মুহিতের বর্ণাঢ্য জীবন

ছামির মাহমুদ
ছামির মাহমুদ ছামির মাহমুদ সিলেট
প্রকাশিত: ০৮:৩৯ এএম, ৩০ এপ্রিল ২০২২
আবুল মাল আবদুল মুহিত

বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী, বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ৮৮ বছর বয়স পূর্ণ করে তিনি ৮৯ বছরে পা দেন। একটি পরিতৃপ্ত, কর্মবহুল ও বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করে গেছেন বর্ষীয়ান এ রাজনীতিবিদ।

বার্ধক্যজনিত কারণে বহুমাত্রিক এই মানুষটি কয়েকমাস ধরে অসুস্থ ছিলেন। শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) দিনগত রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাজেট ঘোষণা করা এই সাবেক অর্থমন্ত্রী দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন। বাংলাদেশের উন্মেষ ও রূপান্তরের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুহিত সরকারি কর্মকর্তার সর্বোচ্চ পদ সচিব, মন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক, গবেষক, পরিবেশবিদ ইত্যাদি নানা পরিচয়ে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

একজন ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সমৃদ্ধিতে তিনি এক রূপান্তরের নায়ক। সরলতা, সততা ও সত্যকথনে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি।

১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্ম নেন। বাবা অ্যাডভোকেট আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী। দুজনই রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন। সংস্কৃতিমনা পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠা মুহিত কৈশোরেই সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় জড়িয়ে পড়েন। শিশু কিশোর সংগঠন ‘মুকুল ফৌজ’ গঠন করে নেমে পড়েন সৃজনশীল চর্চায়।

আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি ১৯৪৮ সালে স্কুলছাত্র হিসেবে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগ দেওয়ার পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন। তবে এই দায়িত্ব গ্রহণ না করে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকোনোমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৭৪ সালে তিনি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এখন পর্যন্ত তিনি একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এ পদে আসীন হয়েছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের চিফ ও উপ-সচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১’র জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২-৮৩ সালে তিনি এরশাদ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি।

১৯৯১ সাল থেকে তিনি সার্বক্ষণিক দেশে অবস্থান করে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের সুশীল সমাজের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি।

২০০১ সালের অগাস্টে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে সিলেট-১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। অত্যন্ত দৃঢ়তা ও সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে তিনি নতুন দিগন্তের সূচনা করেন। ২০১৪ সালে সিলেট-১ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি আবারও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে আর নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের ঘোষণায়ও তিনি ব্যতিক্রম। অবসর নিয়েও মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদে তিনি আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের জাতীয় অনুষ্ঠানে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তিনি অংশগ্রহণ করেছেন।

একজন আবুল মাল আবদুল মুহিত অফুরন্ত জীবনীশক্তির অধিকারী এক প্রাণবন্ত মানুষ। সদা হাস্যোজ্জ্বল কর্মযোগী, ধ্যানী, ধীমান এই মানুষটির স্পষ্টতা, সরলতা ও সাহসিকতা সব মহলে প্রশংসিত।

একজন লেখক হিসেবেও জনাব মুহিত খ্যাতিমান। প্রশাসনিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিষয়ে তার ‘জেলায় জেলায় সরকার’ একটি আকর গ্রন্থ।

বাংলাদেশের মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর এবং গণতান্ত্রিক জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রশাসনিক প্রতিবেদন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালে তিনি প্রণয়ন করেছিলেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্ত্রী সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ, বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষকতা করেন।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।