ফেনী নদীর শূন্যরেখায় দুই বাংলার মিলনমেলা
গেল দুই বছর বন্ধ থাকার পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বারুণী স্নান উৎসবকে ঘিরে আবারো দুই বাংলার মিলনমেলা হয়েছে পার্বত্য খাগড়াছড়ির রামগড়ের ফেনী নদীতে।
বুধবার (৩০ মার্চ) ভোর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ফেনী নদীর শূন্যরেখায় বসে এ মিলনমেলা। রামগড়ের আনন্দপাড়া, মহামুনী এলাকায় ফেনী নদীতে নেমে পুণ্য স্নান করে নানা বয়সী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এ সময় নিজ নিজ দেশের সীমারেখা থেকে জলকেলিতে মেতে ওঠেন আগত পুণ্যার্থীরা।
রামগড়ের আনন্দ পাড়া থেকে মহামুনী পর্যন্ত দীর্ঘ দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কেবল এ মিলন মেলার দৃশ্য চোখে পড়েছে সারাদিন। এ সময় নদীরপাড়ে দুদেশের সীমারেখায় পুরোহিতরা বসেন পুণ্যার্থীদের তর্পণ পাঠ, পূজা-অর্চনা ও শুদ্ধিব্রত করাতে।
বারুণী হলেন এক হিন্দু পৌরাণিক দেবী। এছাড়াও তিনি বরুণানী এবং জলদেবী নামে পরিচিত। জলদেবীর উদ্দেশ্যেই এই বারুণী স্নান। ব্রিটিশ আমল থেকেই এ উৎসব উদযাপনে সামিল হয়ে আসছে দু’দেশের বাসিন্দারা। চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি পবিত্র দিন। এদিনে প্রতিবছর ফেনী নদীতে বারুণী মেলায় মিলিত হতো সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি নিজেদের পুণ্যলাভ ও সব ধরনের পাপ, পঙ্কিলতা থেকে মুক্তিলাভের আশায় বারুণী স্নানে ছুটে আসতো শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধরাও। একসময় এটি কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। বারুণী স্নান এবং পূজা-অর্চনা ছাড়াও স্বজনদের একপলক দেখতে বহু দূর থেকে ছুটে এসেছেন অনেকেই।
অন্যবছর বারুণী স্নান উৎসবকে ঘিরে একদিনের জন্য সীমান্ত পারাপারের সুযোগ থাকলেও এবার সীমান্ত পারাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল। নদীর শূন্যরেখায় ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) দেওয়া অস্থায়ী সীমারেখায় ছিল নজরদারি। সীমান্তের ওপারে বিএসএফ, ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল টহলে। বিএসএফ এবং বিজিবির কড়া পাহারা থাকায় নিজ নিজ দেশের অংশে পূজা ও স্নান শেষে ফিরে গেছেন পুণ্যার্থীরা।
ফেনী নদীতে কথা হয় মীরসরাই থেকে আসা গীতা রাণী সরকারের সঙ্গে। তিনি জানান, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ভারতের ত্রিপুরায়। মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে এ আশায় বছরের এ দিনটার জন্য মুখিয়ে থাকেন। করোনার কারণে গেলো দুবছর মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি তাদের। সীমান্তরক্ষীদের বাঁধার কারণে মা-মেয়ের দেখাদেখি হলেও কথা হয়নি।

সিনিয়র সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন লাভলু বলেন, বারুণী স্নান শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয়। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে বারুণী স্নানে সম্প্রীতির মেলবন্ধন হতো ফেনী নদীতে। দেশ ভাগ ও স্বাধীনতার পরে সীমান্ত জটিলতায় রামগড় ও ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে পারাপার বন্ধ হলেও প্রতিবছর বারুণী স্নান ঘিরে দুই বাংলায় পারাপার হতো। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত এ উৎসব। করোনা পরিস্থিতির কারণে সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু হয়। এ বছর নদীর শূন্যরেখা পারাপার করতে না দিলেও হয়েছে বারুণী স্নান উৎসব। আশা করি ভবিষ্যতে দুদেশ আরও উদার হবে সম্প্রীতি বিনিময়ে।
রামগড় ৪৩-বিজিবির জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল মাজহার জাগো নিউজকে বলেন, ঐহিত্যবাহী বারুণী স্নানোৎসব কিংবা ধর্মীয় পূজা-অর্চনায় কোনো বাঁধা ছিল না। তবে কেউ যেন সীমান্ত পারাপার করতে না পারে এজন্য সতর্ক ছিল বিজিবি এবং বিএসএফ।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এসজে/এএসএম