এবারো ডুবে গেছে ৭৪’র আলোচিত নারী বাসন্তির ঘর

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৫০ এএম, ০৬ আগস্ট ২০১৬

এবারের বন্যায়ও ডুবে গেছে ভাইয়ের আশ্রয়ে থাকা চিলমারীর ১৯৭৪ সালের আলোচিত নারী বাসন্তির একমাত্র ঘরটি। রাক্ষুসে ব্রহ্মপুত্র নদের কড়াল গ্রাসে ঘর-বাড়ি বিলীন হবার পর পরেরমনা ইউনিয়নের জোড়গাছ বাজারের পাশে আশ্রয় নিয়েছে বাসন্তি ও তার পরিবার।

নিজের ভিটেমাটি বলতে কিছুই নেই বাসন্তির। ভিক্ষে করে দিন চলতো তার। কিন্তু বন্যায় ভিক্ষাও করতে পারছেন না তিনি। বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে এই নারীর।

বন্যার কারণে এই উপজেলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি কোনো দিন। তেমনি ঘটেনি চলতি বন্যায়ও। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অনেক কিছু বদলে গেলেও সেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ব্যাপক আলোচিত ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মূর্ত প্রতীক কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার আলোচিত বাসন্তির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

বাকপ্রতিবন্ধী বাসন্তির বয়স এখন ৭০ এর কোটায়। কবে, কখন, তার বিয়ে হয়েছে, আর কখনইবা স্বামীকে হারিয়েছেন কিছুই হয়তো মনে পড়ে না তার। হয়তো ক্ষুধার তাড়নায় জীবনের স্বর্ণালি-বর্ণালি সময়গুলোকেই গিলে ফিলেছেন তিনি। দাম্পত্য জীবনে সন্তানের মুখ দেখা হয়নি তার। বাসন্তি সচেতন নন এমনকি নিজের ব্যক্তিগত বিষয়েও চিরকাল অসচেতনই রয়ে গেছেন। অভাব যেন তার সচেতনতাকে গিলে ফেলেছে।

স্বামী-সংসার হারানোর আগেও তাকে মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। পরগাছার মতো বেড়ে ওঠা বাসন্তি বর্তমানে তার এক বড় ভাই আশুরাম দাসের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় বছর তিনেক আগে তার নামে নামকরণ করা বাসন্তি গ্রামটি ব্রহ্মপুত্র নদের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকুও হারিয়ে যায় তাদের। ভগবানের রূপ নিয়ে আশ্রয় দেন সন্তোষ দাস।

তিনিও নদীভাঙনের শিকার হয়ে পাঁচ শতক জমি কিনে বাড়ি করেন। সেখানে বাসন্তি গড়েন ছোট টিনের ছাপড়া। কোনো রকমে দিনাতিপাত করেন বাসন্তি। তার ছোট্ট কুটিরের পাশে সামান্য জমিতে রয়েছে আরো চারটি পরিবারের বসবাস। যেন গাদাগাদি করে জীবন পার করা নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের।

তখন বাসন্তির ভরা যৌবন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে বাসন্তির পরিবারের লোকজন তাকে একই গ্রামের বাবুরামের সঙ্গে বিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে পাক সেনারা চিলমারীতে আসার আগেই স্বামী বাবুরাম বাসন্তিকে ছেড়ে তার চেয়ে বয়সে বড় ওই এলাকার সাইব রানী নামের এক নারীর সঙ্গে প্রেমের টানে ভারতের সুখচরে চলে যান। এরপর বাসন্তির বড় ভাই আশুরাম দাস, ছোট ভাই বিশুরাম দাসসহ জেলে পরিবারগুলো ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে চলে যান মুক্তাঞ্চল রৌমারী। এদের মধ্যে অনেকেই ভারতের আত্মীয়-স্বজন, শরণার্থীশিবির ও মাইনকার চরে আশ্রয় নেন। এভাবেই তারা যুদ্ধের সময়টা অতিবাহিত করেন।

আলোচিত বাসন্তিকে পুনর্বাসনের জন্য সরকারিভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। জোড়গাছ মাঝিপাড়ায় ২০৪টি পরিবারের মধ্যে ১৭৬টি হিন্দু পরিবার এবং ২৮টি মুসলমান পরিবারকে নিয়ে সরকারিভাবে বাসন্তি গ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির আওতায় উল্লেখিত ২০৪টি পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করা হয়। এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ১২ হাজার টাকা। মোট ছয়টি দলে ভাগ করে ঋণ দেয়া হলেও বাসন্তিকে কোনো দলেই রাখা হয়নি।

পরে জমি অধিগ্রহণ না করতে পারায় সরকারিভাবে বাসন্তি গ্রাম নির্মাণের পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর কারিতাস নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে একটি গ্রাম গড়ে তোলে। এনজিওটি বাসন্তির নামে একটি ঘর বরাদ্দ দেয়। ওটাই ছিল বাসন্তির একমাত্র ঠিকানা। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে বাসন্তি গ্রামটি আবারও ভাঙনের মুখে পড়ে। ঘর সরিয়ে আনা হয় নতুন চরে। ক্ষুধার জ্বালায় গ্রামটির অনেক পরিবার কারিতাসের ঘরগুলো বিক্রি করে দেয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, চার পাশে পানি আর পানি। বাসন্তির এলাকাসহ পুরো চিলমারী উপজেলায় শুধু থৈ থৈ পানি। বাড়ি-ঘর ডুবে যাওয়ায় খড়খড়িয়া ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ২০টি পরিবারের লোকজন। বাসন্তিও সেখানে তার ভাইয়ের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে।

