ঈদের আনন্দ নেই ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ মিরাজের পরিবারে

মো. আকাশ মো. আকাশ , উপজেলা প্রতিনিধি সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)
প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ৩০ মার্চ ২০২৫
মিরাজ হোসেন

দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। ঈদকে ঘিরে মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও ভিন্ন চিত্র নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মিরাজ হোসেনের পরিবারে। তাদের পরিবারে ঈদের আমেজ আসেনি। অসুস্থ মিরাজের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে মানুষের দরজায় দরজায় দৌড়ানো পরিবারটির ঈদের জন্য নেই আলাদা কোনো প্রস্তুতি। নতুন পোশাকও কেনা হয়নি কারো। একমাত্র বোনের উপার্জিত অর্থের সবটাই যাচ্ছে মিরাজের চিকিৎসায় এর ওপর চেপে রয়েছে ঋণের বোঝা। তাই এবারের ঈদের আনন্দ ছুঁয়ে দেখা হচ্ছে না তাদের।

মিরাজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হলে তারা জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ঈদ বলতে কিছু নেই। দুঃখে ভরা জীবনে খাবার খাওয়া আর ঔষধের টাকা জোগাতে ঋণের বোঝা মাথায় নেওয়া লেগেছে। তাই ঈদের আনন্দ বা আমেজ নেই। ঈদের কেনাকাটা করার অর্থ বা সামর্থ্য কোনোটাই ভাগ্যে নেই। পাওনাদারদের চাপের ওপরে রয়েছি।

মিরাজ হোসেন ১৪ বছরের কিশোর। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ২০ জুলাই বিকেলে শিমরাইল-আদমজী চাষাঢ়া সড়কের ভূমিপল্লী সামনে দাঁড়িয়ে জনতার ক্ষোভের দৃশ্য দেখছিল সে। আচমকা একটি গুলি এসে মিরাজের পেটের ডান পাশ দিয়ে ঢুকে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বিষাক্ত বুলেটের আঘাতে বুকের তিনটি হাঁড় ভেঙে যায় তার। অপারেশনের সময় পেটে সেলাই লেগেছে ২৯টি। এখন কোনোরকম চলাফেরা করলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি ছেলেটি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে মিরাজের একমাত্র বোনের উপার্জনে তার চিকিৎসা চলছে। এদিকে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকার যে অনুদান পেয়েছিলো মিরাজের পরিবার, তা এরই মধ্যে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে বলে জানান স্বজনরা।

মিরাজের গুলিবিদ্ধ হওয়া ও চিকিৎসার বর্ণনা দিয়ে বড় বোন পারভিন আক্তার বলেন, যেদিন মিরাজ গুলিবিদ্ধ হয় মিরাজের সমবয়সি দুজন ছেলে তাকে আহত অবস্থায় আমাদের কাছে নিয়ে আসে। হঠাৎ এমন পরিস্থিতি দেখে আমরা কি করবো বুঝতে পারিনি। তখন আমি অন্তঃসত্তা ছিলাম। ওইসময় বাসায় আমি আর মা ছাড়া কোনো পুরুষও ছিল না। আমার কাছে শুধু ৩০০ টাকা ছিল। গুলিবিদ্ধ হয়েছিল বলে প্রতিবেশীরা কেউ ভয়ে আমাদের সঙ্গে হাসপাতালে যেতে রাজি হচ্ছিলো না। আমার স্বামী গ্রামের বাড়িতে থাকায় তাকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। কিন্তু তারও আসার সুযোগ হয়নি।

এরপর তাৎক্ষণিক সাইনবোর্ডের প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করে। পরে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলে যাত্রাবাড়ি কাজলা এলাকায় মাথায় কালো ক্যাপ পরা পুলিশ বা র্যাব হতে পারে এমন কয়েকজন আমাদের অ্যাম্বুলেন্স থামায়। মিরাজকে রক্তাক্ত অবস্থা দেখতে পেয়ে তারা আমাকে ধমক দিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে দেয়। তাদের একজন মিরাজের উদ্দেশ্যে গালি দিয়ে বলে ‘ওরে আরেকটা গুলি কইরা মাইরালা, আন্দোলন করে আবার চিকিৎসা নিতে যাইবো’। মিরাজ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো। তাদেরকে আমি বলি, ‘আমার বাবা নাই। কাজ কইরা আমার মা-ভাইকে খাওয়াই। কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে আমার ভাই গুলি খাইছে।’ আরও অনেক কথা বলার পর তারা মিরাজ ও অ্যাম্বুলেন্সের ছবি তুলে গালমন্দ করে আমাদের ছেড়ে দেয়।

পারভিন আক্তার বলেন, মিরাজের পেটের এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অপারেশনের পর সে এখন তেমন খাওয়াদাওয়াত করতে পারে না। মিরাজের চিকিৎসা করতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন কিস্তি নেওয়া থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনদের কাছে সাড়ে তিন লাখ টাকা ঋণ করেছি। এখন প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকার ঔষধ কেনা লাগে। আমার পরিবারে আমিই একমাত্র উপার্জনকারী।

সরকার কিংবা কারও থেকে কোনো অনুদান পেয়েছেন কি-না প্রশ্নে তিনি বলেন, গত তিন মাস আগে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আমাদের এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আর কোনো কিছু পাইনি। ঈদের কোনো কেনাকাটা আমরা কেউ করিনি। মিরাজকেও কিনে দেওয়ার সামর্থ্য হয়নি। আমার ভাইটা গুলি খাওয়ার কয়দিন আগে ইলেকট্রিকের কাজ শুরু করেছিল।

আহত মিরাজের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তর থানার নাউরী গ্রামে। সে বর্তমানে সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকায় বড় বোনের বাসায় অবস্থান করছে।

এমএন/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।