ধস আতঙ্কেও পাহাড় ছাড়ছেন না বাসিন্দারা

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৬:০৮ পিএম, ২২ জুন ২০২২
মাইকিং করে পাহাড়ে বাস করা মানুষকে নিরাপদে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা

সপ্তাহ খানেক ধরে থেমে থেমে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে কক্সবাজারে। বৃষ্টির কারণে জেলাজুড়ে পাহাড়ধস আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাইকিং করে ঝুঁকিতে পাহাড়ে বা পাদদেশে বাস করা মানুষকে নিরাপদে সরে আসার আহ্বান জানায় জেলা প্রশাসন। তবে দিন-রাত মাইকিং করা হলেও কেউ সরে যেতে সাড়া দিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

থেমে থেমে বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকের ঘরবাড়ি। অনেক স্থানে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। এরপরও জেলার পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বাস করা অন্তত কয়েক লাখ মানুষকে সরিয়ে আনা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (১৮ জুন) থেকে সোমবার (২০ জুন) পর্যন্ত শহর-গ্রামের অনেক রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা অনেকটা তলিয়ে গেছে। হাঁটু কিংবা তার চেয়েও উচ্চতায় পানি উঠেছে কক্সবাজার শহরের বাজারঘাটা, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, আলীরজাহাল, কলাতলীসহ শহরের নিম্নাঞ্চলে। পানি উঠেছে ঈদগাঁও বাজার, কালিরছরা, ভোমরিয়াঘোনা, পেকুয়া, চকরিয়ার নিম্নাঞ্চল ও রামুর বাঁকখালীর তীরবর্তী নিচু এলাকায়।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

একই অবস্থা টেকনাফ, উখিয়া ও মহেশখালীতেও। এতে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। নষ্ট হয়েছে অনেক মালামাল। বৃষ্টি ও পাহাড় বেয়ে নামা পানিতে সড়ক তলিয়ে থাকায় ঝামেলা পোহাতে হয়েছে শিক্ষার্থী, অফিস-আদালতগামীদের। তবে মঙ্গলবার বিকেল থেকে কিছুটা কমেছে বৃষ্টি।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি কক্সবাজার পৌরসভা, মহেশখালী, টেকনাফ, উখিয়া, উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ পাহাড়বেষ্টিত উপজেলা ও পৌরসভা যৌথ বা পৃথকভাবে মাইকিং করে লোকজনকে সচেতন করছে।

সোম (২০ জুন) ও মঙ্গলবার (২১ জুন) বিকেলেও কক্সবাজার পৌরসভার ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সাহিত্যিকা পল্লী ও গরুর হালদা এলাকার পাহাড় কাটার কয়েকটি দৃশ্য পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র হেলাল উদ্দিন কবির।

jagonews24

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসে থাকা লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে তাগাদা দেন পৌরসভার প্রধান নির্বাহী তরিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক জাহিদ ইকবাল, কক্সবাজার পৌরসভার (ভারপ্রাপ্ত) মেয়র হেলাল উদ্দিন কবির, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, পৌর কাউন্সিলর ওমর ছিদ্দিক লালু ও শাহাবুদ্দিনসহ সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সেভাবে কারও সাড়া মেলেনি বলে জানান মাইকিংকারীরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের কক্সবাজার অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল হামিদ মিয়া জানান, শুক্রবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে কক্সবাজারে গড় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৮২ মিলিমিটার। ১৮ ও ২০ জুন ১০০ মিলির উপর বৃষ্টিপাত হয়। মাঝারি ও ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে। বৃষ্টির সঙ্গে দমকা হাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এতে ঘটতে পারে পাহাড়ধসের ঘটনা ।

তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজার পৌরসভার অন্তত ১২টি পাহাড়ে বাস করছে আড়াই লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছে অন্তত ৪০ হাজার। ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকলে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। কক্সবাজার শহরতলীর ফাতেরঘোনা, বৈদ্যঘোনা, মোহাজেরপাড়া, লাইটহাউস, ঘোনারপাড়া, কলাতলীর উত্তর আদর্শগ্রাম, দক্ষিণ আদর্শগ্রাম, চন্দ্রিমার ঘোনা, বখতিয়ার ঘোনা, লারপাড়া, বাসটার্মিনাল এলাকা, বাদশাঘোনা, পাহাড়তলী ও খাজামঞ্জিল পাহাড়ে ও পাহাড়ের খাদে রয়েছে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ বসতি।