চারদিকে পানি থাকায় আপন মনে তাকিয়ে থাকেন বাসন্তি। অনাহারে-অর্ধাহারে শরীরের কাঠামো ভেঙে পড়েছে। ছোট শিশু কিংবা বৃদ্ধ সবার কথা শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে হাসতে থাকেন। পেটে ভাত থাকুক আর নাই থাকুক বাসন্তির হাসিমাখা মুখ সবার নজর কারবেই। তবে তিনি স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারেন না।

বাসন্তির বড় ভাই আশুরাম দাস জানান, নদীতে আগের মতো আর মাছ পাওয়া যায় না, হাতে কোনো কাজও নেই। বানের পানি ওঠায় মাছ একদম পাওয়া যায় না। আমরা চলতে পারছি না। আমি আমার স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে এবং ছোট বোন বাসন্তিকে নিয়ে খুব কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। কয়েক দিন আগে বাসন্তিকে ত্রাণ হিসেবে ২০ কেজি চাল দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে।

এ ব্যাপারে রমনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজগার আলী সরকার বলেন, বন্যায় আমার ইউনিয়নের ৬ হাজার পরিবারের প্রায় ২২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বাসন্তির পরিবারও রয়েছে।

বাসন্তির বিষয়ে তিনি জানান, বয়স্ক ভাতা ছাড়াও সরকারের যেকোনো সাহায্য-সহযোগিতা আসুক আমরা বাসিন্তকে তা দিয়ে থাকি। এছাড়া স্থানীয়রা যে যা পারে তাই দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করে।

উল্লেখ্য, বাসন্তির কলঙ্ক অধ্যায় রচয়িতা হয় ১৯৭৪ সালে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আকস্মিকভাবে বড় ধরনের বন্যা শুরু হলে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। সারাদেশে ঘরে ঘরে দেখা দেয় অভাব। আকালের মরণ ছোবলে শত শত মানুষ তখন ভুখা-নাঙ্গা। সারা দেশের আকাশ বাতাস তখন ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে।

শকুনের পাখার শো শো বাতাসের শব্দে চারদিক থেকে ভেসে আসে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক রুহুল আমিন মজুমদার দুর্ভিক্ষের খোঁজ-খবর নিতে আসেন কুড়িগ্রামের চিলমারীতে। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আসেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ফটোসাংবাদিক আফতাব উদ্দিন।

এসময় জেলা প্রশাসক রুহুল আমীন মজুমদারকে তৎকালীন রমনা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনসার আলী দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে অবগত করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসক তখনও বুঝে উঠতে পারেননি এখানকার দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে। সুযোগ বুঝে ফটোসাংবাদিক আফতাব উদ্দিন ইউপি চেয়ারম্যান আনসার আলীকে ইউনিয়ন পরিষদ সভাকক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে দুজনে নাটক সাজানোর জন্য চলে যান জেলেপল্লীতে। সেখানে পরিকল্পিতভাবে বাকপ্রতিবন্ধী বাসন্তির সমস্ত শরীরে মাছ ধরার জাল পরিয়ে লজ্জা নিবারণের মিথ্যা শান্ত্বনা বুকে নিয়ে একটি মেয়ে কলা গাছের ভেলায় চড়ে কলাগাছের মাঞ্জা বা পাতা সংগ্রহ করছেন বন্যার পানিতে। আরেকজন সাদৃশ্য নারী শ্রীমতি দুর্গতি রাণী বাঁশ হাতে ভেলার অন্য প্রান্তে বসে নিয়ন্ত্রণ করছেন ভেলাটি।

পরে এ ছবি ও একটি প্রতিবেদন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া মাত্রই দেশে-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ছবিটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ব মানবতার মনকে নাড়া দিয়ে ওঠে। ওই ছবিটিকে সম্বল করে জনতার সামনে তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে এতটুকুও ত্রুটি রাখেনি স্বাধীনতাবিরোধীরা। বাসন্তির জাল পরা ছবিটিকে ঘিরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন মুজিব সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে ছবিটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়।

বাসন্তিকে জাল পরানো হয়েছিল, নাকি দারিদ্র্যের কারণে তিনি নিজেই জাল পরে সম্ভ্রম রক্ষা করে ছিলেন তা নিয়ে অনেক বিতর্ক চলে। কিন্তু ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের পর বাসন্তির আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। পৃথিবীর গভীরতর বেদনার ক্ষতগুলো যেমন প্রতিদিন কালো অক্ষরের ফুল হয়ে ফুটে থাকে খবরের কাগজের পাতায় পাতায়। তেমনি এদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি বেদনাময় অধ্যায়ের নাম ‘বাসন্তি’। এমনকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাসন্তি একটি মারাত্মক রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়ে ওঠে। ঐতিহ্যবাহী চিলমারীর পরিচয় ঘটে আরেকবার বাসন্তির এলাকা হিসেবে।

এমএএস/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।