শিক্ষক হতে জালিয়াতির সাগর পাড়ি
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ধাপ জালিয়াতি করে নিয়োগ পেয়েছেন কুষ্টিয়ার দুই স্কুল শিক্ষক। এমপিওভুক্ত হয়ে এভাবেই বেতন-ভাতা নিচ্ছেন নিয়মিত। বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ নিয়ে তদন্ত করছে উপজেলা শিক্ষা অফিস। অভিযোগ সত্য হলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান কর্তাব্যক্তিরা।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কালিগঙ্গা নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ঘটেছে এমন ঘটনা। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. সামছুজ্জামান মুকুল (কৃষিশিক্ষা) ও মোছা. মুসলিমা খাতুনের (সমাজবিজ্ঞান) বিরুদ্ধে এমন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. ওহিদ উজ জামান এ বিষয়ে গত ২০ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ দেন। তবে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লিখিত অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
জানা যায়, নিয়োগ পেতে প্রথমে জাতীয় পরে স্থানীয় পত্রিকা জালিয়াতি করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করেন অভিযুক্তরা। এরপর নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল তৈরি, নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের সই-সিল জালিয়াতি করে নিয়োগ সম্পন্ন করে নিয়মিত বেতন উত্তোলন করছেন তারা। বর্তমানে বিএড সনদের ভিত্তিতে বেতন স্কেল প্রাপ্তির জন্য রেজুলেশন বিকৃতি ও প্রধান শিক্ষকের সই-সিল জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে দুই স্কুল শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
- আরও পড়ুন
- রোগীর ভারে ন্যুব্জ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল
- দুই জেলার ধানচাষিদের আশা জাগাচ্ছে জিকে সেচ প্রকল্প
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের নগর সাঁওতা, পাহাড়পুর এলাকায় ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কালিগঙ্গা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে বিদ্যালয়টিকে এমপিও ভুক্ত করে সরকার। সেসময় তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অভিযুক্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণের জন্য লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকসহ অন্যরা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কালিগঙ্গা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কাটিংয়ে ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর তারিখের দৈনিক সমকাল পত্রিকার অংশকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বিজ্ঞপ্তিটি সমকালে প্রকাশিত হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। তবে কাটিংয়ে থাকা বিজ্ঞপ্তির অক্ষরের সঙ্গে সমকালে প্রকাশিত অক্ষরের সামঞ্জস্য নেই। আবার ওই তারিখে প্রকাশিত সমকালের ই-পেপারেও কালিগঙ্গা বিদ্যালয়ের কোনো বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। একইভাবে স্থানীয় দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা পত্রিকা জালিয়াতি করে নিয়োগ দেখানো হয়েছে মো. সামছুজ্জামান মুকুলকে। এই ভুয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সহকারী শিক্ষক পদে মুসলিমা খাতুনের নিয়োগে প্রধান শিক্ষক দেখানো হয়েছে মো. সাইফ উদ্দিন ফরিদকে। যিনি ২০১৫ সালের আগেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অব্যাহতি গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া কিয়েটে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তিনি।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখানো প্রধান শিক্ষক মো. সাইফ উদ্দিন ফরিদ বলেন, আমার সময়ে বিদ্যালয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। মুকুল ও মুসলিমাকে আমি চিনি না। কোনো কিছু ঘটে থাকলে তা জালিয়াতি করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক ওহিদ উজ জামান জানান, তিনি ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের আগে ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকায় জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে সহকারী শিক্ষক পদে মোছা. মুসলিমা খাতুন নিয়োগ নিয়েছেন। আর ২০০৩ সালের ১২ মার্চ স্থানীয় দৈনিক বাংলাদেশ বার্তা পত্রিকায় জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি তৈরি করে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ নিয়েছেন মো. সামছুজ্জামান মুকুল। তাদের নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলে সুপারিশকারী বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি, কুষ্টিয়া জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্যদের সই-সিল জালিয়াতি করা হয়েছে।

তার ভাষ্য, জালিয়াতির করে মুসলিমার নিয়োগ ২০১৫ সালে এবং মুকুলের নিয়োগ ২০০৩ সালে দেখানো হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে তারা ২০১৬ সালে বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। যার তথ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোতে (ব্যানবেইস) রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নিয়োগ জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক মুকুল ও মুসলিমা নিয়মিত বেতন ভাতা তুলছেন। সম্প্রতি এই দুই শিক্ষক বিদ্যালয়ের অনুমতি কিংবা কোনো প্রকার ছুটি ছাড়াই রেজুলেশন ও আমার সই-সিল জাল করে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে সেই ডিগ্রির ভিত্তিতে বেতন স্কেল প্রাপ্তির জন্য আমার নিকট আবেদন করেন। নিয়মবহির্ভূত আবেদন গ্রহণ না করায় তারা আমার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। এছাড়াও আমার বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করেছেন। আমি তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির প্রত্যাশায় লিখিত অভিযোগ করেছি।
অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক মো. সামছুজ্জামান মুকুল ও মোছা. মুসলিমা খাতুন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও প্রক্রিয়া বৈধ না অবৈধ তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। এগুলো বুঝবে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক। শিক্ষা কর্মকর্তারা কয়েক দফা যাচাইবাছাই করে এমপিওভুক্ত করেছেন। এভাবেই বেতন তুলছি নিয়মিত।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সাবেক ভারপ্রাপ্ত এক প্রধান শিক্ষক জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক সভাপতি মহব্বত হোসেন, অভিযুক্ত শিক্ষক ও তাদের স্বজনরা ২০১৬ সালের দিকে ভুয়া কাগজপত্রাদি তৈরি করেছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গাঁ ঢাকা দিয়েছেন সাবেক সভাপতি মহব্বত হোসেন। তার মুঠোফোনটিও বন্ধ থাকায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাজমুল হক জানান, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জালিয়াতি হলে ওই শিক্ষকের সব প্রক্রিয়া জালিয়াতি ও অবৈধ। অভিযুক্ত শিক্ষকদের এমপিও তার যোগদানের আগে করা বলে জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ নেওয়া একটি বড় অপরাধ। প্রধান শিক্ষক লিখিত অভিযোগ করেছেন। শিক্ষা কর্মকর্তাকে দ্রুত তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু তৈয়ব মো. ইউনুস আলী বলেন, যাচাইবাছাই করে ভুয়া প্রমাণিত হলে বিধিমতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পাঠানো হবে।
এমএন/জিকেএস