বিজ্ঞাপন

jagonews24

জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার পৌরসভা সূত্র মতে, পৌরসভার অভ্যন্তরে ডজনাধিক পাহাড়ে ভূমিধস ঝুঁকিতে আছে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। এসব পাহাড়ে বসতঘর রয়েছে প্রায় ১২ হাজারের বেশি।

সেভ দ্যা নেচার অব বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম রিয়াদ বলেন, বৃষ্টি শুরু হলেই কেবল মাইকিং করে পাহাড়ধসের ক্ষতি থেকে ঝুঁকিতে বাসকারীদের সরানোর উদ্যোগ চলে। এভাবে ঝুঁকি ঠেকানো অসম্ভব। কক্সবাজারের স্বার্থে পাহাড়ে অবৈধ বাসকারিদের সরিয়ে নিতে হবে। উচ্ছেদ করতে হবে অবৈধ স্থাপনা। পাহাড়ে বাসকারীদের মাঝে অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর মতে, গত একদশকে কক্সবাজারে একাধিক পাহাড়ধসের ঘটনায় ছয় সেনাসদস্যসহ অন্তত ৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ রোববার (১৯ জুন) পাহাড় ধসে মহেশখালীতে এক শিশু মারা যায় । ভারি বর্ষণে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে ফাটল ধরে ভূমিধসের ঘটনা ঘটে।

পরিবেশবাদীরা বলেন, পাহাড় কাটার কারণে পাহাড় ধসের ঝুঁকি বাড়ছে। পাহাড় কাটা রোধ করলেই ধসের ঘটনা কমে যাবে। পাহাড়ে অভিযানের পর ফলোআপ করে না পরিবেশ অধিদফতর বা জেলা প্রশাসন। বর্ষা এলেই মাইকিং করে দায়িত্ব শেষ করে। শুষ্ক মৌসুমেই পরিকল্পনা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরাতে হবে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. জাহিদ ইকবাল বলেন, গত সপ্তাহখানেক ধরে মাঝারি ও ভারি বর্ষণ চলছে। এতে ভূমিধসে প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই লোকজনকে পাহাড় ছাড়তে অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করা হচ্ছে। স্বেচ্ছায় তারা সরে না এলে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে সমিতিপাড়ার বাসিন্দা মোস্তফা সরওয়ার বলেন, কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডে দেশের সর্ববৃহৎ নাজিরারটেক শুটকী মহাল। এখানে রয়েছে সমিতি ও কুতুবদিয়াপাড়ার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। কিন্তু টানা বৃষ্টি হলেই এলাকাটি তলিয়ে গিয়ে চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি নালায় রূপান্তর হয়। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি এক হলে এ অঞ্চলের সঙ্গে শহরের গাড়ি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েন পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।

jagonews24

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) হেলাল উদ্দিন কবির বলেন, পাহাড় কাটার মাটি বৃষ্টির পানির সঙ্গে নেমে শহরের নালা-কালভার্ট ভরাট হচ্ছে। এতে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে সয়লাব হয় শহরের অলিগলি। দুর্ভোগ বাড়ে মানুষের। তাই ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ে বসবাসরত লোকজনের ভেতর এ নিয়ে কোনো সাড়া মিলছে না। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে যেকোনো মুহূর্তে পাহাড় ধসে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।

মহেশখালী উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ২০০৭, ২০০৮ ও ২০১২ সালে ভারি বর্ষণে পাহাড়ধসে একই পরিবারের আটজনসহ ১২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এরপরও ছোট মহেশখালী, শাপলাপুর, কালারমারছড়া ও হোয়ানক ইউনিয়নে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে ও টিলায় বাস করছে।

বিজ্ঞাপন

এফএ/এএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।