৭ হাত প্রস্থ আর ১৪ হাত দৈর্ঘ্যের ঘরে বসবাস চা শ্রমিকদের

সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন
প্রকাশিত: ০৪:২২ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

একজন স্থায়ী চা শ্রমিক কোম্পানির পক্ষ থেকে সাত হাত প্রস্থ আর ১৪ হাত দৈর্ঘ্যের একটি ঘর পেয়ে থাকেন। সেখানেই সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে পুরো পরিবারের বসবাস। এর মধ্যেই থাকে রান্না ঘর। গৃহপালিত পশু থাকলে তাদেরও স্থান হয় সেই ঘরের মধ্যেই। সবাইকে একাকার হয়ে ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকতে হয়। এমনই একটি ঘরে তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন চা শ্রমিক মিনা সিং ছত্রি। তিনি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার দারাগাঁও চা বাগানের শ্রমিক।

একই অবস্থা বাগানের আরও অসংখ্য শ্রমিক পরিবারের। এমন পরিস্থিতিতে বড় পরিবারগুলোর সদস্যদের কাউকে বারান্দায়, আবার কাউকে ছোট্ট এ ঘরেই নানা কৌশলে পার্টিশন তৈরি করে থাকতে হচ্ছে।

সরেজমিনে দারাগাঁও চা বাগান ঘুরে দেখা যায়, বাগানের শ্রমিকদের জন্য সাত হাত দৈর্ঘ্য ও ১৪ হাত প্রস্থের একটি ঘর বরাদ্দ আছে। এটি বাগানের স্থায়ী শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে সেখানে অস্থায়ী শ্রমিকরা বাসস্থানের সুবিধা পান না। এ ঘরেই পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের থাকতে হয়। সন্তান বড় হলে তাকে বিয়ে করালে তাদের জায়গা হয় ওই ঘরের একপাশে। কেউ গবাদি পশু পালন করলে তাও এ ঘরেই রাখতে হয়। রান্নার জন্য কোনো আলাদা জায়গা নেই। এর মাঝে অনেকের ঘরের মাটির দেওয়াল। কারও আবার টিনের বেড়া। সেগুলোও ভেঙে যাচ্ছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে অনেকের ঘরে।

চা শ্রমিক মিনা সিং ছত্রি জানান, ১৩ বছর আগে তার স্বামী মারা গেছেন। সংসারে তার তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তিনি একাই বাগানে কাজ করে সংসার চালান। ছেলেমেয়েরা বেকার।

তিনি বলেন, আমার ঘরটি সবদিক দিয়ে ভেঙে গেছে। চাল ভেঙে গেছে। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। আমি সাহেবকে (বাগানের ব্যবস্থাপক) বলেছি, স্যার আমার ঘরটি দেখে দেন। পঞ্চায়েতকেও বলেছি। কিন্তু কেউ আমার ঘর ঠিক করে দিচ্ছে না।

মিনা সিং ছত্রি আরও বলেন, আমার একটি ঘর। এ ঘরেই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুমাই। তারাও উপযুক্ত হয়েছে। এটি আমার জন্য খুব কষ্টের। ঘরে বৃষ্টি এলেই পানি পড়ে।

আরেক চা শ্রমিক রিনা গোয়ালা জানান, তার পরিবারে সদস্য সাতজন। তিন সন্তান, স্বামী-স্ত্রী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি একসঙ্গে থাকেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তিনি একাই বাগানে কাজ করেন। তিনিই একমাত্র স্থায়ী শ্রমিক। তার রোজগারেই চলে পরিবার।

তিনি বলেন, একটি ঘরেই শ্বশুর-শাশুড়ি একপাশে এবং অন্যপাশে স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকি। এ ঘরেরই একপাশে রান্না করি। এ ঘরেই গবাদি পশুও থাকে। এতে আমাদের চরম কষ্ট হয়। ঘরটিও ভাঙাচোরা।

চা শ্রমিক কুসুম তন্তবায় বলেন, আমরা চা শ্রমিক। আমাদেরকে কোম্পানি সাত হাত প্রস্থ এবং ১৪ হাত দৈর্ঘ্যের একটি ঘর দেয়। এ ঘরেই আমরা একদিকে বাবা-মা, অন্যদিকে ছেলে ও ছেলের বউ থাকি। অনেক কষ্ট, লজ্জ্বা-শরম বুকে চেপে আমরা থাকি। একই ঘরে আমরা রান্নাও করি। হাঁস, মুরগিও রাখি। গরু, ছাগল থাকলে তাও রাখি। এর মধ্যে বৃষ্টিতে ঘরে পানি পড়লে মেরামতের জন্য কোম্পানির কাছে বললে তারা নানা অজুহাত দেখায়। বলে টিন নেই। এলে ঠিক করে দেওয়া হবে।

চা শ্রমিক সুভাষ আহির বলেন, আমরা নিজেরা মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করি। এরপর বাগান কর্তৃপক্ষ টিন এবং কাঠ দেয়। তারা বাগানের নষ্ট গাছগুলো কেটে তা দিয়ে কাঠ তৈরি করে দেয়। এ দিয়েই আমরা ঘর বানাই। এতেই আমাদের ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে থাকতে হয়।

দারাগাঁও চা বাগানের ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ফরিদ আহমেদ শাহীন বলেন, একটি পরিবার দিনদিন বড় হয়। কিন্তু বাসস্থান তো একটি নির্দিষ্ট শ্রমিকের জন্য। এখন পরিবারের সবাই যদি একই জায়গায় বাস করতে চায় তবে তো কিছুটা কনজাস্টেড (ঘনবসতি) হবেই। সেটিতে তাদের ম্যানেজ করতে হবে। এখন আমরা সবাইকে একটি করে ঘর দিতে গেলে বাগানে উৎপাদনের জায়গাই তো থাকবে না। বাগান তো শুধু শ্রমিকের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।