ভরা মৌসুমেও পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের আকাল

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি শরীয়তপুর
প্রকাশিত: ০৩:৩১ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভরা মৌসুম হলেও শরীয়তপুরের পদ্মা-মেঘনায় জেলেদের জালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। ঋণ আর দাদনের বোঝায় জর্জরিত এ জনপদের জেলেদের কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। সারাদিন নদীতে জাল ফেলার পর মাঝেমধ্যে ধরা পড়ছে ছোট ছোট ইলিশ তাও যৎসামান্য।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার অধিকাংশ মানুষ মাছ ধরা পেশার সঙ্গে জড়িত। সরকারি তথ্যমতে জেলায় ছয়টি উপজেলায় নিবন্ধন জেলে রয়েছে ৩৫ হাজার ২৭৪ জন। জেলার পদ্মা ও মেঘনা নদীতে বিগত দিনগুলিতে ইলিশের ভরা মৌসুমে বিপুল পরিমাণ ইলিশ আহরণ হতো। তিন বছর আগে জেলায় ইলিশের উৎপাদন ছিল চার হাজার ৫২৮ মেট্রিকটন। আর তিন বছরের ব্যবধানে সেটি কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার এক মেট্রিকটনে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, দখল দূষণ, নদীতে ডুবোচর জেগে উঠায় দিন দিন ব্যাহত হচ্ছে ইলিশের উৎপাদন। ফলে এসব নদ নদীতে এখন আর আগের মতো ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে না।

স্থানীয় সূত্র জানায়, শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের কুচাইপট্টি, কোদালপুর, ভেদরগঞ্জের সখিপুর, নরসিংহপুর, কাঁচিকাটা, নড়িয়ার সুরেশ্বর, জাজিরার পালেরচর বাজার ইলিশ বিক্রির জন্য বিখ্যাত। তবে এসব বাজারে এখন আর আগের মতো ইলিশ মিলছে না। অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা ইলিশ কিনতে আসলেও ফিরে যান শূন্য হাতে। আর যেসব ইলিশ মাছ ধরা পড়ছে তার দামও বেশ চড়া। ক্রেতা-বিক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা বলছেন বর্তমানে ১ থেকে দেড় কেজি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হয় ২ হাজার টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া আধা কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়ে থাকে ১ হাজার থেকে ১২০০টাকা পর্যন্ত। কিছু কিছু ছোট ইলিশে আবার হালি হিসেবে বিক্রি হয়ে থাকে কোথাও কোথাও। যার দাম ৩৫০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এসব চড়া মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষ এখন বঞ্চিত ইলিশের স্বাদ গ্রহণ থেকে। ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালের মধ্যে আনার দাবী তাদের।

ভরা মৌসুমেও পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের আকাল

সরেজমিনে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, জেলেরা নৌকা আর জাল নিয়ে নদীতে ইলিশ মাছ শিকারে নেমেছেন। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর জালে ধরা পড়ছে ছোট আকারের অল্প কিছু ইলিশ। অনেকেই তাই বাধ্য হয়ে জাল নদী থেকে পাড়ে নিয়ে এসে মেরামত শেষে তুলে রাখছেন। এমনকি নদীপাড়ের আড়তগুলোতেও নেই মাছের দেখা। মাঝেমধ্যে দুই একজন জেলে কিছু মাছ প্লাস্টিকের ট্রেতে করে নিয়ে আসছেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। তবে এদের মধ্যে অধিকাংশ মাছই ছোট আকারের।

সুরেশ্বর ঘাটে মাছ কিনতে আসা ইলিয়াস হোসেন বলেন, আগে এক হাজার টাকার মধ্যে বড় ইলিশ মাছ কিনতে পারতাম। এখন সেই ইলিশ মাছের দাম দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ চাইলেই ইলিশ কিনে খেতে পারেনা। প্রশাসন যদি আগামী অভিযানে সঠিকভাবে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় সঠিক ভূমিকা নিতে পারে তাহলে আশা করছি আগামীতে ইলিশের উৎপাদন বাড়বে।

