নড়াইলে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে জৈব সার
চিত্রা নদীর তীরে নড়াইল পৌরসভার উজিরপুর গ্রাম। শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরের এই গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনাসহ বিল-খেত সবুজ-শ্যামলে ভরা। দেখে মনে হবে তুলির আঁচড়ে যেন প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য কেউ এঁকে রেখেছেন।
গ্রামের আমজনতা বলছেন এর সব কিছুই হয়েছে জৈব সার ব্যবহারের কারণে। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের এই নড়াইলেই এখন বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে জৈব সার।
এ সার ব্যব্যহার করায় একদিকে যেমন মাটির গুণাগুণ বাড়ছে তেমনি ভালো ফলনও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে পানের বরজ, সবজি, ধানসহ বিভিন্ন ফসলে কৃষকেরা জৈব সার ব্যবহার করছেন। দূর দূরান্তের কৃষকেরা প্রতিদিন এখানে জড়ো হচ্ছেন। কেউ আসছেন কিনতে আবার অনেকেই আসছেন পদ্ধতি শিখতে। খুলনা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী এবং সিলেটের ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সার নিয়ে বিক্রি করছেন।
২০০৭ সালের কথা। এলাকার কয়েকজন শিক্ষিত বেকার যুবক উজিরপুর গ্রামে মাত্র ২০ শতাংশ জমি বন্দোবস্ত নিয়ে গড়ে তোলেন অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতি। ৯৭ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিতে ১৫ জন নারী সদস্য রয়েছেন। মূলত ১১ জন সদস্য কারখানাটি পরিচালনা করে থাকেন। 
অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে জমিতে জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে। জমিতে ৫ভাগ জৈব পদার্থ থাকার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে আছে এক ভাগেরও কম। কৃষি বিভাগ থেকে এ তথ্য জানতে পেরে সমিতির সদস্যরা উদ্যোগ নেন কিভাবে জৈব সার উৎপাদন করে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করা যায়। শুরু হয় কার্যক্রম। যার নাম দেওয়া হয় চিত্রা জৈব সার। কৃষকদের মধ্যে জৈব সারের’ চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আস্তে আস্তে এর পরিধিও বেড়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নড়াইল পৌরসভার উজিরপুর গ্রামের প্রায় এক একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে জৈব সার তৈরির কারখানা। পুরুষ-মহিলা দিয়ে ২৪০টি পরিবারের সদস্য এখানে কর্মরত আছেন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক কৃষক জৈব সার তৈরি সর্ম্পকে ধারণা নিতে, আবার অনেকে কিনতে আসছেন এখানে।
মাগুরা জেলার শালিখা থানার গঙ্গারামপুর গ্রামের কৃষক রোস্তম আলী জানান, শুনেছি এখানে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। কিভাবে তৈরি করা হচ্ছে এবং কেমন করে জমিতে তা ব্যবহার করতে হয় সে ব্যাপারে ধারণা নিতেই মূলত এখানে আসা। এখান থেকে ধারণা নিয়ে আমার পাশের পলিতা গ্রামের একজন কৃষক নিজেই এখন জৈব সার তৈরি করছে।
খুলনার তেরখাদা উপজেলা থেকে এসেছেন সাহেব আরী। তাকে সার উৎপাদন এবং এর গুণাগুণ ও জমিতে ব্যবহার পদ্ধতি শিখিয়ে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক খন্দকার শাহেদ আলী।
চারটি উপাদানে তৈরি করা হচ্ছে এই জৈব সার। উপাদানগুলো হলো এ্যাজোলা (এক প্রকার শ্যাওলা, যাতে প্রোটিন, ইউরিয়া, এমওপি ও ফসফরাসসহ বিভিন্ন মৌল ও গৌণ উপাদান রয়েছে), অ্যাজোফস (এক প্রকার জিবাণু), ভার্মি কম্পোস্ট (কেঁচো সার) ও ট্রাইকো ডারমা মিশ্রিত কম্পোস্ট (এর মধ্যে রয়েছে গোবর, কচুরিপানা, কাঠের গুড়া, চা পাতি বর্জ্য, ধানের চিটা, মুরগির বিষ্টা, সরিষার খৈল, হাড়ের গুড়া, গবাদি পশুর সিং-এর গুড়া ও শামুক-ঝিনুকের গুড়া)।
উজিরপুর অর্গানিক বহুমুখি সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক সায়েদ আলী শান্ত জানান, ২০০৭ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে প্রতি মাসে ২৫ টন সার তৈরি করা হচ্ছে। কক্সবাজার জেলার চকোরিয়ার অ্যাডভান্স মাল্টি ফার্মা লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বছরে চারশ মেট্রিক টন সার নিয়ে থাকে।
জৈব সার তৈরির বিষয়ে ধারণা নিতে প্রায় প্রতিদিনই আশপাশের জেলা থেকে কৃষকেরা এখানে আসছেন। পরামর্শসহ প্রশিক্ষণও নিচ্ছেন তারা। এছাড়া স্থানীয় কৃষকেরা ছয়শ একর জমিতে এই সার ব্যবহার করে ভালো ফলনও পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, এই জৈব সার তৈরি ও প্যাকেট জাত করতে সময় লাগে ৪০দিন। যে কোনো জাতের ধান উৎপাদনের জন্য প্রতি শতকে ১ কেজি, রবি শষ্য এবং পান ও সবজির জন্য শতকে ২ কেজি জৈব সার প্রয়োজন হয়। প্রথম অবস্থায় এসব জমিতে জৈব সারের পাশাপাশি রাসায়নিক সার সামান্য প্রয়োজন হলেও ৪ থেকে ৫ বছর পরে রাসায়নিক সারের আর প্রয়োজন পড়বে না। তখন জমিতে এই জৈব সার সামান্য ব্যবহার করলেই চলবে। কৃষকের এতে খরচও কমবে এবং জমির উর্বরা শক্তিও বাড়বে।
প্রতি কেজি সার উৎপাদন করতে খরচ পড়ে ১৪ টাকা ৮০ পয়সা। বিক্রি করা হয় ১৫ টাকা ৮০ পয়সায়। প্রতি বস্তায় ৬০ কেজি করে সার থাকে বলেও জানালেন তিনি।
উজিরপুর গ্রামের কৃষক সুমন ভট্যাচার্য্য (৩২) জানান, এ বছর ৩০শতক জমিতে রাসায়নিক সার এবং ৩০ শতক জমিতে জৈব সার ব্যবহার করে পটল উৎপাদন করা হয়। সেখানে জৈব সার ব্যবহার করা জমির ফসল অনেক ভালো এবং খরচও অর্ধেক কম হয়েছে।
নড়াইল কৃষি সম্পসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শেখ আমিনুল হক জাগো নিউজকে জানান, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে জমিতে জৈব পদার্থ কমে যাচ্ছে। জমিতে ৫ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে আছে এক ভাগেরও কম। সেখানে চিত্রা জৈব সার উৎপাদনের উদ্যোগ খুবই প্রশংসনীয়।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ এই সার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি ইতিবাচক প্রতিবেদন দেওয়ায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উজিরপুর অর্গানিক সমিতিকে বাণিজ্যিকভাবে চিত্রা জৈব সার উৎপাদনের জন্য নিবন্ধন দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
এফএ/পিআর