মাদক কারবারিদের ‘সেইফ জোন’ বিচ্ছিন্ন গ্রাম চর আলগী
ব্রহ্মপুত্রের মাঝখানে ভাসমান নিঃসঙ্গ জনপদ চর আলগী। মানচিত্রে সাধারণ গ্রাম, কিন্তু বাস্তবে যেন আলাদা এক ভূখণ্ড। চারদিকে নদী, মাঝখানে বিচ্ছিন্নতা। তবে এই দূরত্বই আজ কিছু মানুষের নিরাপদ আশ্রয়।
প্রশাসনিকভাবে চর আলগী কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চরফরাদী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। অন্যপাশে ময়মনসিংহের পাগলা থানা ও গাজীপুরের কাপাসিয়া। চারপাশের নদী গ্রামটিকে আলাদা করেছে, আর সেই বিচ্ছিন্নতাই এখন মাদকচক্র আর অপরাধীদের নিরাপদ ঘাঁটি।
সমস্যার মূল নির্ধারক ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, স্থানীয় প্রভাবশালীর মদদ ও প্রশাসনের দুর্বল উপস্থিতিতে চর আলগী আজ ‘মাদক ও অপরাধীদের সেইফ জোন।’

অপরাধীদের ঢাল নদী
চর আলগীতে প্রবেশের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। রাতে নদী অন্ধকারে ঢেকে যায়, কেবল স্রোতের শব্দ শোনা যায়। সেই অন্ধকারেই মাদকবাহী নৌকা আসে এবং নিঃশব্দে চলে যায়। বাইরের চক্রের জন্য এই পথ সবচেয়ে নিরাপদ।
বৃদ্ধ মজলু মিয়া বলেন, ‘এখানে অপরাধ করলে লুকাতে হয় না। নদীই লুকিয়ে রাখে। এনামুল, রমিজ, মোস্তাকিম, কাশেম, রিপেল সবাই খোলা চাঁদায় ব্যবসা করছে। পুলিশ আসতে পারলেও যাত্রা লম্বা। নৌযান, দূরত্ব, সময় সবই অপরাধীদের সুবিধা দেয়।’
ভেতরের দাপট
অনুসন্ধানে দেখা গেছে স্থানীয় এনামুল, রমিজ, মোস্তাকিম, কাশেম, রিপেল মিয়া প্রকাশ্যেই মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন। কোনো গোপনীয়তা নেই, বরং দাপটই বেশি। পেছনে আছে নদীপথে আসা বড় সিন্ডিকেট। গ্রামে ঢুকে পড়েছে বাইরের সন্ত্রাসীরাও।

স্থানীয় বাসিন্দা জুয়েল রানা বলেন, ‘ওদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই রাতে ঘরে ফেরা কঠিন। প্রতিবাদ করলে হামলা হয়। উল্টো মিথ্যা মামলা করা হয়।’
প্রশাসনের দুর্বলতা
গ্রামবাসীর অভিযোগ, ৯৯৯-এ ফোন দিলে সাড়া মেলে, কিন্তু পুলিশ পৌঁছাতে সময় লাগে। নৌযান নেই, দূরত্ব বেশি, নিয়মিত টহলও নেই।
পাকুন্দিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোবারক হোসেন বলেন, আমরা মাদক, জুয়া ও গরুচুরি রোধে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেব। জনগণকে সহযোগিতা করতে বলবো।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা সবখানেই ভাঙন
গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়া নেই কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পুলিশ চৌকি। দুই শতাধিক শিক্ষার্থী প্রতিদিন নৌকায় করে পাকুন্দিয়া বা গফরগাঁও যায়। অস্থির পরিবেশে কিছু কিশোরকে ধীরে ধীরে মাদকের দিকে টেনে নেওয়া হচ্ছে।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ফারদিয়া জানায়, ‘ঘাটে অপেক্ষা করতে হয়। মাদকসেবীরা বিরক্ত করে। এভাবে চললে স্কুল-কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।’

সাবেক শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই, নেই স্বাস্থ্য সেবা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। এই শূন্য জায়গাটা মাদকচক্র দখল করেছে।’
জনরোষ
দীর্ঘদিন চুপ থাকা মানুষ এবার রাস্তায় নেমেছে। গ্রামের নারী, পুরুষ ও শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছে। চর আলগীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে দেখা যায়নি।
হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা স্থানীয় ইমাম আল আমিন বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলায় হামলা হয়েছে। পরে আমাদের নামে হয়েছে মিথ্যা মামলা। এখন পরিবার আতঙ্কে।’
পাকুন্দিয়া উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক চেয়ারম্যান ভিপি কামাল উদ্দীন বলেন, ‘ওসিকে নিজে বলেছি অভিযান চালাতে। লোক দেবো বলেছি। তারপরও অভিযান হয়নি। দেরি না করে অপরাধীদের ধরতে হবে।’
গ্রামবাসী বলছে একদিনের অভিযান নয়; নিয়মিত টহল, নৌযানসহ স্থায়ী পুলিশ পোস্ট, সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না হলে মাদকচক্র আবার ফিরে আসবে।
এফএ/জেআইএম