পাহাড় ধসে নিহতের পরিবারগুলো এখনও কাঁদছে
‘কই গেলো আমার আয়েশ দাদুমনিটা, বাড়িজুড়ে শুধু সে ছুটে বেড়াতো। কখনও এ ঘর, কখনও ওই ঘর, পুরো ঘরজুড়ে ছিল তার দুষ্টামি। আমার প্রাণ ছিল সে। সারাক্ষণ দাদু দাদু বলে চিৎকার করতো। এক মুহূর্ত দেখতে না পেলে কান্না করতো দাদুটা আমার। কিন্তু কত দিন হলো আমাকে আর দাদু বলে ডাকে না, একবার দেখতেও আসে না। রাক্ষুসে পাহাড় আমার প্রাণের মানুষটারে কেড়ে নিলো।’ এভাবে নাতিকে নিয়ে কথা বলতে বলতে চোখের জল মুছতে থাকেন বাসনা দাশ (৫৫)।
গত বছরের ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে সংগঠিত হওয়া ভয়াবহ পাহাড় ধসে বাসনা দাশ হারান তার মেঝ ছেলে লিটন দাশ (৩২), স্ত্রী চুমকি দাশ (২১) এবং তাদের একমাত্র সন্তান আয়েশ দাশকে (০২)।
ছেলে ও তার পরিবারকে হারিয়ে বাসনা দাশ এখন প্রায় নিষ্প্রাণ। তার স্বামী গোপাল চন্দ্র দাশ মারা যান অনেক আগেই। তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ছিল তার বসবাস। তিন ছেলের মধ্যে মেঝ ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে পাহাড়। দুই ছেলে নিয়ে এখনও আগের জায়গায় বাস করছে বাসনা। মেঝ ছেলে লিটনকে বিয়ে করিয়েছিল ৪ বছর আগে, সেই ঘরে ছিল তার দুই বছরের আদরের নাতি আয়েশ।

তিনি বলেন, আমার এ ছেলেটা ছিল মায়ের জন্যে কলিজার একটি অংশ। আমার কিছু হলে সে কখনও শান্তিতে থাকতে পারতো না। সারাক্ষণ মা মা বলে ডাকতো। কাজ থেকে ফিরে ঘরের দরজায় এসে আগে মা... বলে ডাক দেয়। কত দিন হয় আমার ছেলেটার মুখে মা ডাক শুনি না। বাবারে ভগবান তোরে আবারও ফিরায় দিতে পারে না? এমন সব কথা বলতে বলতে মায়ের চোখের জল বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউয়ের মতো উপচে পড়তে থাকে।
বাবা-মাকে এখনও খুঁজছে দুই মেয়ে
সালাউদ্দিন ও রহিমা বেগমের আদরের দুই মেয়ে জেসমিন আক্তার মিম (০৭) ও সুমাইয়া আক্তার (০২)। দুই মেয়েকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন তারা। গত বছরের ১৩ জুন পাহাড় ধসের রূপনগর এলাকায় নিখোঁজ হন এই স্বামী-স্ত্রী। এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের লাশ। পরে জেলা প্রশাসন তাদেরকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এই দুই বোন বর্তমানে তাদের চাচা মোহাম্মদ কাউছার ও ফুপু রিনা আক্তারের সঙ্গে শহরের ভেদভেদীতে বাস করছে।
ফুপু রিনা আক্তার বলেন, এরা আমার সন্তান, আমি এদের মা। বড় ভাইয়া ও ভাবি তাদের ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি এই বাচ্চা দুইটাকে আমাদের কাছে রেখে মানুষের মতো মানুষ করতে।

চাচা মোহাম্মদ কাউছার বলেন, আমার ভাই-ভাবির মৃত্যুর পর থেকে আমরা এই মেয়ে দুইটাকে লালন-পালন করছি। বড়টা এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ালেখা করছে আর ছোটটা বাসায় তার ফুপুর সঙ্গে থাকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা তাদের মা-বাবাকে খুঁজে কিন্তু কোথায় থেকে এনে দেব। তবুও তারা আমাকে বাবা বলে ডাকে।
মানুষকে সচেতন করে মাটি চাপায় মারা গেলেন নবী ড্রাইভার
রাঙ্গামাটি শহরের নতুন পাড়ার বাসিন্দা নবী ড্রাইভার। গত বছরের ১৩ জুন ভোর রাতে সেহেরি খেয়ে নামাজ শেষে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকার মানুষকে সচেতন করে বলেন, যে কোনো সময় পাহাড় ধস হতে পারে, সকলে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ আহ্বান জানিয়ে নিজে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বের হবেন এমন সময় হঠাৎ বাড়ির পাশের পাহাড় ধসে পড়ে তাদের ওপর। এতে ঘটনাস্থলে মারা যায় নবী ড্রাইভারের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতনি ওছেলের বউ।
পরে নবী ড্রাইভার ও তার এক ছেলে এবং মেয়ের জামাইকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে রাঙ্গামাটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু চার দিন পর নবী ড্রাইভারও চলে যান না ফেরার দেশে। পাহাড় কেড়ে নিয়েছে এ পরিবারের ৭টি প্রাণ।

ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে ফিরে আসা নবী ড্রাইভারের ছেলে সুমন জানান, সেই দিন ভোরে আমার বাবা সবাইকে নিরাপদে থাকার জন্য বলে এখন নিজেই চলে গেছেন আমাকে এতিম করে। এ দুর্ঘটনায় আমিও আহত হয়েছি। আমার বুক পর্যন্ত মাটি ছিল। আমাকে, আমার বাবা ও আমার বোনের স্বামীকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে। পরে আমি ও আমার বোনের স্বামী বেঁচে গেলেও উদ্ধারের চারদিন পর বাবা মারা যান। ঘটনার এক বছর পার হলেও এখনও স্বজনরা খুঁজে বেড়ায় তাদের আপনজনদের।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৩ জুন রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসে ৫ সেনা সদস্যসহ ১২০ জন মারা যান। এতে জেলাজুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এমএএস/আরআইপি