স্থানীয় বাসিন্দা বোরহান উদ্দিন রাব্বানী বলেন, অভিযানের সময় অনেক মৌসুমী জেলে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতে মা ইলিশ ধরে। তাছাড়া জাটকা রক্ষায়ও প্রশাসন সেভাবে ভূমিকা নিতে পারছে না। এই কারণেই দিন দিন ইলিশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আমরা চাই আগামী অভিযানগুলোতে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিবে, তাহলে আমরা সবাই ইলিশ মাছের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবো।

নদীগুলো তাদের বিরাট বিস্তৃতির মাঝে মীন সন্তানগুলিকে লুকিয়ে রেখেছে নাকি থমকে গেছে উৎপাদন, জানেন না জেলেরা। আর নদীতে মাছ না পেয়ে আর্থিক দৈণ্যদশায় কাটছে জেলার জেলেদের। এমন অবস্থায় সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতার দাবি তাদের। ভেদরগঞ্জ উপজেলার দুর্গম চলাঞ্চল দুলারচর এলাকার জেলে মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন। চলতি বছর মহাজনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার দাদন নিয়ে জাল আর দশ জেলে নিয়ে মাছ ধরছেন পদ্মা-মেঘনার মোহনায়। তবে তাদের জালে ধরা পড়ছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। এতে উঠছে না তাদের শ্রমের মূল্যও। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে এক মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।

মাইনুদ্দিন বলেন, মহাজনের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুন জাল আর ১০ জন মাঝিমাল্লা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে নেমেছি। কিন্তু নদীতে কাঙ্ক্ষিত মাছ পাচ্ছি না। প্রতিদিন যেই সামান্য মাছ পাই এদিয়ে আমাদের খরচার টাকাও উঠে না। আমরা সবাই খুব কষ্টে আছি। সরকার যদি আমাদের একটু আর্থিক সহযোগিতা করতো আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম।

ভরা মৌসুমেও পদ্মা-মেঘনায় ইলিশের আকাল

আবুল কাশেম মিয়া নামের আরেক জেলে বলেন, ‘আড়তে দেনা, এবার নদীতে কোনো মাছই পাইতাছি না। মাহাজনের কাছে দেনা, দোকানে দেনা, তেলের দোকানে দেনা। দেনায় দেনায় জর্জরিত হয়ে গেছি। এখন আমাদের বাঁচার পথ নাই, যদি সরকার সাহায্য না করে।’

গোসাইরহাটের চর মাইঝারা এলাকার জেলে দ্বীন আলী মোড়ল দাবী করে বলেন, ‘আগে এ মৌসুমে অনেক ইলিশ মাছ পাইতাম। মন কে মন মাছ নিয়া ঘাটে নৌকা ভিড়াইতাম। এখন নদী শুকাইয়া যাওয়ায় তেমন মাছ পাইনা। যদি নদী সঠিকভাবে খনন করা যেতো তাহলে মাছ সমুদ্র ছেড়ে নদীর দিকে আসতো।’

জেলেদের জালে ইলিশ ধরা না পরায় হতাশ আড়তদাররাও। বলছেন পর্যাপ্ত ইলিশ না থাকায় দাম বাড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে। তাই ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তাদের। কাঁচিকাটা আড়তের আড়তদার বাদশা সরদার বলেন, ‘আগে এই মৌসুমে প্রচুর ইলিশ মাছ আড়তে আসতো। এখন জেলেদের জালে মাছ ধরা পড়ে না, আড়তেও মাছ আসে না। মাছের প্রচুর দাম। অভিযান সঠিকভাবে না দেয়ায় দিন দিন মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। আমরা চাই ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হোক।’

এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, দখল দুষণসহ নানা কারণে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবো। তাহলে নদীতে ইলিশের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া জেলেদের আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।

বিধান মজুমদার অনি/আরএইচ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।