও পড়ুন:

এসব কারখানার একজন শ্রমিক জানান, সকালে এসে দুপুর পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। অনেক অর্ডারের চাপ থাকলে গভীর রাত পর্যন্তও কাজ করতে হয়। কারখানায় গাছ থেকে পাওয়া তক্তা এবং কাঠ থেকে ফার্নিচারের বিভিন্ন অংশ প্রস্তুত হয় কারখানায়। ডিজাইন ও ফিনিশিংয়ের কাজ বেশি হয় সেখানে।

ওই শ্রমিক জানান, কাজ করার সময় গুঁড়ি নাকে গেলে একটু কষ্ট হয়। চোখের নিরাপত্তার জন্য চশমা ব্যবহার করেন অনেক শ্রমিক।

লোকালয়ে আসবাব কারখানা, ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে মানুষ

শব্দের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কথা হয় জাতীয় নাক-কান ও গলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক (অব.) এবং নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ ডা. জুনায়েদ রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘরের জিনিসপত্র, যেমন ফ্যানও যদি জোরে ঘোরে, তা থেকে সৃষ্ট শব্দ কানের ক্ষতি করতে পারে। ব্লেন্ডার, জেনারেটরের আওয়াজও কানের ক্ষতি করতে পারে, যদি সেটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি শব্দ তৈরি করে। শব্দের মাত্রা সাধারণত ৭০ ডেসিবল (ডিবি) হলে সেটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর, ৮৫ ডিবি হলে অনেক ক্ষতি হবে। যদি ১২০ ডিবির বেশি হয় তাহলে মানুষ তৎক্ষণাৎ বধির হয়ে যেতে পারে। এ তো গেল কানের ব্যাপারে। উচ্চমাত্রার শব্দে মানুষের হার্টবিট রেট বেড়ে যায়, তাতে হার্টফেল হতে পারে।’

ডা. জুনায়েদ রহিম জাগো নিউজকে আরও বলেন, ‘২০২২ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে চার মাস বয়সী একটি শিশু মারা যায় পটকার শব্দে। শিশুদের ভাষা শিখতে তিন বছর লাগে। এক বছর পর তারা একটা দুটো শব্দ বলতে শুরু করে। ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্টের সময়ে যদি সে কানে কম শোনে, তাহলে তার ভাষা শিখতে দেরি হবে, ক্ষেত্রবিশেষে সে বধির হয়ে যেতে পারে। যদি কথা না শেখে সে সমাজের বোঝা হয়ে যাবে। বয়স্করা নিয়মিত ৭০ ডিবির ওপরে সাউন্ড শুনতে থাকলে তারা বধির হয়ে যাবেন।’

২০০৬ সালে এ সংক্রান্ত একটি আইন করা হয়। সেখানে এলাকা ভাগ করে শব্দের মাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়। ওই আইন অনুযায়ী, নীরব এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা হচ্ছে ৫০ ডিবি, রাতে ৪০ ডিবি। একইভাবে আবাসিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা দিনে ৫৫ ও রাতে ৪৫ ডিবি, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫৫ ডিবি এবং শ্রমিক এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডিবি।

জুনায়েদ রহিম বলেন, ‘ইলেকট্রিক প্লেনারের সাউন্ড ১১০ ডিবি হতে পারে। যারা নিয়মিত ৮৫ ডিবির মধ্যে আট ঘণ্টা অবস্থান করবেন, তারা ধীরে ধীরে বধির হয়ে যাবেন।’

এসব ক্ষতির কথা জানালে বঙ্গবাসী স্কুল রোডের ইসমাইল ফার্নিচারে কর্মরত শাহজাহান বলেন, ‘কাঠের তুষে ফুসফুসের ক্ষতি হয় জানি। কাঠ কাটার সময় মাস্ক ও চোখে গ্লাস পরি।’

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একজন আসবাব ব্যবসায়ী বলেন, ‘পেটের ভাত জোগাতে এ কাজ করে খেতে হচ্ছে। শরীরের ক্ষতি হলে কী করা যাবে? প্রায় দুই যুগ ধরে আমরা এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছি। এখন হুট করে এ জায়গা থেকে ব্যবসা সরানোর উপায় নেই।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে। কোনো এলাকায় নির্মাণসামগ্রী তৈরির ক্ষেত্রে সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত কাজ বন্ধ রাখা উচিত। পূর্ণ আবাসিক এলাকা হলে সেখানে কারখানার অনুমোদনই দেওয়া হয় না।

এআরএএন/এসইউজে/আরএমডি/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।