এ কেমন পরিণতি পাগলির গর্ভে জন্ম নেয়া আব্দুল্লাহদের!

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ১২:৩৯ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২১

‘আমার মাকে আপনারা দেখেছেন? মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে। আমার মা নাকি পাগলি? সবাই আমাকে শুধু মারে।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিল আব্দুল্লাহ নামের এক পথশিশু।

আব্দুল্লাহর বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর। তার সাথে দেখা হয় ঝিনাইদহ জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী মহেশপুর উপজেলার ভৈরবা বাজারে।

জানা যায়, ওই এলাকায় এক মানসিক ভারসাম্যহীন (পাগলি) নারী থাকতেন। এক সময় তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর ফুটফুটে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। সন্তান প্রসবের কিছুদিন পর এলাকা ছেড়ে চলে যান তিনি। এরপর থেকে স্থানীয় আরেক ভিক্ষুক জোসেদা বিবি শিশুটিকে লালন পালন করছেন।

জোসেদা বিবিই তার নাম রাখেন আব্দুল্লাহ। ঠিকানাহীন আব্দুল্লাহ বেড়ে উঠছে সেখানেই।

পাগলির গর্ভে জন্ম নেয়া আব্দুল্লাহর প্রতি সমাজের অভিজাত শ্রেণির কোনো কৃপাদৃষ্টি পড়েনি। ফলে সে এখন রাস্তার টোকাই। তবে অভাগা শিশুটির ঠাঁই হয়েছে আরেক অভাগীর ঘরে। ভৈরবা বাজারের পূর্ব দিকে সরকারের এক টুকরো খাস জমিতে টিনের তৈরি ঝুপড়ি ঘরে। এই ঝুপড়ি ঘরের মালিক জোসেদা নামের এক ভিক্ষুক।

Abdullah

বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া পালিত মাই কোনো রকমে আব্দুল্লাহর মুখে দু’মুঠো ভাতের জোগান দিচ্ছেন। চরম অর্থকষ্ট আর অভাব অনটনের মধ্যেও টাকার কাছে বিক্রি হননি এই মা।

এদিকে জেলার সবথেকে বেশি পথশিশুর বসবাস ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌরসভাধীন মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনে। এখানে প্রায় অর্ধশত পথশিশু রয়েছে। যাদের মধ্যে অনন্ত ১৫ জনের বাবা-মা নেই। জন্মের পর বিভিন্ন সময় তারা সন্তানকে ফেলে চলে গেছেন। এরা অন্যের দেয়া খাবার খেয়ে পথে পথে বেড়ে উঠছে।

এছাড়া কালীগঞ্জে বারোবাজারে রয়েছে আরো একটি বস্তি। সেখানেও রয়েছে প্রায় অর্ধশত পথশিশু।

এদেরই একজন সোহাগ। বয়স ছয় থেকে সাত বছর হবে। বসবাস করছে মোবারকগঞ্জ রেলস্টেশনের পূর্বপাশের বস্তির মর্জিনার ঝুপড়ি ঘরে। যশোরের বেল বস্তিতে কোনো পাগলি মায়ের গর্ভ জন্ম নেয়ার ক’দিন পরেই মর্জিনা তাকে নিয়ে আসেন। এরপর থেকে ভিক্ষুক মর্জিনাই তার মা।

আব্দুল্লাহর পালিত মা জোসেদা জাগো নিউজকে জানান, পাগলী আমাদের এলাকায় বেড়াচ্ছিল, ওর পেটে বাচ্চা দেখে কেউ ওকে ঠাঁই দেয়নি। তখন আমি পাগলিকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। পরে আমার বাড়িতেই আব্দুল্লাহর জন্ম হয়। তখন থেকেই আমি আব্দুল্লাহকে লালন পালন করছি। তবে ওর মা কোথায় হারিয়ে গেছে জানি না।

আব্দুল্লাহর পালিত বাবা আবদুল মজিদ জানান, ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে ওকে লালন পালন করেছি আমরা। এখন আমার চিন্তা আমি আর কতদিন বাঁচব। আমি মরে গেলে ছেলেটির কী হবে। এমন দিন গেছে আব্দুল্লাহকে নিয়ে আমরা না খেয়েও রাত কাটিয়েছি। আমি কাঠ কেটে খাই। ওর জামা কাপড় কিনে দেয়ার সামর্থ্য নেই, স্কুলে দেয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের। ওর জন্য কেউ একটু সাহায্যও দেয় না। যদি সাহায্য করার মতো একটা লোক থাকত তাহলে হয়ত আমরা আব্দুল্লাহকে ভালোভাবে মানুষ করতে পারতাম।

Abdullah

ওই বাজারের চা দোকানি মুসলিম মিয়া জানান, আমাদের এখানে এক পাগলির গর্ভে জন্ম নেয় আব্দুল্লাহ। এরপর ওই পাগলি কোথাই চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। তখন আমাদের গ্রামের আরেকজন ভিক্ষুক মহিলা তাকে লালন পালন করে।

তিনি আরও বলেন, আব্দুল্লাহ সারাদিন বাজারে বাজারে ঘোরাঘুরি করে। আমাদের কাছে এসে খেতে চাইলে আমরা যতদূর পারি তাকে দিই।

ঝিনাইদহের মানবাধিকারকর্মী ও আমেনা খাতুন ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আমিনুর রহমান টুকু বলেন, ‘পাগলি মা হয়েছে, বাবা হয়নি কেউ’ এমন সংবাদ প্রায়ই পত্রিকার পাতায় অথবা টিভি চ্যনেলে সংবাদের রসদ যোগায়। কিন্তু তা কতটুকু নাড়া দিতে পারে আমাদের সভ্য বিবেককে? পাগলির সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের দায় কতটুকু গ্রহণ করে সভ্যতার মুখোশ পরা আমাদের এই ভদ্র সমাজ। জন্মের পরে একটি শিশু মায়ের কোলে বড় হয়। পরিবারের ভালোবাসা নিয়ে বড় হয়। কিন্তু আব্দুল্লাহরা জন্ম নেয় রাস্তায় পড়ে থাকা পাগলির গর্ভে। এদের নিয়ে সরকারের ভাবা উচিৎ। এসব পথশিশুদের জন্য প্রতিটি জেলায় আবাসনসহ বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিৎ বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাশ্বতী শীল বলেন, শুনেছি এক পাগলির সন্তানকে একজন ভিক্ষুক মহিলা লালন পালন করছেন। যদি তিনি বাচ্চাটির লালন-পালনের দায়িত্ব সত্যিই নিয়ে থাকেন তাহলে সেই পরিবারটিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করা হবে।

তিনি আরও বলেন, ওই পরিবারটি যদি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে না থাকে তাহলে আমরা তাকে নিরাপত্তার মধ্যে আনার ব্যবস্থা করব।

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।